ড্যাশ (DASH) ডায়েট এবং হাইপারটেনশন
পায়েল কুমার
বিশিষ্ট পুষ্টিবিদ; ডায়েটেটিক্স-এর বিভাগীয় প্রধান, টেকনো ইন্ডিয়া ডামা হেলথকেয়ার মেডিক্যাল সেন্টার
হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিকগুলির মধ্যে একটি হল রোগী নিজেই জানতে পারেন না যে তিনি ইতিমধ্যেই এই রোগে আক্রান্ত। প্রকৃতপক্ষে, উচ্চ রক্তচাপ আছে এমন প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষই নিজের এই রোগ সম্পর্কে জানেনই না। কারণ উচ্চ রক্তচাপের সেই অর্থে কোনো লক্ষণ থাকে না যদি না এটি খুব গুরুতর হয়। রক্তচাপ বেশি কিনা তা জানার সবচেয়ে ভালো উপায় হল নিয়মিত ব্লাডপ্রেশার মাপা। বাড়িতেও রক্তচাপ মাপতে পারেন। বিশেষ করে যদি আপনার নিকটাত্মীয়র উচ্চ রক্তচাপ থাকে, সেক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অতিরিক্ত উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ
যদি আপনার রক্তচাপ অত্যন্ত বেশি হয়, তবে তার কিছু লক্ষণ থাকতে পারে, যেমন—
● তীব্র মাথাব্যথা
● নাক দিয়ে রক্ত পড়া
● ক্লান্তি বা বিভ্রান্তি
● চোখে দেখায় সমস্যা
● বুকে ব্যাথা
● শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
● অনিয়মিত হৃদস্পন্দন
● প্রস্রাবে রক্ত
● বুকে, ঘাড়ে বা কানে চাপ অনুভব হওয়া।
বহু মানুষ কখনও কখনও মনে করেন যে অন্যান্য কিছু লক্ষণ উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। কিন্তু তেমনটা সবসময় নাও হতে পারে। যেমন—
● মাথা ঘোরা
● নার্ভাসনেস
● ঘাম হওয়া
● ঘুমের সমস্যা
● মুখে জ্বালা
● চোখে রক্তের দাগ
হাইপারটেনসিভ ক্রাইসিস হল হাইপারটেনসিভ আর্জেন্সি এবং হাইপারটেনসিভ ইমার্জেন্সির অন্তর্গত একটি শব্দ। এই দুটি অবস্থা ঘটে যখন রক্তচাপ খুব বেশি হয়ে যায়, এক্ষেত্রে শরীরের কোনো অঙ্গের ক্ষতিও হতে পারে।
হাইপারটেনসিভ আর্জেন্সি
হাইপারটেনসিভ আর্জেন্সি অবস্থা ঘটে যখন রক্তচাপ বেড়ে যায়— রক্তচাপের মাত্রা ১৮০/১১০ বা তার বেশি হয়— কিন্তু শরীরের অঙ্গগুলির কোনো ক্ষতি হয় না। রক্তচাপের ওষুধ দিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রক্তচাপ নিরাপদ মাত্রায় নামিয়ে আনা যায়।
হাইপারটেনসিভ ইমার্জেন্সি
হাইপারটেনসিভ ইমার্জেন্সি মানে রক্তচাপ এত বেশি যে অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে। এক্ষেত্রে আসন্ন অঙ্গ ক্ষতি রোধ করতে রক্তচাপ অবিলম্বে হ্রাস করা আবশ্যক।
যা অত্যন্ত উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার দ্রুততম উপায়। একবার রক্তচাপ নিরাপদ মাত্রায় থাকলে, সাধারণ ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু কিডনি ড্যামেজ হলে, কিডনি ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হতে পারে।
উচ্চরক্তচাপের নির্দিষ্ট কিছু লক্ষণ এবং ম্যালিগন্যান্ট হাইপারটেনশনের সম্ভাব্য কারণগুলির উপর নির্ভর করে। অন্যান্য চিকিৎসা।
ম্যালিগন্যান্ট হাইপারটেনশনের জটিলতাগুলি কী কী?
ম্যালিগন্যান্ট হাইপারটেনশনের চিকিৎসা না করলে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। ম্যালিগন্যান্ট হাইপারটেনশনের জটিলতাগুলির মধ্যে যা লক্ষ্য করা যায়, সেগুলি হল—
● অত্যধিক উচ্চ রক্তচাপ হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করে।
● ফুসফুসে তরল জমা হয়, যাকে পালমোনারি এডিমা বলে৷
● হার্ট অ্যাটাক
● হার্ট ফেলিওর
● স্ট্রোক
● হঠাৎ কিডনি বিকল হওয়া
● অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া মৃত্যুর সম্ভাবনা হ্রাস করে।
ড্যাশ (DASH) ডায়েট এবং হাইপারটেনশন
DASH এর পুরো কথা হল Dietary Approaches to Stop Hypertension.
ড্যাশ ডায়েটের খাদ্যতালিকায় বলা হয়—
● বেশি পরিমাণে ফলমূল, শাকসবজি এবং কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত খাবার খান।
● স্যাচুরেটেড ফ্যাট, কোলেস্টেরল এবং ট্রান্স ফ্যাট বেশি থাকে এমন খাবারের পরিমাণ খাদ্যতালিকায় কমিয়ে দিন।
● গোটা শস্য জাতীয় খাবার, মাছ, মুরগির মাংস এবং বাদাম খান।
● সোডিয়াম, মিষ্টি, চিনিযুক্ত পানীয় এবং রেড মিট কম পরিমাণে খান।
গবেষণায় দেখা যায়, যারা ড্যাশ ডায়েট মেনে খাবার খান তারা দুই সপ্তাহের মধ্যে তাদের রক্তচাপ কমাতে সক্ষম হয়েছেন।
ড্যাশ-সোডিয়াম ডায়েট—
প্রতিদিন সোডিয়ামের ব্যবহার 1,500 মিলিগ্রামে (প্রায় ২/৩ চা চামচ) কমিয়ে আনতে বলা হয়। ড্যাশ-সোডিয়াম ডায়েট ব্যবহারকারী রোগীরা তাদের রক্তচাপও কমিয়ে ফেলেন খুব সহজেই।
ড্যাশ ডায়েট এর সূচনা—
ড্যাশ ডায়েট আসলে বিভিন্ন খাদ্য গোষ্ঠী থেকে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক পরিবেশন বা সার্ভিংসকে বোঝায়। প্রতিদিন আপনার কত ক্যালরি প্রয়োজন তার উপর নির্ভর করে আপনার প্রয়োজনীয় পরিবেশনের সংখ্যা পরিবর্তিত হতে পারে।
ড্যাশ ডায়েট সংক্রান্ত টিপস—
● দুপুর এবং রাতের খাদ্য তালিকায় শাকসবজি যোগ করুন।
● খাবারে বা স্ন্যাকস হিসাবে ফল রাখুন। চিপস বা মিষ্টি খাওয়ার পরিবর্তে, লবণবিহীন বাদাম, কিশমিশ, কম ফ্যাটযুক্ত এবং ফ্যাট ছাড়া দই, মাখন ও লবণ ছাড়া প্লেইন পপকর্ন খান।
● টিনজাত এবং ড্রাইফ্রুটস ব্যবহার করা সহজ, তবে নিশ্চিত হয়ে নেবেন যে তার মধ্যে চিনির উপস্থিতি নেই।
● মাখন বা মার্জারিন প্রয়োজনের অর্ধেক ব্যবহার করুন এবং কম চর্বিযুক্ত বা চর্বি-মুক্ত মশলা ব্যবহার করুন।
● ফুল ক্রিম দুধের বদলে স্কিমড মিল্ক ডায়েটে যোগ করুন।
● চিকেন খেতে পারেন, তবে সীমিত পরিমাণে।
● খাদ্যতালিকায় আরও শাকসবজি এবং শুকনো ছোলাও রাখা যেতে পারে।
● সোডিয়াম কম আছে এমন খাবার ডায়েটে রাখুন৷
ড্যাশ ডায়েটের ক্ষেত্রে কয়েকটি পরামর্শ—
খাদ্যশস্য : রোজ ৭ থেকে ৮ বার।
শাকসবজি : রোজ ৪ থেকে ৫ বার।
ফল : রোজ ৪ থেকে ৫ বার।
ফ্যাট বিহীন দুধ : রোজ ২ থেকে ৩ বার।
মাংস, মুরগি এবং মাছ : রোজ ২ বা তার কম।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিদিন ২,৫০০ মিলিগ্রামের কম সোডিয়াম গ্রহণ করা উচিত, যদি না আপনার উচ্চ রক্তচাপ থাকে বা যদি কোনোরকম ঝুঁকি থাকে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি রোজ ১,৫০০ মিলিগ্রাম লবণ খাওয়া হয়। এটি আপনার সমস্ত খাবার এবং স্ন্যাকসের তুলনায় এক চা চামচেরও কম।
মনে রাখুন
খাবারের সঙ্গে লবণ নেওয়ার অভ্যাসটি ত্যাগ করুন। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন অনুসারে খাবারে লবণে প্রায় ৪০% সোডিয়াম থাকে। তাই খাবারে লবণ নেওয়া এড়িয়ে চলুন।
কেনাকাটা করার সময় কন্টেনারের লেবেলের লেখা পড়ুন। কম সোডিয়ামযুক্ত শষ্য, পাস্তা সস, টিনজাত শাকসবজি বা কম লবণ যুক্ত খাবার খান। প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবার কম খান। প্যাকেজিং করা, প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলি ডায়েটে বেশিমাত্রায় সোডিয়ামের জন্য দায়ী। আপনি যদি আপনার নিজের খাবার তৈরি করেন, সেক্ষেত্রে আপনি নিজের খাদ্য উপাদান নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবেন৷
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments