নস্টালজিক বাঙালির শীত মানেই
নলেন গুড়
ডঃ পায়েল কুমার রায়
ডায়েটেটিক্স–এর বিভাগীয় প্রধান ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার পুষ্টিবিদ, টেকনো ইন্ডিয়া ডামা মাল্টিস্পেশালিটি হসপিটাল
শীত মানেই বাংলার বাড়িতে বাড়িতে নতুন গুড়। গুড়ের পায়েস, পিঠে–পুলি, মিষ্টি। এই নলেন গুড় দিয়ে গরম রুটি, পরোটার স্বাদই অন্যরকম। পাতলা, গাঢ় খয়েরি গুড়ের জন্য সারা বছর প্রতীক্ষা করে থাকে বাঙালি। এই গুড় দিয়েই তৈরি হয় সুস্বাদু মোয়াও। এছাড়াও গুড়ের সন্দেশ, রসগোল্লা এসব কিন্তু বছরের এই একটা সময়েই পাওয়া যায়।
নলেন গুড় আসলে কিন্তু খেজুরের গুড় বা খেজুরের রস। নভেম্বর মাসের শেষ থেকেই পাওয়া যায় এই খেজুর গুড়। সকালে খেজুরের রস আর একটু বেলার দিকে এই গুড় জ্বাল দিয়েই তৈরি হয় গুড়। গুড় জ্বাল দিয়ে বানানো হয়ে যাওয়ার পর যে দানা থেকে যায় তা নিষ্কাশিত করেই কিন্তু চিনি তৈরি হয়। গুড়ের এই চিনি কিন্তু ব্রাউন সুগার নামে পরিচিত।
গুড়ের উপকারিতাও অনেক—
✦ হজম ভালো করায় নলেন গুড়: শীতে সবারই মিষ্টির প্রতি ঝোঁক বাড়ে। কিন্তু যাঁরা ডায়াবেটিক, তাঁদের চিনি খাওয়া চলে না। সেক্ষেত্রে নলেন গুড় খেতে (পরিমাণ মতো) পারলে কোনও অসুবিধে হয় না। সেই সঙ্গে মিষ্টির স্বাদপূরণও হয়। যখন কোনও খাবারের জন্য খুব বেশি ক্রেভিং হয়, তাহলে জোর করে তা চেপে না রেখে খেয়ে ফেলা উচিত। তেমনই হল মিষ্টি। সবারই মিষ্টির প্রতি লোভ থাকে। আর বছরে মাত্র দু’মাস ঠান্ডার আমেজ থাকে। এই ক’দিন কি আর মিষ্টি না খেয়ে থাকা যায়! তাই মুশকিল আসান হয়ে আসে নলেন গুড়। (প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ গ্রাম)
শীতে বাড়ে রোগজ্বালার প্রকোপ। এমনকী ভাইরাস–ব্যাকটিরিয়াও সক্রিয় হয় এই শীতকালেই। ফলে সর্দি, কাশি, হজমের সমস্যা, গ্যাস, অম্বল এসব লেগেই থাকে। তাই সকালে খালিপেটে গুড়–আদা খেলে যেমন সমস্যার সমাধান হয় তেমনই খাবার পর গুড়ের গরম রসগোল্লা কিংবা সামান্য পায়েস খেলেও হজম ক্ষমতার উন্নতি হয়। দেহে তৈরি হয় হজমে সাহায্যকারী উৎসেচক।
✦ খেজুর গুড়ে থাকে প্রচুর পরিমাণ আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম। যা আমাদের শরীরে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ায়। যাঁদের অ্যানিমিয়া থাকে, তাঁদের তাই প্রতিদিন একটু করে গুড় খেতে বলা হয়।
✦ অ্যান্টি–অক্সিড্যান্টে ভরপুর: নলেন গুড়ে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টি–অক্সিড্যান্ট থাকে। যা আমাদের শরীরকে রক্ষা করে, শরীর থেকে বিষাক্ত টক্সিন বের করে দিয়ে। এতে শরীর থাকে সুস্থ। সেই সঙ্গে ভালো থাকে আমাদের ত্বকও।
✦ এনার্জি দেয়: কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবারই আমাদের শরীরে এনার্জি দেয়। চিনিও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু চিনি খেলে আমাদের শরীরে অল্প সময়ের মধ্যেই গ্লুকোজ তৈরি হয়। আর হঠাৎ তৈরি হওয়া এই জটিল কার্বস দেহের অন্যান্য অঙ্গের উপর প্রভাব ফেলে। কিন্তু গুড়ের মিষ্টি খেলে এই সমস্যা হয় না। কারণ গুড়ের রক্তের সঙ্গে মিশে গ্লুকোজ উৎপাদন করা এই প্রক্রিয়াতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। ফলে অন্য অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
✦ হরমোনের ক্ষরণ ঠিক রাখে: নলেন গুড়ে রয়েছে আয়রন, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়ামসহ প্রয়োজনীয় ভিটামিন। যা আমাদের দেহে হরমোনের সঠিক ক্রিয়া বজায় রাখতে সাহায্য করে— বিশেষত মেয়েদের। অনেক মহিলাই পিএমএসে ভোগেন। প্রতিদিন গুড় খেলে হ্যাপি হরমোনের ক্ষরণ হয়। ফলে মন মেজাজ ভালো থাকে।
✦ ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখে: সাধারণত শীতে জল কম খাওয়া হয়। শরীরে জল ধরে রাখার ক্ষমতাও কমে যায়। এই সমস্যা কিছুটা কমাতে পারে নলেন গুড়। এটি ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে।
✦ ঋতুকালীন ব্যথা কমায়: এই গুড় খেলে এন্ডরফিন হরমোনের ক্ষরণ বাড়তে পারে। ফলে ঋতুকালীন ব্যথা কমে।
✦ মাইগ্রেনের সমস্যা উপশম: মাইগ্রেনের সমস্যা কিছুটা কমাতে পারে গুড়ে। এটি শীতকালে খেলে যাঁরা এই সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের সমস্যা কিছুটা কমে।
✦ হাড় শক্তপোক্ত হয়: শীতে বাতের ব্যথা বাড়ে। এই জাতীয় সমস্যা কিছুটা কমাতে পারে নলেন গুড়। কারণ এতে থাকে ক্যালসিয়াম। আর সেটি হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে।
তবে...
তবে একটি কথা মনে রাখতেই হবে কোনও জিনিসই অতিরিক্ত খাওয়া ভালো নয়। তাছাড়া যাঁদের ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে নলেন গুড় খাওয়া আদৌ ঠিক না বা খেলেও কতটা পরিমাণে খাওয়া উচিত, তা বলতে পারবেন পুষ্টিবিদ, চিকিৎসকরাই। তাই সব কিছুর আগে একজন পুষ্টিবিদ বা চিকিৎসকের মতামত নিয়ে নেওয়াটা খুব জরুরি।
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments