টক দই
শত গুণের আধার
পায়েল কুমার রায়
বিশিষ্ট পুষ্টিবিদ; ডায়েটেটিক্স-এর বিভাগীয় প্রধান, টেকনো ইন্ডিয়া ডামা হেলথকেয়ার মেডিক্যাল সেন্টার
রোগ প্রতিরোধে অন্যতম বড় হাতিয়ার খাবার। আর এই রোগ-প্রতিরোধক খাবারের অন্যতম একটি হল টক দই। খাবার যেমন রোগকে দূরে রাখতে পারে, তেমনি আবার খাবারের কারণে অনেক রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। কাজেই কিছু নিয়মকানুন মেনে খাবার ব্যাপারেও সবাইকে হতে হবে অনেক বেশি সচেতন। পৃথিবীতে বেশ কিছু খাবার আছে যা একই সঙ্গে শত গুণের আধার। যেমন টক দই। টক দইয়ে রয়েছে ভিটামিন, মিনারেল ইত্যাদি। দইয়ে প্রচুর উপকারি ব্যাকটিরিয়া রয়েছে— যা আমাদের জন্য ভীষণ উপকারি। এতে দুধের চেয়েও বেশি ভিটামিন বি, ক্যালসিয়াম আছে। নিয়মিত টক দই খাওয়া শুরু করলে তার ফল পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে।
মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় পরিপাকতন্ত্রের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইমিউন সেলের শতকরা ৭০ ভাগই অবস্থান করে পরিপাকতন্ত্রের গায়ে। এখান থেকেই তৈরি হয় সে সব অ্যান্টিবডি ও কোষ, যা ক্ষতিকর ব্যাকটিরিয়াগুলিকে শনাক্ত করে ও মেরে ফেলে। যেহেতু খাবারের সঙ্গে পাকস্থলীতে নানা ধরনের জীবাণুও ঢোকে, তাই পাকস্থলীর আবরণের একটা কাজই হল এগুলোকে শরীরে ঢুকতে না দেওয়া। এছাড়া পাকস্থলীর ভেতরে রয়েছে কিছু উপকারি ব্যাকটিরিয়াও। যাদের কাজ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে চাঙ্গা রাখা। এদেরকে বলা হয় প্রো-বায়োটিক। প্রো-বায়োটিক আছে, এমন সব খাবার খেয়েও আপনি এই উপকারি ব্যাকটিরিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। যেমন, টকদই, পনির, জলপাই ইত্যাদি।
টক দইয়ের উপকারিতা
● রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি, যা হাড় ও দাঁতের গঠনে সহায়ক।
● মহিলাদের টক দই বেশি প্রয়োজন, কারণ তারাই ক্যালসিয়ামের অভাবে বেশি ভোগেন।
● টক দইয়ের ব্যাকটিরিয়া অত্যন্ত উপকারি, এটা শরীরের ক্ষতিকর ব্যাকটিরিয়াকে মেরে ফেলে এবং উপকারি ব্যাকটিরিয়া বাড়িয়ে হজম শক্তি বৃদ্ধি করে।
● টক দই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এ ছাড়া ঠান্ডা, সর্দি, জ্বরকে দুরে রাখে।
● টক দইয়ে আছে ল্যাকটিক অ্যাসিড, যা কোষ্টকাঠিন্য দূর করে ও ডায়েরিয়া প্রতিরোধ করে।
● এটি কোলন ক্যান্সার রোগীদের খাদ্য হিসাবে উপকারি।
● যারা দুধ খেতে পারেন না বা দুধ যাদের হজম হয় না, তারা অনায়াসেই টক দই খেতে পারেন।
● টক দই ওজন কমাতেও সাহায্য করে। ফলে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করতে ইচ্ছে করে না। আর অতিরিক্ত খাবার না খেলে সহজেই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
● টক দই শরীরের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। প্রতিদিন মাত্র এক কাপ করে টক দই খেলে উচ্চ রক্তচাপ প্রায় এক তৃতীয়াংশ কমে যায় এবং স্বাভাবিক হয়ে আসে। এছাড়া এটি রক্তের খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতেও সাহায্য করে।
● হার্টের অসুখ ও ডায়াবেটিসের রোগীরা টক দই খেলে অসুখ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
● টক দই শরীরে টক্সিন জমতে দেয় না। ফলে অন্ত্রনালী পরিষ্কার থাকে। যা শরীরকে সুস্থ রাখে ও বার্ধক্য রোধে সাহায্য করে।
● নিয়মিত টক দই খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
টক দই খাওয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি হচ্ছে বোরহানি করে খাওয়া। টক দইয়ে বিট নুন, গোল মরিচ গুঁড়ো, পুদিনা বাটা ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা বোরহানি খেতে যেমন অসাধারণ তেমনি স্বাস্থ্যকরও। এছাড়া স্বাদ অন্যরকম করতে তেতুলের রস ও জিরে গুঁড়োও মেশানো যায় বোরহানির সঙ্গে। টম্যাটো, শসা, গাজর ইত্যাদি কেটে টক দই মিশিয়ে তার সঙ্গে বিট নুন, গোল মরিচের গুঁড়ো যোগ করে খাওয়া যায়।
এছাড়াও বিভিন্ন ফল কেটে টক দই সহযোগেও খাওয়া যায়। দুটো পদ্ধতিই সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। যেভাবেই টক দই খাওয়া হোক না কেন মূল কথা হচ্ছে এটি ভীষণ উপকারি। নিয়মিতভাবে টক দই খেলে আমাদের শরীর থাকবে রোগমুক্ত, সতেজ ও স্বাভাবিক।
টক দই খাওয়া শরীরের জন্য উপকারি একথা কম-বেশি সবারই জানা। প্রতিদিন এক বাটি টক দই খেলে শারীরিক অনেক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। দুপুরের খাবার খাওয়ার পরে এক বাটি টক দই খেলে তা শরীরের জন্য নানা উপকার বয়ে আনে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, খুব বেশি যেন খাওয়া না হয়।
দিনে ৩০০-৪০০ গ্রাম পর্যন্ত দই খাওয়া যেতে পারে কিন্তু এর বেশি না খাওয়াই ভালো। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দই খেয়ে ফেললে তা শরীরে অত্যাধিক ক্যালসিয়াম সৃষ্টির কারণ হতে পারে। যা স্বাস্থ্যের জটিলতা বাড়াতে পারে। মনে রাখবেন, মিষ্টি দইয়ের থেকে টক দই খাওয়া বেশি উপকারি।
জেনে নিন খাওয়ার পরে এক বাটি দই খেলে কী কী উপকার মেলে—
ফ্যাট কমায়
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ফ্যাট এড়িয়ে চলেন অনেকে। আর টক দইয়ে ফ্যাট থাকে অনেক কম। যে কারণে এটি ওজন কমাতে সাহায্য করে। টক দই রক্তের কোলেস্টরল কমাতে বিশেষভাবে সহায়ক। তাই এটি কার্ডিওভাস্কুলার সমস্যা, স্ট্রোক এবং হৃদপিণ্ডের সমস্যার ঝুঁকি কমায়।
ওজন কমায়
ওজন কমানোর জন্য নানা প্রচেষ্টা থাকে নানা জনের। এক্ষেত্রে অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে টক দই। টক দইয়ে ফ্যাট অনেক কম থাকে। এছাড়াও টক দইয়ের সঙ্গে ফল খাওয়ার অভ্যাস করতে পারলে ক্ষুধা বোধ কম হয়।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
টক দইয়ের ল্যাকটিক কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। এটি যদি নিয়মিত খেতে পারেন তবে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। দই হজমশক্তিও উন্নত করে। দই খেলে মানসিক চাপ এবং অ্যানজাইটি কমতে শুরু করে।
বদহজম দূর করে
খাবারে একটু এদিক-ওদিক হলে বদ হজমের সমস্যায় ভোগেন অনেকে। এই সমস্যা দূর করতে সাহায্য করতে পারে টক দই। টক দইয়ের ফারমেন্টেড এনজাইম খাবার হজমে সহায়তা করে এবং বদহজম প্রতিরোধ করে। নিয়মিত একবাটি করে দই খেলে ওজন কমার সম্ভাবনা প্রায় ২২ শতাংশ।
দূরে রাখে উচ্চ রক্তচাপ
উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভোগেন অনেকেই। এটি দূরে রাখতে টক দইয়ের জুড়ি নেই বলতে পারেন। নিয়মিত টক দই খাওয়ার অভ্যাস করলে তা কোলেস্টরল এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমায়। দইয়ে থাকা উপকারি ব্যাকটিরিয়া শরীরে প্রবেশ করার পর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে দেয়।
দেখলেন তো, প্রতিদিন দুপুরের খাবারের পরে এক বাটি টক দই খেলে কত উপকার মেলে! তাই এখন থেকে অন্যান্য স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ার পাশাপাশি দুপুরের খাবারের পরে এক বাটি টক দই খাওয়ার অভ্যাস করুন। সুস্থতার পথে অনেকটাই এগিয়ে থাকবেন।
দই খুবই পুষ্টিকর একটি খাবার। কিন্তু দই খাওয়ার সময়ে কয়েকটি নিয়ম মনে রাখা উচিত।
দই খুবই পুষ্টিকর একটি পদ। আদি যুগ থেকেই ভারতে দই খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। ভারতীয় আয়ুর্বেদেও দইকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। খাবার খাওয়ার পরে বা খাবারের সঙ্গে দই খেলে বহু ধরনের উপকার পাওয়া যায় বলে দাবি করা হয়েছে এই শাস্ত্রে।
দইয়ে প্রচুর উপকারী ব্যাকটিরিয়া রয়েছে। এগুলি মানুষের পেটের নানা উপকার করে। হজমে সাহায্য করে। ক্ষতিকারক জীবাণুর সঙ্গে লড়তে সাহায্য করে। তাছাড়া দইয়ে প্রচুর ফসফরাস রয়েছে। এটিও শরীরের নানা কাজে লাগে।
অনেকেই ল্যাকটোস ইনটলারেন্স (lactose intolerant) ভোগেন। অর্থাৎ দুগ্ধজাত পদ খেলে তাঁদের সমস্যা হয়। তাঁদের অনেকেই সহজে দই খেতে পারেন। কোনও সমস্যা হয় না। ভিটামিন এ, বি৬, বি১২, ল্যাকটিক অ্যাসিড-এর জোগান দিতে পারে দই। ফলে নিয়মিত দই খেলে শরীরের লাভই হয়। তাছাড়া দই নিয়মিত খেলে ওজনও কমে।
কিন্তু মনে রাখা দরকার দই খাওয়ার নিয়ম আছে। সেই নিয়মগুলি মেনে না চললে দই সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
দই কখনও গরম করে খাওয়া উচিত নয়। তাতে দইয়ের অধিকাংশ গুণই নষ্ট হয়ে যায়। শুধুমাত্র অ্যাসিড থেকে যায়। যা থেকে অম্বলের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments