আজ ২২ মার্চ। বিশ্ব জল দিবস। এবারের থিম— ‘Accelerating the change to solve the water and sanitation crisis’
জলই জীবন
প্রীতিময় রায়বর্মন
১৯৯৩ সালে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ সভা ২২ মার্চ ‘বিশ্ব জল দিবস’ পালনের কথা ঘোষণা করে। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে জাতিসঙ্ঘের ‘পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলন’ (ইউএনসিইডি)–এর অ্যাজেন্ডা ২১–এ ‘বিশ্ব জল দিবস’ পালনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। দিনটি পালনের উদ্দেশ্য— পরিশুদ্ধ জলের গুরুত্বের উপর নজর দেওয়া এবং জলসম্পদ পরিচালনার জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ।
এখনও বিশ্বের প্রায় ২.১ বিলিয়ন মানুষ পরিশুদ্ধ পানীয় জল পান না। চারটির মধ্যে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিশুদ্ধ পানীয় জল নেই, পড়ুয়ারা বাধ্য হয়ে পান করতে হয় অপরিষ্কার জল। পাঁচ বছরের কম বয়সি বাচ্চাদের ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর অন্যতম কারণ পরিশুদ্ধ পানীয় জল না পাওয়া। সারা বিশ্বে বর্তমানে কৃষিকার্যের জন্য জল উত্তোলন করা হয় ৭০% , শিল্পক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জলের মোট ২০% , অবশিষ্ট ১০% গৃহস্থালি ব্যবহারে এবং ১%–এর চেয়েও কম জল পান করার জন্য ব্যবহার করা হয়। সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, প্রতি বছর কমপক্ষে ৪ বিলিয়ন মানুষ অন্তত এক মাস জলকষ্টে ভোগেন। ২০৩০ সালের মধ্যে অন্তত ৭০০ মিলিয়ন মানুষ জলের অভাবে স্থানচ্যুত হতে পারেন এবং ২০৫০ সালের মধ্যে, বিশ্বের জনসংখ্যা আনুমানিক ২ বিলিয়ন বৃদ্ধি পেলে, বিশ্বব্যাপী জলের চাহিদা এখনের চেয়ে ৩০% বেশি হতে পারে।
এদিকে ভূগর্ভস্থ জলস্তর ক্রমেই নামছে। সারা বিশ্বের প্রায় ২৫% ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন করা হয় ভারতে। ভারতে ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ভূগর্ভস্থ জলস্তরের উচ্চতা কমেছে প্রতি বছরে ১০–২৫ মিমি। তথ্য বলছে, ভূগর্ভস্থ জলস্তরের উচ্চতা যদি এই হারে কমতে থাকে, তাহলে ভারতের জনসংখ্যার ৪০%–এর বেশি মানুষ পানীয় জলের সমস্যা পড়তে পারেন। এর জন্য দায়ী পাম্পের সাহায্যে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন। ইতিমধ্যেই গরমে অনেক জায়গায় তীব্র জলসংকট দেখা দিতে শুরু করেছে। অনেকেরই ধারণা, বিশ্বের প্রায় ৭১%–ই তো জল, তাহলে জল নিয়ে এতো দুশ্চিন্তা কীসের? দুশ্চিন্তার কারণ, এই ৭১%–এর মধ্যে ব্যবহারযোগ্য জলের পরিমাণ খুবই কম। আর পান করার মতো জলের পরিমাণ তার চেয়েও কম। আমরা যদি বাস্তুতন্ত্রের প্রতি অবহেলা করি, পরোক্ষভাবে তা পরিবেশের ক্ষতি করে এবং জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটায়। ভবিষ্যতে জলসংকট থেকে রেহাই পেতে জলের অপচয় যেমন বন্ধ করতে হবে, তেমনই প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন করা চলবে না। রক্ষা করতে হবে বনাঞ্চলকে, জোর দিতে হবে বৃক্ষরোপনে।
জল আছে বলেই পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে। পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের সঞ্চার এই জলেই। জল ছাড়া জীবন একেবারেই অচল। তাই তো জলের অপর নাম জীবন।
এক নজরে দেখে নেওয়া যাক শরীরে জলের উপকার—
✔ ডিহাইড্রেশনে শরীরকে পুনরায় সতেজ করতে জল বিকল্পহীন।
✔ জল খেয়ে আপনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন ওজন, ব্লাড সুগার, সোডিয়ামের মাত্রা; কমাতে পারেন শরীরের অতিরিক্ত ফ্যাট, ক্যালরি। এমনটাই উঠে এসেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের চালানো গবেষণায়। ১৮,৩০০ জন প্রাপ্তবয়স্কের ওপর চালানো গবেষণায় দেখা গেছিল এদের মধ্যে যাঁরা জল খাওয়া বাড়িয়েছেন, তাঁদের ১%–এর হলেও স্যাচুরেটেড ফ্যাট, সুগার এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা কমেছে। যারা দিনে ১–৩ কাপ জল খাওয়া বাড়িয়েছেন, তাঁদের শরীরে প্রতিদিন অতিরিক্ত ক্যালরির পরিমাণ কমেছে ৬৮ থেকে ২০৫, সুগার কমেছে ৫ থেকে ১৮ গ্রাম এবং কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমেছে ৭ থেকে ২১ মিলিগ্রাম।
✔ একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের আড়াই লিটার ও মহিলার দু’লিটার জল খাওয়া জরুরি। তবে এই জল খাওয়ার পরিমাণটা নির্ভর করে আবহাওয়া (শীত, গ্রীষ্ম না বর্ষা প্রধান দেশ), শরীরে কোনও ক্রনিক অসুখ (হার্টের অসুখ, কিডনির সমস্যা, লিভার বা ফুসফুসে সমস্যা ইত্যাদি) আছে কি না তার ওপর।
✔ ত্বককে প্রাণবন্ত রাখতে জলের ভূমিকা রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সপ্তাহে অন্তত ৪ দিন আড়াই লিটারের মতো জল খেলে, ত্বক হয় উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত।
✔ জল শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বের করে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। নিয়ন্ত্রণ করে শরীরের তাপমাত্রাকে। আর লিভার ও শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ফ্যাট মেটাবলিজমের জন্য জল ভীষণ জরুরি। ওবেসিটি আর মেটাবলিক সিনড্রোমের যুগে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পরিমিত পরিমাণ জল খেতেই হবে।
✔ জল মুখের ভেতর লালা নিঃসরণে সাহায্য করে, যা খাদ্য গলাধঃকরণে বিশেষভাবে সাহায্য করে। খাদ্য পরিপাকের প্রথম ধাপ খাদ্য সরলীকরণ থেকে শেষ ধাপ পর্যন্ত জলের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া শরীরের জন্য বিশেষ উপকারি ভিটামিন ‘এ’, ‘ডি’, ‘ই’ ও ‘কে’ এবং কিছু মিনারেল জলে দ্রবীভূত হওয়ার পর তবেই হজম হয়।
✔ গবেষণায় উঠে এসেছে, জল ক্লান্তি দূর করে, মেজাজ ভালো রাখে এবং কাজে মনোঃসংযোগ বাড়ায়। মাথাব্যথা হলে জল পান করলে খানিক উপশম মেলে।
✔ বাইরে বেরোনোর সময় অবশ্যই সঙ্গে জল রাখুন। তেষ্টা মেটাতে জলের বিকল্প নেই।
✔ তবে মিনিটে মিনিটে বা ঘণ্টায় ঘণ্টায় অ্যাকোয়াহোলিকদের মতো জল খেলে কিডনির ওপর চাপ বাড়বে, রক্তে সোডিয়াম কমবে, শরীরের বিভিন্ন অংশে জল জমবে, স্বভাব হবে মিটখিটে, হবে না ঘুম, করবে মাথাব্যথা। তাই একদম কম খাওয়া বা অতিরিক্ত জল না খেয়ে পরিমিত পরিমাণ জল খান এবং শরীরকে ফিট রাখুন।
সব ছবি: আন্তর্জাল
নিবন্ধটি শুধুমাত্র সচেতনতার জন্য
কোনও ডাক্তারি পরামর্শ নয়
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments