আজ ১১ জুলাই। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। এবারের থিম— ‘লিঙ্গ সমতাই শক্তি: নারী ও কন্যাশিশুর মুক্ত উচ্চারণে বিশ্বের অবারিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হোক’
এই হারে জনসংখ্যা বেড়ে চললে
খাদ্যসঙ্কট অবশ্যম্ভাবী
প্রীতিময় রায়বর্মন
১৯৮৯ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের উন্নয়ন কর্মসূচির তৎকালীন গভর্নিং কাউন্সিল ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ঠিক হয় প্রতিবছর ১১ জুলাই পালিত হবে ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’। ১৯৮৯ সালের ১১ জুলাই বিশ্বের জনসংখ্যা পৌঁছয় ৫০০ কোটিতে। দিনটি পালনের লক্ষ্য বিশ্ব জনসংখ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের উপর সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সঠিক পরিবার পরিকল্পনা, লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা, মাতৃস্বাস্থ্য এবং মানবাধিকারের মতো বিষয়ে মানুষকে আরও সচেতন করে তোলা।
বিশ্বব্যাঙ্কের ‘বিশ্ব জনসংখ্যা প্রতিবেদন–২০২১’ অনুযায়ী ২০২১–এ বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭৮৭ কোটি ৫০ লাখ। ইউনাইটেড নেশনস পপুলেশন ফান্ড (ইউএনএফপিএ)–এর ১৫ এপ্রিল প্রকাশিত ‘বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ২০২৩’–এর বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা পৌঁছেছে ৮০০ কোটি ৪৫ লাখে। এপ্রিলে ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১৪২ কোটি ৮৬ লাখ, অন্যদিকে চীনের ১৪২ কোটি ৫৭ লাখ। এই দুই দেশে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩৫% মানুষের বাস। ভারত এবং চীন দুই দেশই জনসংখ্যাই টেক্কা দিয়েছে সমগ্র ইউরোপ (প্রায় ৭৪ কোটি ৪০ লাখ), আমেরিকার দুই মহাদেশ (প্রায় ১০০ কোটি ৪০ লাখ) এবং সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশের (প্রায় ১২৪ কোটি ৭০ লাখ) জনসংখ্যাকে।
১৮০৪ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৭৭০ কোটি। রাষ্ট্রসংঘের ‘ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল অ্যাফেয়ার্স’–এর অনুমান এইভাবে জনবিস্ফোরণ হতে থাকলে ২০৩০ সালে ৮৫০ কোটি, ২০৫০ সালে ৯৭০ কোটি এবং ২১০০ সালে ১০৯০ কোটিতে পৌঁছতে পারে বিশ্ব জনসংখ্যা। ২০৫০ সালের মধ্যে বৃদ্ধি পাওয়া জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি জন্মহার হবে ৯টি দেশে— ভারত, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, কঙ্গো, ইথিওপিয়া, তানজানিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিশর এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের দেশগুলিকে বেশি, মাঝারি এবং কম জন্মহার— এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহর টোকিও। তারপর একে একে রয়েছে দিল্লি ও সাংহাই। আর বিশ্বের সবচেয়ে কম জনবহুল ভ্যাটিকান সিটি। জনসংখ্যা হাজারেরও কম।
ভারতে সবচেয়ে বেশি মানুষের বাস উত্তরপ্রদেশ। প্রায় ২৩ কোটি ৩২ লক্ষ। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১০ কোটি এবং সবচেয়ে কম জনসংখ্যা সিকিমে, ৬ লক্ষ ৮৩ হাজার। ভারতের জনপরিসংখ্যান অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ। ২০৫০ সাল নাগাদ ভারতের জনসংখ্যা ১৬০ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। যদিও ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৪১ শতাংশ, যা বিশ্বে ৯৩তম। ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য অনেকেই দায়ী করেন মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে। তাদের মতে, কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে হলে দেশের জন্মহার বাড়ে। ঝাড়খণ্ড, বিহার, রাজস্থানের মতো কিছু রাজ্যে ৩০ শতাংশের কাছাকাছি মেয়ের বিয়ে ১৮ বছরের আগেই হয়ে যায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির আরও একটি কারণ আমাদের দেশে কম পড়াশোনা জানা বা নিরক্ষর দরিদ্র পরিবারের মানুষজন মনে করেন, পরিবারে বেশি সন্তান থাকলে বেশি শ্রমের মাধ্যমে অনেক বেশি অর্থ উপার্জন করা যাবে!
প্রথিতযশা ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস বলেছিলেন, স্বাভাবিক নিয়মে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খাদ্যসঙ্কট এমনকী দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভাবী। এই কারণে ম্যালথাস মনে করতেন দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। জন্মনিয়ন্ত্রণ করা না গেলে দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষের মৃত্যু হবে এবং এইভাবেই জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। তিনি আরও বলেছেন, জনসংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে গিয়ে এক সময় খাদ্য উৎপাদনের গাণিতিক হারকে ছাড়িয়ে যাবে। থ্যালামাসের এই তত্ত্বের পক্ষে–বিপক্ষে নানা মতবাদ থাকলেও, এটা সত্যি জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আজ বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা অনেকাংশেই বিঘ্নিত। বর্তমান বিশ্বের প্রতি ৭ জন মানুষের মধ্যে ১ জন তার চাহিদা অনুযায়ী খাবার পান না। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ধারণা, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্ববাসীর খাদ্যের চাহিদা পূরণে হয়তো ৭০ শতাংশ বেশি খাদ্য উৎপাদন করতে হবে! জনসংখ্যা বৃদ্ধি এই হারে চললে খাদ্যসঙ্কট যে অবশ্যম্ভাবী, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে শুধুমাত্র খাদ্য নয়, মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা দেশের রোজকার জীবনযাত্রার মানেও বিঘ্ন ঘটায়। উন্নয়নশীল দেশে জনসংখ্যার বৃদ্ধি দেশের সীমিত সম্পদে চাপ সৃষ্টি করে। ফলে মানুষ স্বাভাবিক বা নূন্যতম চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত হয়। দেশে বাড়ে অপুষ্টিজনিত অসুখে আক্রান্তের সংখ্যা। দেখা দেয় অশিক্ষা, বেকারত্ব, দারিদ্র্য। আর যার ফল অপরাধ, দুনীর্তির বাড়বাড়ন্ত। সমাজকে গ্রাস করে মাদকাসক্তি। জনগণ ভোগে নিরাপত্তাহীনতায়। পরিবেশ থেকে কর্মসংস্থান, শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য পরিষেবা সবেতেই দেখা দেয় বেহাল দশা।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে অনেক দেশই জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতি চালু করেছে। যেমন জন্মহার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমাতে ১৯৭৯ সালে চীনে চালু হয় ‘এক সন্তান নীতি’। নীতি লঙ্ঘনকারীদের দেওয়া হতো কঠিন শাস্তি। এতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করা গেলেও, প্রায় তিন দশক পর দেখা গেল তরুণদের তুলনায় প্রবীণদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ফলস্বরূপ কমেছে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা। ফলে বোঝাই যাচ্ছে জন্মনিয়ন্ত্রণ নীতিরও খারাপ দিক রয়েছে। বিতর্কিত নীতি পরিবর্তনের চাপ যেমন বাড়ছিল, তেমনই বাস্তব পরিস্থিতি বাধ্য করেছিল এই নীতি পরিবর্তনের।
জন্মনিয়ন্ত্রণে দরকার মানুষের সচেতনতা এবং পরিকল্পিত ছোট পরিবার। তবে সেই সচেতনতার হার যে একেবারে তলানিতে তা বলে দিচ্ছে বিশ্বের জনবিস্ফোরণের চিত্র।
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments