আজ ৩১ মে। ওয়ার্ল্ড নো টোবাকো ডে
ধূমপানের ‘সুখটান’কে
বলুন ‘বাই বাই’
প্রীতিময় রায়বর্মন
তামাকজাত দ্রব্য থেকে শরীরের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়, এটা নতুন করে বলার কিছু নেই। সবাই জানেন। তবুও এর আকর্ষণ অনেকেই এড়াতে পারেন না। সব জেনেও অবলীলায় চলে তার ‘সুখটান’। আর এতে শ্বাসযন্ত্রের দফারফা। সমস্যা দেখা দেয় হার্টে। শরীরে বাসা বাঁধে ক্যান্সারের মতো মারণ ব্যাধি। এর পাশাপাশি অতিমারির সময় চিকিৎসাবিজ্ঞান খুঁজে পেল কোভিড–১৯–এর সঙ্গে ধূমপানের সম্পর্ক। কারণ ধূমপানে ফুসফুস ও শ্বাসনালীতে থাকা এসিই–২ রিসেপ্টরের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। আর এই এসিই–২ রিসেপ্টরকে সরাসরি আক্রমণ করে করোনা ভাইরাস। ফলে ফুসফুস, হার্ট ও শরীরে অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি একজন ধূমপায়ীর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও অনেকটাই বেশি। এত সব জেনেও অনেকেই বেরতে পারেন না তামাকের নেশার কালো জ্বাল ছিঁড়ে!
কেন ওয়ার্ল্ড নো টোবাকো ডে?
ওয়ার্ল্ড নো টোবাকো ডে বা বিশ্ব তামাক–মুক্ত দিবস প্রতি বছর ৩১ মে পালন করা হয়। দিনটি পালনের উদ্দেশ্য— তামাকের ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা ও তামাক সেবন থেকে বিরত করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)–র উদ্দ্যোগে ১৯৮৭ সাল থেকে এই দিনটি পালিত হয়ে আসছে। তামাকজাত পদার্থ প্রতি বছর কাড়ছে ৮ মিলিয়ন মানুষের প্রাণ। শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ ধূমপানই নয়, পরোক্ষ ধূমপানেও প্রতি বছর মারা যান প্রায় ১ মিলিয়ন মানুষ। বিশ্বের তামাকজনিত মৃত্যুর প্রায় ১/৬ হয় আমাদের দেশে। বিশ্বব্যাপী তামাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রাহক ভারতবর্ষ। দেশে তামাক আসক্তের সংখ্যা প্রায় ২৬.৭ কোটি।
তামাকের প্রতি আসক্তির সূত্রপাত কীভাবে?
একটা সময় যা ব্যবহার হত ওষুধ হিসেবে। পরে তা হয়ে গেল নেশার বস্তু! বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে খ্রিস্টের জন্মের ৬ হাজার বছর আগে তামাক গাছের জন্ম। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষজন দাঁতের ব্যথা উপশমে বা কেটে–ছিঁড়ে গেলে তামাক পাতা ব্যবহার করতেন। আর এই তামাক পাতা থেকে নেশার জন্ম ১৫৮৮ সালে ভার্জেনিয়ার টমাস হ্যারিয়েটের হাত ধরে। তিনি তামাক পাতা পুড়িয়ে সেই ধোঁয়া টেনে নেশার সূত্রপাত করেন। এবং এই ধোয়াই তাঁকে ঠেলে দেয় মৃত্যুর দিকে। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। তখন ধূমপান ছিল পুরুষত্বের প্রতীক। স্বর্ণমুদ্রার পরিবর্তে একটা সময় তামাক পাতা দিয়েও চলত কেনাবেচা। ১৯০২ সালে এল সিগারেট কোম্পানি মার্লবোরো ব্র্যান্ড। এর পরেই সিগারেটের পাশাপাশি বিশ্বে ছড়াল চুরুট, পাইপ, বিড়ির মতো তামাকজাত নেশার বস্তু।
তামাকে ক্ষতির অন্ত নেই...
❖ ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি)-এর প্রধান কারণ ধূমপান। ধূমপানের সুখটানের সঙ্গে শরীরে ঢোকে বিষাক্ত সব পদার্থ। যেটাকে বলা হয় ব্রঙ্কিয়াল হাইপার রি-অ্যাক্টিভিটি। যা ব্রঙ্কিয়াসগুলোকে আঘাত করলে তাদের ভেতর থেকে সাধারণের চেয়ে বেশি মিউকাস নিঃসরণ হয় এবং ওই জায়গাটা ক্রনিক ইরিটেশনের পর্যায়ে চলে যায়। এর ফলে ওখানে ক্রনিক ইনফ্লামেশন বা প্রদাহের সৃষ্টি হয়। একদিকে প্রদাহ আর অন্যদিকে মিউকাস নিঃসরণ— দুয়ের জাঁতাকলে শ্বাসনালি আস্তে আস্তে সরু হতে শুরু করে। ১০০ জন ধূমপায়ীর মধ্যে ২০ জন সিওপিডি-তে আক্রান্ত হন। ৮০–৯০% রোগীর ধূমপানের ইতিহাস থাকে। এ ছাড়া পরোক্ষ ধূমপান থেকেও সিওপিডি হতে পারে।
❖ সিওপিডি ছাড়াও তামাকের বিষবাষ্প শ্বাসনালীর ওপরের আবরণকে তছনছ করে দেয়। কমে যায় শ্বাসযন্ত্রের কার্যক্ষমতা। দেখা দেয় শ্বাসনালীতে ঘন ঘন সংক্রমণ। নিউমোনিয়া ও ইনফ্লুয়েঞ্জা বারবার হানা দেয় শরীরে।
❖ তামাক পোড়া ধোঁয়ায় থাকা ক্ষতিকর রাসায়ানিক পদার্থ মস্তিষ্কেরও ক্ষতি হয়। মস্তিষ্কের বাইরের দিকের স্তর কর্টেক্স (গ্রে ম্যাটার) ক্ষয় পেতে শুরু করে। ফলে দেখা দেয় বিভিন্ন মানসিক সমস্যা।
❖ কার্বন–মনোক্সাইড, ক্যাডমিয়াম, হাইড্রোজেন সায়ানাইডের মতো নানা ক্ষতিকর সব জিনিস বিড়ি, সিগারেটের ধোয়ার সঙ্গে শরীরে ঢোকে। আর এগুলো শরীরে প্রবেশের অর্থ ক্যান্সারের মতো মারণব্যাধিকে ডেকে আনা।
❖ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপানে কমে পুরুষদের স্পার্ম কাউন্ট। এমনকী শুক্রাণু বিকৃত হয়ে যায়। দেখা দিতে পারে পুরুষত্বহীনতা।
❖ মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রেগন্যান্সিতে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে তামাক পোড়া ধোয়া। মাসিক বা পিরিয়ডে সমস্যা দেখা দিতে পারে। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই এসে যেতে পারে মেনোপজ। মহিলাদের বিভিন্ন ক্যান্সারের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ।
❖ তামাকের নেশায় বাড়ে রক্তচাপ ও হার্ট রেট। দেখা দেয় রক্তনালী সঙ্কোচনের সম্ভাবনা। রক্তে কমে অক্সিজেন। ধূমপান রক্ত জমাট বাঁধার পরিবেশ তৈরি করে। ফলে হার্ট অ্যাটাক বা মস্তিষ্কের কোনো সমস্যার সম্ভাবনা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
❖ চোখের নানা সমস্যার পাশাপাশি ধূমপানের কারণে একজন দৃষ্টিশক্তি পর্যন্ত হারাতে পারেন।
❖ তামাক পোড়া ধোয়ায় নষ্ট হতে পারে ঘ্রাণশক্তি।
❖ দাঁতের সমস্যাকে ডেকে আনে ধূমপান।
❖ তামাকে থাকা বিভিন্ন রাসায়নিক ত্বকের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এমনিতেই তামাক ফুসফুসে থাকা কোলাজেন ও ইলাস্টিনকে নষ্ট করতে সক্ষম। ক্ষতি করে ধমনীরও। রক্তবাহী নালীর ইলাস্টিন নষ্ট হওয়ায় ত্বক হয়ে যায় ধূসর এবং দেখা দিতে থাকে বলিরেখাও।
❖ আগেই বলেছি, আবারও বলছি ধূমপানে বাড়ে করোনায় আক্রান্তের সম্ভাবনা। কারণ ধূমপানে ফুসফুস ও শ্বাসনালীতে থাকা এসিই-২ রিসেপ্টরের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। আর এই এসিই-২ রিসেপ্টরকে সরাসরি আক্রমণ করে নোভেল করোনা ভাইরাস। ফলে একজন ধূমপায়ীর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও অনেকটাই বেশি।
তামাক সেবনে এত ক্ষতি জানার পরও কি ইচ্ছা করছে তামাকজাত দ্রব্যের বিষবাষ্প টানতে? আজই ছাড়ুন তামাকের নেশা। এতে শরীর যেমন অনেক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচবে, তেমনই ফিরে পাবেন জীবনের চলার ছন্দ। শুধু নিজের জন্য নয়, আপনার পাশের লোকটি, আপনার আত্মীয়-পরিবার সবার স্বার্থে ছাড়ুর ধূমপানের সুখটান। কারণ আমরা জানি ধূমপান শুধুমাত্র ধূমপায়ীরই ক্ষতি করে না, পাশে যিনি ধূমপান করছেন না তারও ক্ষতি করে ধূমপানের বিষবাষ্প।
ছবি সৌজন্যে আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments