আজ ১৭ মে। ওয়ার্ল্ড হাইপারটেনশন ডে বা বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবস। উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা এখন ঘরে ঘরে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে আমাদের মনে আঁকিবুকি কাটে নানা প্রশ্ন। উচ্চ রক্তচাপ মানেই কি নুন খাওয়া পুরোপুরি বন্ধ? একবার ওষুধ খাওয়া শুরু করলে সারাজীবন খেয়ে যেতে হবে? রক্তচাপ বাড়ার পেছনে স্ট্রেসের ইন্ধন কতটা? চলুন আজ খুঁজে নিই এইরকমই আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর
৩০ পেরোলেই নিয়মিত রক্তচাপ মাপুন
ডাঃ সায়ন চট্টরাজ
সদস্য, ইউরোপিয়ান সোসাইটি অফ হাইপারটেনশন; লাইফ মেম্বার, আরএসএসডিআই; প্রফেসনাল মেম্বার, আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন; কনসালট্যান্ট স্পেশ্যালিস্ট ফিজিশিয়ান, নেহরু মেমোরিয়াল টেকনো গ্লোবাল হসপিটাল, ব্যারাকপুর; লাইফ মেম্বার, ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন
দিনটি পালনের উদ্দেশ্য কী?
ডাঃ চট্টরাজ: হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ এখন বিশ্বব্যাপী খুব সাধারণ এক অসুখ। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৬% এবং ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ২৯.৮% এই অসুখে আক্রান্ত। জেনে বা না জেনে বিশ্বের বহু মানুষই আজ উচ্চ রক্তচাপের শিকার। অনেকেই আছেন যাঁদের রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি, অথচ তাঁরা নিজেরাই তা জানেন না! এই রকম আন-ডায়াগনোসড রোগীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। ডায়াগনোসড হাইপারটেনশন দু’রমক— এসেনশিয়াল বা প্রাইমারি হাইপারটেনশন, যা সিংহভাগ উচ্চ রক্তচাপ রোগীর মধ্যে দেখা যায়, এবং সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন, যা তুলনামূলকভাবে বিরল। উচ্চ রক্তচাপ আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ অসুখ বলে মনে হলেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবগুলো কিন্তু মারাত্মক। উচ্চ রক্তচাপের কারণে কার্ডিওভাস্কুলার এবং সেরিব্রোভাস্কুলার ডিজিজ, যেমন স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেলিওর ইত্যাদিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ কিডনির বৈকল্য বা ক্রনিক কিডনি ডিজিজ, রেটিনার সমস্যা, ডিমেনশিয়া, মেটাবলিক সিনড্রোম ইত্যাদি গুরুতর অসুখ সৃষ্টি করতে পারে। তাই উচ্চ রক্তচাপকে উপেক্ষা করাটা বোকামির। এই দিনটি পালনের উদ্দেশ্য উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা, যেমন সঠিক সময় রোগ নির্ণয়, সঠিক চিকিৎসা এবং যাঁরা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত তাঁদের নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপে থাকা।
এসেনশিয়াল এবং সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন কী?
ডাঃ চট্টরাজ: এসেনশিয়াল হাইপারটেনশন হল যেখানে উচ্চ রক্তচাপের অন্য কোনো কারণ থাকে না, যেটা হয় মূলত বংশগত, বয়সজনিত তথা জিবনশৈলি-জাত কারণে। তার মধ্যে ধূমপান, মদ্যপান, স্থূলতা বা ওবেসিটি, অতিরিক্ত লবণ/নুন খাওয়া, খাবারের মধ্যে পটাসিয়াম ও ক্যালসিয়ামের অভাব গুরত্বপূর্ণ কারণ হিসাবে চিহ্নিত। বয়সকালে ধমনী বা আর্টারিতে চর্বিজাতীয় বা অ্যাথেরোস্ক্লেরোটিক পদার্থ জমলে আর্টারি স্টিফ বা শক্ত হয়ে যায়, তার সঙ্গে আবার অনেক সময় আর্টারিতে ক্যালসিয়াম জাতীয় পদার্থ জমেও (ক্যালসিফিকেশন) আর্টারি শক্ত হয়ে যায়। এর ফলে বাড়ে রক্তচাপ। চিকিৎসার পরিভাষায় একেই বলে এসেনশিয়াল হাইপারটেনশন। অন্যদিকে সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন হল অন্য কোনো কারণে রক্তচাপ বৃদ্ধি। যেমন ক্রনিক কিডনির অসুখ বা কিডনির শিরার সমস্যা, বাচ্চাদের নেফ্রোটিক সিনড্রোম, কিছু ওষুধ যেমন স্টেরয়েড, ব্যথার ওষুধ, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি (ওরাল কন্ট্রাসেপটিভ পিল) জাতীয় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, কিছু মেটাবলিক ও এন্ডোক্রিন সমস্যা যেমন কুশিং সিনড্রোম (অ্যাড্রিনাল গ্ল্যান্ডের অসুখ), অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপনিয়া ইত্যাদি অসুখের কারণে রক্তচাপ বাড়তে পারে। একেই বলে সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন। সেকেন্ডারির তুলনায় এসেনশিয়াল হাইপারটেনশনে আক্রান্তের সংখ্যাই বেশি।
উচ্চ রক্তচাপের জন্য আধুনিক জীবনযাপন, স্ট্রেস এগুলো কতটা দায়ী?
ডাঃ চট্টরাজ: রক্তচাপ বৃদ্ধির জন্য অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুড অনেককাংশেই দায়ী। এখন আমাদের মধ্যে বেড়েছে অত্যধিক নুন খাওয়ার প্রবণতা— যেটা ভিজিবল সল্টও হতে পারে আবার ইনভিজিবল সল্টও হতে পারে। ইনভিজিবল অর্থাৎ খাবার পাতে আলাদা করে নুন না খাওয়া, কিন্তু যে খাবারটা খাচ্ছি তাতে নুন বা সোডিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকা। যেমন প্রসেসড মিট (সালামি, সসেজ ইত্যাদি), অন্যান্য প্রসেসড ফুড (বিস্কুট, সস, চাটনি)— এগুলোতে সোডিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে। এ ধরনের খাবার খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে, আর কমছে সবুজ শাকসবজি, ফল, মাছ ইত্যাদি খাওয়ার প্রবণতা। ফলে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ছে। এ ছাড়া ওবেসিটি উচ্চ রক্তচাপের অন্যতম প্রধান রিস্ক ফ্যাক্টর। ওবেসিটির কারণে সৃষ্টি হয় মেটাবলিক সিনড্রোম, স্লিপ অ্যাপনিয়া, ডায়াবেটিস ও রক্তে চর্বির মাত্রা বৃদ্ধি বা ডিসলিপিডিমিয়ার মতো অসুখ। এই মেটাবলিক অসুখগুলো যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলেও রক্তচাপ বাড়তে পারে। স্ট্রেস থেকেও রক্তচাপ বাড়ে। বর্তমান সময়ের কর্পোরেট লাইফস্টাইলের (‘ক্লাস এ’ লাইফস্টাইল) কারণে অনেক সময়ই আমরা মানসিক ও শারীরিক স্ট্রেসে ভুগি। এই স্ট্রেস হাইপারটেনশনের অন্যতম একটি কারণ। আমাদের শরীরে কিছু হরমোন বা কেমিক্যাল থাকে, যেগুলোকে বলে ক্যাটেকোলামাইন। স্ট্রেস যত বাড়ে এই ক্যাটেকোলামাইন নিঃসরণ তত বাড়তে থাকে এবং এর প্রভাবে সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম অ্যাক্টিভেট হতে থাকে, যার অন্যতম ফল রক্তচাপ, নাড়ির গতি বা হার্টরেট বৃদ্ধি। .
নুন খাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করা— কতটা যুক্তিসঙ্গত?
ডাঃ চট্টরাজ: এটা যুক্তিসঙ্গত নয়। প্রতিদিন নুন খাওয়ার নির্দিষ্ট পরিমাপ আছে। বিভিন্ন গাইডলাইনে বিভিন্নধরনের পরিমাপের কথা বলা হয়েছে। যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র গাইডলাইনে বলা হয়েছে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৫ গ্রাম পর্যন্ত নুন খাওয়া যেতে পারে। আবার আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন বলছে প্রতিদিন ২ থেকে আড়াই গ্রাম নুনই যথেষ্ট (গড়ে ২৩০০ মিলিগ্রাম)। নুন খাওয়া পুরোপুরি বন্ধ করাটাও কিন্তু ঠিক নয়। কারণ নুনের মধ্যে সোডিয়াম ছাড়াও পটাশিয়াম থাকে। যাঁর কিডনিতে কোনো বড় সমস্যা নেই, তাঁর শরীরে পটাশিয়াম খুবই প্রয়োজনীয়। পটাশিয়াম হার্ট অর্থাৎ কার্ডিওভাস্কুলার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি। তাই নুন পুরোপুরি বাদ দিলে শরীরে পটাশিয়ামের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। যদিও নুন ছাড়া ফল, ডাবের জল ইত্যাদিতেও পটাশিয়াম রয়েছে। পটাশিয়ামের পাশাপাশি শরীরের সুস্থতায় সোডিয়ামও জরুরি। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, রক্তের ঘনত্ব বা অসমোলালিটি নিয়ন্ত্রণে সোডিয়ামের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রয়েছে। সুতরাং, সোডিয়াম ফ্রি ডায়েট বাস্তবে একেবারেই অসম্ভব। নুন খান কিন্তু পরিমিত পরিমাণে। নির্ধারিত সীমার মধ্যেই নুনের পরিমাণকে আটকে রাখুন। খাবারে স্বাদের জন্য পরিমিত পরিমাণ নুন দিন, কিন্তু খাবার পাতে বাড়তি নুন খাবেন না। যাঁরা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত নন, তাঁরাও এটা মেনে চলুন।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ খাওয়া একবার শুরু করলে সারাজীবনই কি সেটা খেয়ে যেতে হবে?
ডাঃ চট্টরাজ: হাইপারটেনশন হল ক্রনিক অসুখ। এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, কিন্তু সম্পূর্ণ নির্মূল করা অসম্ভব। ক্রনিক অসুখে ওষুধ খেতেই হবে, তবেই রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। লাইফস্টাইল মডিফিকেশন, ডায়েট— এগুলো করে একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, কিন্তু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের জন্য ওষুধ জরুরি। ১০০ জন রোগীর মধ্যে ৯০ জনকেই সারাজীবন ওষুধ খেতে হয়। রক্তচাপ বাড়লে সমস্যা অনেক। তাই একটা ওষুধ খেয়ে যদি হার্ট অ্যাটাক, হার্ট ফেলিওর, স্ট্রোক বা কিডনি ফেইলিওরের মতো প্রাণঘাতী অসুখের ঝুঁকি কমাতে পারি, তাহলে মন্দ কী।
রক্তচাপ বাড়লে কি কোনো উপসর্গ দেখা দেয়?
ডাঃ চট্টরাজ: রক্তচাপ খুব বেশি মাত্রায় না বাড়লে সাধারণত খুব একটা উপসর্গ দেখা দেয় না। সেই কারণে চিকিৎসক হিসেবে আমার পরামর্শ আপনার বয়স ৩০ পেরোলে এবং যদি কো-মর্বিডিটি থাকে বা পরিবারে যদি অ্যাথেরোস্ক্লেরোটিক কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজের ইতিহাস থাকে তাহলে ১৮ বছরের পর থেকেই নিয়মিত স্ক্রিনিং দরকার। স্ক্রিনিং অর্থাৎ নিয়মিত রক্তচাপ মাপা, মেটাবলিক প্যারামিটার চেকআপ ইত্যাদি। সাধারণত রক্তচাপ বৃদ্ধির কোনো লক্ষণ দেখা না গেলেও রক্তচাপ খুব দ্রুত মারাত্মক বেড়ে গেলে কারও মাথা-ঘাড়ে ব্যথা, বমি, মাথা ঘোরা, দৃষ্টির সমস্যা, প্যালপিটিশন (বুক ধড়ফড়), এমনকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সাঙ্ঘাতিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে। একে বলে হাইপারটেনসিভ ইমার্জেন্সি।
যিনি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত বা যিনি নন তাঁর লাইফস্টাইল কেমন হওয়া উচিত?
ডাঃ চট্টরাজ: যিনি উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত তাঁকে নুন খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। মেনে চলতে হবে ড্যাশ (Dietary Approaches to Stop Hypertension) ডায়েট। ড্যাশ ডায়েটে নুন খাওয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নির্দিষ্ট পরিমাণে ফলমূল, শাকসবজি, মাছ খাওয়ার কথা বলা হয়েছে। ড্যাশ ডায়েটে খাবারে তেলের ব্যবহার কমানো, স্যাচুরেটেড ফ্যাট (ঘি, মাঘন) ও বাড়তি শর্করাজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তার সঙ্গে খাবারে পটাসিয়াম ও ক্যালসিয়াম পর্যাপ্ত খেতে বলা হয়েছে। ডায়েটের পাশাপাশি দরকার পর্যাপ্ত ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি। যেমন সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন ৩০-৪৫ মিনিট দ্রুত হাঁটা, ফ্রিহ্যান্ড বা অ্যারোবিক এক্সারসাইজ। যাঁর পক্ষে সম্ভব তিনি সুইমিং এবং সাইক্লিংও করতে পারেন। অর্থাৎ অ্যাক্টিভ এবং হেলদি লাইফস্টাইল মেনে চলা ভীষণ জরুরি। উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে যদি কোনো কো-মর্বিডিটি থাকে, যেমন ডায়াবেটিস, লিপিডের বা কোলেস্টেরোলের সমস্যা, হাইপোথাইরয়েডিজম ইত্যাদি, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শমতো এইসব অসুখের ওষুধ খেতে হবে এবং নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে হবে এগুলো নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা। অপরদিকে যাঁর উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা নেই তাঁকেও স্যাচুরেটেড ফ্যাট আছে এমন খাবার, নুন মাত্রাতিরিক্ত খাওয়া চলবে না। এড়িয়ে চলতে হবে প্রসেসড মিট বা ফুড। খেতে হবে পরিমিত পরিমাণ জল। এড়িয়ে চলতে হবে ধূমপান ও মদ্যপান এবং সেডেনটারি জীবনযাত্রা। আর অবশ্যই বজায় রাখতে হবে ফিজিক্যাল ফিটনেস। আগেই বলেছি হাইপারটেনশনের অন্যতম রিস্ক ফ্যাক্টর ওবেসিটি। তাই যিনি উচ্চ রক্তচাপের শিকার বা যিনি নন, উভয়ই যদি ওবেসিটিতে আক্রান্ত হন, তাহলে হেলদি ডায়েট এবং শরীরচর্চার মাধ্যমে শরীরের বাড়তি মেদ ঝরাতে হবে।
সাক্ষাৎকার: প্রীতিময় রায়বর্মন
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments