বসন্তের অসুখ
প্রীতিময় রায়বর্মন

উপভোগের দিন শেষ। শীতের মিষ্টি আমেজ পাকাপাকিভাবে নিয়েছে বিদায়। হাজির শীত আর গ্রীষ্মের মাঝে মেলবন্ধন ঘটানো বসন্ত। ভোরের দিকে একটু ঠান্ডা ভাব, কমিয়ে দিতে হয় ফ্যানের স্পিডটা বা রিমোট হাতে নিয়ে বন্ধ করে দিতে হয় এসি–টা। যদিও ভোরের এই উষ্ণতার পারদ নেমে যাওয়াটা একেবারেই ক্ষণস্থায়ী। ঘড়ির কাটা যত বেলার দিকে এগোয় তাপমাত্রার পারদটাও চড়চড় করে বাড়তে থাকে। হাঁসফাঁস না হলেও বেশ ভালোই গরম লাগে। আবহাওয়ার এই রকমফের আমাদের শরীরের ওপর ফেলে এক বিরূপ প্রভাব। বিশেষত প্রবীণ আর বাচ্চাদের নানা সমস্যা দেখা দেয় এই সময়। আর যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি কম তাদেরও কম–বেশি ভুগতে হয়। ব্যাকটিরিয়া, ফাঙ্গাস, ভাইরাস ঘটিত রোগ-জীবাণুর বাড়বাড়ন্ত এই সময় একটু বেড়ে যায়। এর প্রধান কারণ তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার খামখেয়ালিপনা বা হঠাৎ পরিবর্তন।
ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো ভাইরাসাদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায় এই সময়ে। ভাইরাস ঘটিত জ্বর, সর্দি–কাশি, ব্রঙ্কো–নিউমোনিয়া, ল্যারিংজাইটিস ইত্যাদি দেখা দিলেও সবচেয়ে বেশি ভোগায় চিকেন পক্স বা জল বসন্ত এবং হাম।

চিকেন পক্স বা জল বসন্ত
প্রতিষেধক বা টিকা দিয়ে স্মল পক্স বা গুটি বসন্তর জীবাণুকে জব্দ করা গেলেও এখনো চিকেন পক্সের জীবাণুকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। এই রোগের ভাইরাস ভেরিসেলা জোষ্টারে বড়দের চেয়ে বেশি ভোগে বাড়ির খুদেরা। এপ্রিল থেকে জুন এর পিক আওয়ার। তবে এখন আগের থেকে অনেকটাই কমেছে এই অসুখে আক্রান্তের সংখ্যা। চিকেন পক্স যেহেতু ছোঁয়াচে তাই আমাদের সতর্ক থাকা দরকার।
উপসর্গ
❖ প্রথমে জ্বর এবং সঙ্গে শরীর ও পেট ব্যথা।
❖ এর দিন–দুয়েক পরে ত্বকে ছোটো ছোটো ফুসকুড়ি দেখা দেয়।
❖ এরপর ফুসকুড়িতে জল আসে এবং ৬–৭ দিন পর সেগুলো কালো হয়ে খসে যায়। আবার তখন শরীরের জন্য অংশে একইরকম ফুসকুড়ি দেখা।

জটিলতা
❖ চুলকানোর কারণে অনেক সময় নখের আঘাতে ত্বকে সংক্রমণ বা ঘা হতে পারে। স্ট্র্যােপটোকক্কাস জীবাণু বাসা বাঁধলে রিউম্যাটিক ফিভার পর্যন্ত হতে পারে।
❖ যাদের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের নিউমোনিয়া, ফুসফুসে সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। 
❖ দেখা দিতে পারে পেটের অসুখ।
❖ শ্বাসকষ্ট।
❖ এমনকি স্নায়ুতন্ত্রেও সমস্যা দেখা দিতে পারে।
❖ প্রেগন্যান্টদের ক্ষেত্রে এটা অনেক সময় মারাত্মক আকার নিতে পারে। 
❖ জন্মের ৫ দিনের মধ্যে এই অসুখ দেখা দিলে শিশুকে সুস্থ করে তোলা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

কী করবেন?
❖ চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ব্যথা ও জ্বরের ওষুধ খেতে পারেন।
❖ খুব বেশি চুলকালে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। বাড়ির পাশের ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ এনে নিজে ডাক্তারি না করাই ভাল।
❖ দরকার বাড়তি যত্নের।
❖ খেতে হবে প্রচুর পরিমাণ জল।
❖ প্রচলিত ধারণা, এ সময় নাকি আমিষ খেতে নেই। কিন্তু পক্স হলে শরীর খুব দুর্বল হয়ে যায়। তাই ও সব ভ্রান্ত ধারণায় না গিয়ে শরীরে যাতে পর্যাপ্ত প্রোটিন, ভিটামিন পৌঁছয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।
❖ খুব ভালো করে স্নান করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শে স্নানের জলে কোনো ভালো মানের অ্যান্টিসেপটিক লোশনও মেশানো যেতে পারে।
❖ পাতলা সুতির পোশাক ব্যবহার করুন।
❖ ত্বকের ফুসকুড়িতে যাতে কোনোভাবে নখের আচড় না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখুন। ওগুলো নির্দিষ্ট সময় পর নিজে নিজেই শুকিয়ে যায়।

প্রতিরোধ
❖ রোগ প্রতিরোধের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ মতো বাচ্চাকে টিকা দিন।
❖ এটি ছোঁয়াচে রোগ। আক্রান্তের কাশি-হাঁচি, এমনকি ত্বকের সংস্পর্শ থেকেও এ রোগ ছড়াতে পারে। যতদিন না সবকটি ফুসকুড়ি শুকোচ্ছে ততদিন রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাই প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতা

হাম
প্যারামাইক্সি ভাইরাসের কারণে হাম হয়। এই সময় রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলেও জুনের শেষ পর্যন্ত এই রোগের ভাইরাসের উপস্থিতি থেকে যায়। মূলত শিশুদেরই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। 
উপসর্গ
❖ জ্বর, সর্দি, কাশি, শরীর ম্যাজম্যাজ।
❖ চোখ, মুখ ফুলে ওঠে।
❖ চোখ লাল হয়ে জল পড়া।
❖ গায়ে খুব ছোট ছোট লালচে র্যা শ বা ফুসকুড়ি বেরনো এবং সেগুলো চুলকানো। যা খুব দ্রুত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
❖ খাওয়ার অরুচি। ফলে শরীর খুব দুর্বল হয়ে পড়ে।

জটিলতা
❖ অপুষ্টি
❖ ডায়রিয়া
❖ কানে সংক্রমণ ও প্রদাহ
❖ নিউমোনিয়া বা ফুসফুসে জীবাণু সংক্রমণ

কী করবেন?
❖ খুব ভালো করে স্নান করতে হবে এবং খুব নরম কিছু দিয়ে আস্তে আস্তে শরীর মোছা।
❖ থাকতে হবে পুরোপুরি বিশ্রামে। 
❖ প্রচুর পরিমাণে জল খেতে হবে।
❖ অনেক সময় জ্বরের সঙ্গে বমিও হয়। তখন চিকিৎসকের পরামর্শ মতো বমির ওষুধ খেতে হবে।
❖ শরীর খুব দুর্বল হয়ে পড়ে, তাই জন্য দরকার পুষ্টিকর খাবার, বেশি করে ফল খাওয়া।
❖ থাকতে হবে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন।
❖ মশারির মধ্যে থাকাটাই সবচেয়ে ভালো।

প্রতিরোধ
❖ চিকিৎসকের পরামর্শে সঠিক সময় ভ্যাকসিন বা টিকা নিলে হাম প্রতিরোধ করা সম্ভব।
❖ সাধারণত একবার হাম হলে দ্বিতীয়বার হাম হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তবুও আমাদের থাকতে হবে সতর্ক। 
❖ সঠিক চিকিৎসা আর নিয়ম মেনে চললে হাম সাধারণত দিন সাতেকের মধ্যে সেরে যায়। কখনই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া হাম আক্রান্তকে কোনোরকম ওষুধ খাওয়ানো বা নিজে ডাক্তারি না করাই ভালো। এতে রোগের জটিলতা আরও বাড়তে পারে। 
শরীরে রোগ বাসা বাঁধার আগে সতর্ক হলে অনেক জটিল রোগের মতো চিকেন পক্স ও হামকেও এড়ানো সম্ভব।

সব ছবি:‌ আন্তর্জাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *