চারদিক আলোকিত হোক
আলোর রোশনাইয়ে, বাজির নয়
প্রীতিময় রায়বর্মন
দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা কাটিয়ে জীবন যখন ছন্দে ফেরায় চেষ্টায়, তখনই চোখ রাঙাচ্ছে তৃতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা। দুর্গাপুজোয় আমাদের কিছু ‘বালখিল্য’ আচরণ নিম্নমুখী করোনা আক্রান্তের গ্রাফকে আবার ঊর্ধ্বমুখী করেছে। রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের দেওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে ৩ নভেম্বর, ২০২১ সন্ধে ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে করোনা আক্রন্তের সংখ্যা ৯১৯।
দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজোর পর এবার কালীপুজো বা দীপাবলি। আলোর উৎসব। বৈদ্যুতিন আলোর রোশনাইয়ের সঙ্গে এতকাল ধরে সঙ্গত দিয়ে আসছে আতস বা শব্দবাজি। কিন্তু করোনা অতিমারির সময় বাজির দূষণ সমস্যাকে আরও জটিল করতে পারে, এমনই মত চিকিৎসকদের।
করোনা সংক্রমণের সঙ্গে সরাসরি বায়ু দূষণের কোনো সম্পর্ক নেই, তবে পরোক্ষে ইন্ধন জোগানোর জন্য যথেষ্ট। আমরা জানি দূষণ রেসপিরেটরি ডিজিজ বা ফুসফুসের অসুখের অন্যতম প্রধান রিস্ক ফ্যাক্টর। দূষণ প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষের প্রাণ কাড়ছে। মূলত গাড়ির তেল পোড়া ধোঁয়াই এই দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। এর সঙ্গে প্রতিবছর কালীপুজোয় বাজির দূষণের ফলে বাতাসে বাড়ে সালফার–ডাই–অক্সাইড, নাইট্রোজেন–ডাই–অক্সাইডের মতো শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর বিষাক্ত সব পদার্থ। যা হার্ট, ফুসফুসকে বারোটা বাজানোর জন্য যথেষ্ট। একে করোনা অতিমারির কালো ছায়া, চলছে মরশুম বদল, এর মধ্যে যদি বাতাসে দূষণের পরিমাণ বাড়ে তাহলে সমস্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে একবার ভেবে দেখুন!
বাজি পোড়া ধোঁয়া কী কী বিপদ ডেকে আনতে পারে?
✶ যাঁরা হয়তো করোনায় মাইল্ড বা মৃদু সংক্রমণে আক্রান্ত হতেন, তাঁরা সিভিয়ার বা মারাত্মক সংক্রমণে আক্রান্ত হতে পারেন। ঠিক একইভাবে মৃদু নিউমোনিয়া জটিল আকার ধারণ করে পরিণত হতে পারে সিভিয়ার নিউমোনিয়ায়।
✶ যাঁরা করোনাকে হারিয়ে সুস্থ হয়েছেন, তাঁদের একটা বড় অংশের ফুসফুসে কোনও সমস্যা বা লাং ডিসঅ্যাবিলিটি দেখা দিয়েছে। যেমন লাং ফাইব্রোসিস, সামান্য পরিশ্রমেই হাপিয়ে ওঠা। এর মাঝে যদি বাতাসে দূষণের পরিমাণ বাড়ে তাহলে ওই মানুষগুলোর কী অবস্থা হবে বুঝতে পারছেন? অ্যাজমা অ্যাটাক হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। করোনা আক্রান্তের সেরে ওঠা বা পোস্ট রিকভারিতে প্রাণঘাতী সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে বাজির দূষণ।
✶ যাঁদের সিওপিডি-র মতো ক্রনিক ফুসফুসের অসুখ আছে, দূষণ বাড়লে মরশুম বদলের এই সময় তাঁদের সমস্যা আরও বাড়বে। দেখা দিতে পারে তীব্র শ্বাসকষ্ট। ক্রনিক ফুসফুসের অসুখে আক্রান্তরা যদি করোনা আক্রান্ত হন, তাহলে রোগের জটিলতা বাড়বে এবং অবস্থা খুবই সঙ্কটজনক হতে পারে।
✶ প্রতিবছরই কালীপুজোর পর বাড়ে অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের রোগীর সংখ্যা। অনেককেই ভর্তি হতে হয় হাসপাতালে। করোনা অতিমারির সময় শ্বাসকষ্ট হলে অনেক সময়ই বুঝতে সমস্যা হয় সেটা করোনা ভাইরাসের কারণে না ক্রনিক ফুসফুসের অসুখ না দূষণের বাড়বাড়ন্তের ফল। ফলে রোগীর সঠিক চিকিৎসা পেতে একটু হলেও দেরি হয়। কারণ প্রাথমিক চিকিৎসার পর রোগের সঠিক কারণ অনুসন্ধানে রোগ নির্ণায়ক পরীক্ষা করে তবেই আসল রোগের চিকিৎসা শুরু হয়। তাই পরিস্থিতিকে জটিল করতে না চাইলে বাজির পোড়ানো থেকে বিরত থাকুন।
✶ আমরা জানি, বাতাসে ফগ বা ধোয়া যত বেশি হবে ততই সাসপেন্ডেড পার্টিক্ল বা ভাসমান কণার বেশিক্ষণ ভেসে থাকার সম্ভাবনা বাড়বে। সে ক্ষেত্রে কারো হাঁচি বা কাশির মধ্যে যদি সাসপেন্ডেড পার্টিক্ল হিসেবে করোনা ভাইরাস থাকে, তাহলে তা অনেকক্ষণ বাতাসে ভাসমান অবস্থায় থেকে সংক্রমণ বাড়ানোকে ত্বরান্বিত করবে। যদিও এ নিয়ে কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য আমাদের হাতে নেই, তবুও এই দাবিকে একেবারে নস্যাৎ করা যায় না।
বাজি পোড়ানো যদি লাগামছাড়া হয়, তাহলে ফুসফুসের সমস্যা দেখা দেওয়া অবধারিত, যা এই অতিমারির সময় আমাদের ঠেলে দিতে পারে চরম বিপদের মুখে। তাই করজোড়ে ‘কালি কলম মনন’ পরিবারের পক্ষ থেকে সবার কাছে অনুরোধ— এই অতিমারির সময় দীপাবলিতে দূরে থাকুন বাজি পোড়ানো থেকে, বাজির রোশনি নয়, চারদিক আলোকিত হোক আলোর রোশনাইয়ে।
ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments