ব্যস্ত জীবনে নিত্যনতুন ভাবনার মাঝে যখন তখন মাথাচাড়া দেয় হেলদি ডায়েটের চিন্তা। কী করলে ডায়েট হবে আরও হেলদি, আরও কার্যকর, এমন ভাবতে ভাবতে আমরা পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিয়ে থাকি। হেলদি ডায়াটে ফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর তা যদি হয় ড্রাই ফ্রুট তাহলে তো কথাই নেই। পরিমাণে লাগে অল্প, কিন্তু উপকার হাজার রকম।

যে কোনও তাজা ফলের যতটুকু পুষ্টিমূল্য, শুকিয়ে নিলে সেই ফলেরই পুষ্টিগুণ হয়ে যায় অনেক বেশি। ১০০ গ্রাম কোনও তাজা ফলের ক্যালরিমূল্য ১০ থেকে ১৫ হলে, সেই ফলই শুকিয়ে গেলে সমপরিমাণের ক্যালরিমূল্য হয়ে যায় প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০। এক কথায় বলা যায়, পুষ্টির শক্তিঘর ড্রাই ফ্রুটস।



কী কী রয়েছে?‌
✦ ড্রাই ফ্রুটে রয়েছে ভাল পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট। সুগারের উপাদানও খুব বেশি এতে। কারণ তাজা ফলের থেকে শুকনো ফলের সুগার তুলনামূলক বেশি।
✦ ক্যালরি সমৃদ্ধ তো বটেই, ড্রাই ফ্রুটে থাকে প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিজ্জ প্রোটিনও। এই প্রোটিন প্রাণীজ প্রোটিনের মতো অত উৎকৃষ্ট না হলেও দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রোটিনের মধ্যে সেরা। নিরামিষাশীদের জন্য প্রোটিনের ভাল উৎস হতে পারে ড্রাই ফ্রুটস।
✦ এতে রয়েছে বেশ ভাল পরিমাণে ফ্যাট। ড্রাই ফ্রুটের ফ্যাটের মধ্যে মোনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণই বেশি। এই ফ্যাট আমাদের শরীরের জন্য ভীষণই ভাল। কারণ এর জন্য শরীরের ভাল কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস পায়। এই ফ্যাট ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমায়। এ ছাড়া এর থেকে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডও পাওয়া যায়। এই ফ্যাটি অ্যাসিড প্রদাহমূলক অসুখ রোধ করে। ‌হার্টের স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো।
✦ ড্রাই ফ্রুটে মেলে প্রচুর ভিটামিন ই। যা অ্যান্টি–‌‌অক্সিড্যান্ট হিসাবে কাজ করে। এজিং প্রবলেম দূরে রাখে। ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্যে ভীষণই ভালো। এ ছাড়া ড্রাই ফ্রুটে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফোলিক অ্যাসিড বা ফোলেট পাওয়া যায়। রয়েছে ভিটামিন বি।
✦ ড্রাই ফ্রুটে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, জিঙ্ক–‌‌সহ অন্যান্য খনিজ লবণ আছে।
✦ ফাইবারও রয়েছে ভরপুর।



 

উপকারিতা
✦ ড্রাই ফ্রুট খুবই ক্যালরিসমৃদ্ধ একটি খাবার। তাই সারাদিনে যাঁরা তেমন খাওয়ার সময় পান না বা অনিয়মিত খাওয়া–‌‌দাওয়ার শিকার, অথবা অপুষ্টিতে ভুগছেন তাঁদের জন্য ড্রাই ফ্রুটস সর্বশ্রেষ্ঠ বিকল্প।
✦ প্রচুর পরিমাণে মাইক্রো–‌‌ম্যাক্রো নিউট্রিয়েন্ট থাকায় বাড়ন্ত বাচ্চাদের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য ড্রাই ফ্রুট ভীষণ ভালো।
✦ ড্রাই ফ্রুটে দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রোটিন থাকলেও কেউ যদি প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে ড্রাই ফ্রুট গ্রহণ করেন, তাহলে তাঁর শরীরে প্রোটিনের অভাব হবে না।
✦ ড্রাই ফ্রুটের ‌ফ্যাট হৃদয়ের স্বাস্থ্যরক্ষা করে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। বাজে কোলেস্টেরল কমায়। ডায়বেটিস রোধ করে। এ ছাড়া এই ফ্যাট ওজন কমাতে সাহায্য করে। প্রুনস, অ্যাভোকাডোর নাম খুব বেশি শোনা যায় ওজন কমানোর জন্য। তবে এগুলি যথেষ্ট ক্যালরিসমৃদ্ধ, তাই বুঝে শুনে খাওয়াই ভাল।
✦ ড্রাই ফ্রুটে থাকা ভিটামিনগুলি বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে চমকপ্রদ। ভিটামিন ই ত্বক ও চুলের জন্য ভাল। এর অ্যান্টি এজিং এজেন্ট ত্বকের অকালে বুড়িয়ে যাওয়াকে দূরে রাখে। অ্যান্টি–‌‌অক্সিড্যান্ট শরীর থেকে দূষিত বিষাক্ত পদার্থগুলিকে বের করে দেয়। এতে থাকা অন্যান্য ভিটামিনগুলো হজম করতে ও বিপাকে সাহায্য করে। ফোলিক অ্যাসিড বা ফোলেট হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়িয়ে রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে।
✦ ড্রাই ফ্রুটের পটাশিয়াম বৃদ্ধি ও বিকাশে সাহায্য করে। সোডিয়াম শারীরবৃত্তীয় কাজগুলিকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। ক্যালসিয়াম হাড়ের গঠনে সাহায্য করে ও হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো করে। অস্টিওম্যালেশিয়া, অস্টিওপোরোসিস রোধ করে। তাই বাচ্চা ও বয়স্কদের জন্যতো বটেই, গর্ভবতী মহিলাদের জন্যও ক্যালসিয়াম দারুণ কাজের।


✦ ড্রাই ফ্রুটের ফাইবারে রয়েছে প্রি বায়োটিক এজেন্ট। আমাদের শরীরে এক প্রকারের ভালো প্রো–‌‌বায়োটিক ব্যাকটিরিয়া থাকে, যা দেহের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজে সাহায্য করে, হজমে সাহায্য করে, মল তৈরিতে সাহায্য করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, কোলন ক্যান্সার দূরে রাখে। এই উপকারি প্রো–‌‌বায়োটিক ব্যাকটিরিয়ার খাদ্য হিসাবে প্রি বায়োটিক এজেন্ট উল্লেখযোগ্য। সুতরাং ড্রাই ফ্রুট খেলে প্রো–‌‌বায়োটিক ব্যাকটিরিয়ার বৃদ্ধি ভাল হয়। তার ফলে অনেক রোগের কবল থেকে আমরা দেহকে বিপদমুক্ত রাখতে পারি।
✦ ড্রাই ফ্রুট একপ্রকারের ইমিউনো বুস্টার। এতে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা উল্লেখ্যভাবে বাড়ে।



বেশি ভাল নয়
আজকাল ড্রাই ফ্রুট খাওয়ার প্রবণতা ভীষণভাবেই বেড়ে গেছে। তবে মুঠোমুঠো ড্রাই ফ্রুট খেলে যে শুধু ভালই হবে, তা নয়। সব কিছুরই একটা পরিমাণ আছে। তার বেশি হলে হয় হিতে বিপরীত। ড্রাই ফ্রুটও এর ব্যতিক্রম নয়। আলমন্ড ভালো বলে খেয়ে নিলাম, ওয়ালনাটের নাম শুনে সেটাও খেয়ে নিলাম বেশ কিছুটা। ‌খেঁজুর, অ্যাপ্রিকট, প্রুন, অ্যাভোকাডো, কাজু, কিশমিশ, বাদাম সবই যদি ভাল বলে প্রচুর পরিমাণে খেয়ে নিই, তাহলে শরীরে প্রয়োজনের থেকে অতিরিক্ত ক্যালরি যাবে। বর্তমান যুগে দৈহিক পরিশ্রম অনেকাংশেই কমে গেছে, সুতরাং ওই অতিরিক্ত ক্যালরি খরচ হওয়ার সুযোগ থাকে না। তা অবশেষে আমাদের শরীরে ফ্যাটে রূপান্তরিত হয়ে থেকে যায়। ফলে ওজন বাড়ে। শরীরে আখেরে প্রভূত সমস্যা তৈরি হয়। তখন হৃদযন্ত্রের সমস্যা, বিপাকের সমস্যা, ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, ক্যান্সার, কিডনির সমস্যা, অস্টিও–‌‌আর্থারাইটিসের মতো গুরুতর অসুখও বাসা বাধে শরীরে। তাই ড্রাই ফ্রুট ভালো, আমরা আমাদের দৈনন্দিন ডায়াটে রাখতেই পারি ড্রাই ফ্রুটস। কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত কখনই নয়।‌
কোনও কিছুর সঙ্গে পরিমাণমতো ড্রাই ফ্রুট মিশিয়ে খেলে সবথেকে ভালো। যেমন পায়েস বা মিষ্টি খাবারে অল্প দেওয়া যায়, ওটস্ বা শস্যদানার সঙ্গে একটু মিশিয়ে খাওয়া যায়। মুড়ির সঙ্গে বাদাম মিশিয়ে খাওয়া যায়। শুকনো খাওয়ার থেকে কোনও কিছুতে মিশিয়ে খেলে পরিমাণও নিয়ন্ত্রণ থাকে, স্বাস্থ্যও ভাল থাকে।



খেতে মানা
✦ ড্রাই ফ্রুটে বেশ কিছু অ্যালার্জেন উপকরণ থাকে, তাই যাঁদের অ্যালার্জি আছে, তাঁদের ড্রাই ফ্রুট না খাওয়াই শ্রেয়।
✦ ‌সোডিয়াম, পটাশিয়ামের পরিমাণ ড্রাই ফ্রুটে অনেক বেশি। তাই যাঁরা কিডনির সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের ড্রাই ফ্রুটস খাওয়া একদম উচিত নয়। কারণ এমন রোগে সোডিয়াম, পটাশিয়াম বাড়লে জীবনহানির আশঙ্কাও হতে পারে।
✦ ক্রনিক ডায়েরিয়া, ইরিটেবল বাওল সিনড্রোম, হজমের সমস্যা ইত্যাদি থাকলে ড্রাই ফ্রুট খাওয়া মানা, কারণ এতে থাকা প্রচুর ফাইবার রোগী হজম করতে পারে না।
✦ একদম ছোট বাচ্চাদের ড্রাই ফ্রুট না দেওয়াই ভাল, কারণ ছোটবেলায় পরিপাকতন্ত্র অপরিণত থাকে, ফলে ড্রাই ফ্রুটের অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, প্রোটিন তারা হজম করতে পারে না।
(‌মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)‌

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *