সত্যি এ বড় সুখের সময় নয়। আমাদের প্রত্যেকের জন্য এ হল এক টেস্টিং টাইম বা অগ্নিপরীক্ষা। যখন বিশ্বজুড়ে করোনা প্যানডেমিক থাবা বসিয়েছে, এই দুঃসময়ে আমরা বড়রা এর গুরুত্ব বুঝতে পারছি এবং কী কী প্রিভেন্টিভ মেজার নেওয়া দরকার সেটা আমরা জানি। কিন্তু আমাদের বাড়িতে যে খুদে সদস্যরা রয়েছে, তারা কী অতশত বোঝে! কেন তাদের গৃহবন্দি থাকতে হচ্ছে, কেন তারা বাইরে যেতে পারছে না, কেন বন্ধুদের সঙ্গে বিকেলে খেলার মাঠে যেতে পারছে না, এমনকি স্কুল পর্যন্ত বন্ধ।

ঘরবন্দি একঘেঁয়ে জীবন, বিরক্তিকর ও কষ্টদায়ক অনলাইন পড়াশোনার ফাঁকে অস্বস্তিকর সাদাকালো জীবন। শহুরে সম্পন্ন পরিবারে যেমন, গ্রামেগঞ্জে বাচ্চাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। পড়াশােনা শিকেয় উঠেছে, পাশাপাশি সংসারের সার্বিক দারিদ্রের ছাপ এসে পড়ছে তাদের মনে। এই গুমোট পরিবেশে শিশুরা যাতে পজেটিভ ও হাসিখুশি থাকে, তাদের মনোজগতে যাতে হতাশা না জন্মায়, এটা প্রত্যেক বাবা–মায়ের কাছেই একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ।


 

এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কয়েকটি পরামর্শ দিই যাতে বাড়িতে থেকেই আপনার সোনামণি এই বিপদের সময়টা পার করে দিতে পারে—

১. এই সময় ওদের একটা দিকে মন ঘোরাতে পারলে খুবই ভালো হয়। এবং এটা করতে বাড়ির বড়দের সহায়তা ও সাহচর্য খুব প্রয়ােজন। ওদের বিভিন্ন টুকিটাকি ঘরের কাজে ইনভল্‌ভ করান, সেটা ঘর গাছানো বা মোছানো যেমন পরিষ্কার করা, ঝাঁট দেওয়া, এছাড়া ছাদে বা যদি বাড়িতে বাগান থাকে, বাগানের কাজে আপনাকে সাহায্য করা।

বাচ্চাদের দিয়ে মাটিতে বা টবে কমসময়ের ফসলি ফুল–ফল–সবজির চারা বসান। ওদের পরিচর্যা ও যত্ন নিতে শেখান। গাছ বড় হবে, পাতা ছাড়বে, ফুল ফুটবে, একদিন ফলও ধরবে। এইসব প্র্যাকটিক্যাল অভিজ্ঞতায় দেখবেন কী অপার আনন্দ ফুটবে ওদেরও চোখে মুখে।

২. ওদের সঙ্গে বিভিন্ন ইন্ডোর গেমস, যেমন ক্যারাম, লুডো, এমনকি লুকোচুরিও খেলতে পারেন।

৩. স্ক্রিন টাইম অর্থাৎ টিভি বা মোবাইলে সময়টা বেঁধে দিতে হবে, যাতে সে ওইসব কম্পিউটার গেমস বা কার্টুনে অতিরিক্ত আসক্ত না হয়ে পড়ে।

৪. ওদেরকে প্রতিদিনের জন্য কিছু কাজ দিন, নতুন ক্লাসের বই ধরে নিজে একটু সময় দিন।

৫. বাড়ির সবাই একসঙ্গে খেতে বসুন। আগে হয়ত আপনার অফিসের তাড়া কিংবা ওদের স্কুলে যাওয়ার তাড়ায় সবাই একসঙ্গে খেতে বসার সুযােগ পাওয়া যেত না।

৬. অবসর সময়ে, বাচ্চাকে নিজের জীবনের বিভিন্ন প্রতিকূলতা বা ঝড়ঝাপটা সামলে কীভাবে বড় হয়েছেন বা সফল হয়েছেন, তার গল্প বলুন, যাতে আপনার সন্তান বুঝতে পারে যে খারাপ সময় চিরকাল থাকে না এবং এরপর ভালো সময় আসবেই।

৭. এবং যদি পারেন, করোনা ভাইরাস সম্পর্কে দু’চার কথা ওদের বলতে পারেন এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কেও, যেমন ভালোভাবে হাত ধোওয়া, চোখে–নাকে–মুখে হাত না দেওয়া, তিন বছরের ওপরের বড় শিশুকে ডাক্তার দেখাতে বা বাইরে নিয়ে বেরোলে মাস্ক পরানো অভ্যাস করা, আর যদি নেহাতই মাস্ক না পরতে চায়, ওদের জন্য ফেস শিল্ড কিনে আনা।

৮. এই সময়, বিশেষ করে ঋতু পরিবর্তনের কারণে শিশুরা বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস সংক্রমণের শিকার হয়, যেমন সর্দিকাশি, জ্বর, গা–হাত ব্যথা ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে উপযুক্ত বিশ্রাম, বেশি রাত না জাগা, পর্যাপ্ত ঘুম, পরিমাণমতো জলপান (উপযুক্ত হাইড্রেশান) এবং জ্বর ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হলে সঠিক মাত্রায় প্যারাসিটামল। এছাড়া বিশেষজ্ঞ শিশুচিকিৎসকের পরামর্শ তো আছেই। এখন অনেকসময়ই আমরা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবস্থার শরণাপন্ন হই টেলিকনসাল্ট–এর মাধ্যমে। এতে যেমন সময় বাঁচে, তেমনি সংক্রমণের সম্ভাবনাও কমে।

৯. ভ্যাকসিন–রুটিন ইমিউনাইজেশন নিয়ে নিতে হবে সময় মতো। এছাড়া ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ফ্লু ভ্যাকসিন নেওয়া আবশ্যক। কেননা, এইসময় কমন ফ্লু–তে আক্রান্ত হলে ইমিউনিটি বা প্রতিরাধ সক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে করােনা বা অন্যান্য ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

১০. ফল, তাজা শাকসবজি বেশি করে খেতে হবে, এগুলোতে ভিটামিন ‘‌সি’‌– র ঘাটতি পূরণ হবে; এছাড়াও বিভিন্ন ভিটামিন ‘‌সি’‌ এবং ‘‌ডি’‌ সাপ্লিমেন্ট ডাক্তারবাবুর পরামর্শমতো নেওয়া যেতে পারে।
সবশেষে বলি, বকাঝকা কম, ওদের সঙ্গে বাচ্চার মতো মিশুন। ওদের মজার কথায় প্রাণখুলে হাসুন, করুক না ওরা ঘরদোর নোংরা, করতে দিন— সবসময় মানসিকভাবে পজেটিভ থাকুন।
বাড়িতে থাকুন, সুরক্ষিত থাকুন, ‘‌আমরা করবো জয়…নিশ্চয়।’‌‌

(‌মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *