পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম বা ‌পিসিওএস‌ বর্তমানে মহিলাদের খুব সাধারণ একটি গাইনেকোলজিক্যাল সমস্যা। তবে এটা কোনও অসুখ নয়, লাইফস্টাইল ডিসঅর্ডার। পরোক্ষে দায়ী শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা। ১৯৩৫ সালে এই অসুখটি প্রথম চিহ্নিত হয় ভারতে। বর্তমানে প্রতি ৫ জন মহিলার মধ্যে ১ জন পিসিওএসে আক্রান্ত অর্থাৎ প্রায় ২০ শতাংশ ভারতীয় মহিলা (‌১৮–৪৪ বছর)‌। লাইফস্টাইলে কোনও শৃঙ্খলা না থাকাই মহিলাদের এই সমস্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ‌পি সি ও এসে নানারকম ওভারিয়ান সিস্ট তৈরি হয়, যার মধ্যে বেশিরভাগই ক্ষতিকর নয়। আর আক্রান্ত মহিলাদের অধিকাংশই কমবয়সি।



অসুখের উৎপত্তি কীভাবে?


প্রথমেই জানা দরকার, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা কী? হরমোনের কাজ কী?‌‌ আমাদের শরীরে এন্ডোক্রাইন, পিটুইটারি, থাইরয়েড, অ্যাড্রেনাল, প্যাংক্রিয়াস ইত্যাদি নানা ধরনের গ্ল্যান্ড বা গ্রন্থি রয়েছে। এদের কাজ শরীরে হরমোন উৎপন্ন করা। হরমোন এক ধরনের কেমিক্যাল। এর কাজ রক্তের মাধ্যমে শরীরের টিস্যু বা সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গে বার্তা পাঠানো। হরমোন শরীরে সঞ্চয় করে রাখা যায় না। যখন যতটুকু প্রয়োজন তখন ঠিক ততটুকুই নিঃসরণ হয়। কিন্তু যখন প্রয়োজনের অতিরিক্ত বা প্রয়োজনের কম নিঃসরণ হয়, তখন হরমোনের ভারসাম্যের অভাবে শরীরে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। যেটা শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষেত্রেই। যেমন, ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন হরমোনের সামঞ্জস্যের অভাবে ওজন বাড়ার পাশাপাশি হাড়ের শক্তি কমে যাওয়া, মাস্‌ল ফ্যাটিক হয়ে যাওয়া, কোনও কিছু ভাল না লাগা, দুর্বলতা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় বিভিন্ন মুখরোচক খাবার খাওয়ার ঝোঁক। ফলে বাড়তে শুরু করে শরীরের ওজন। অন্যদিকে, টেস্টোস্টেরন হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে সেক্স ডিসঅর্ডার, ইনফার্টিলিটি ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। আবার যখন ইনসুলিন হরমোনের ভারসাম্যের অভাব দেখা দেয় তখন শরীরে থাবা বাসায় ডায়াবেটিস। ওজন বাড়ার ফলে শরীরে বাড়ে খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ। এই হরমোনের ভারসাম্যহীনতা পরোক্ষে শরীরে নানা অসুখ ডেকে আনে। তেমনই একটি অসুখ পি সি ও এস।

​​​​​​

 

পিসিওএসের উপসর্গ


✦ অনিয়মিত পিরিয়ড বা পিরিয়ডে প্রচুর রক্তক্ষরণ ✦ ওভারিয়ান সিস্ট ✦ ওজন বেড়ে যাওয়া‌ ✦ মুখে ব্রণ ✦ চুল পড়ে যাওয়া ✦ শরীরে ব্ল্যাক প্যাচ— এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন।  

প্রতিরোধে কেমন লাইফস্টাইল?‌

❁ পি সি ও এসে আক্রান্ত কোনও মহিলা যোগা বিশেষজ্ঞের কাছে এলে, প্রথমেই দেখতে হয় তাঁর শরীরে হরমোন নিঃসরণ ঠিকমতো হচ্ছে কি না।‌ অর্থাৎ, হরমোন নিঃসরণে ভারসাম্য রয়েছে কি না।‌ এর পাশাপাশি ওজন বা খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার মতো কোনও সমস্যা থাকলে, তা নিয়ন্ত্রণে যোগব্যায়ামের পাশাপাশি কিছু ব্রিদিং এক্সাসাইজ, যেমন প্রাণায়াম বা মেডিটেশনেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

❁ শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দিলে মনের ওপরও তার প্রভাব পড়ে। মন ভাল থাকে না। দেহ ও মনের সামঞ্জস্য গড়ে তুলতে শরীরচর্চা ভূমিকা‌ নেহাত কম নয়।  


 

❁ তবে শুধু শরীরচর্চাই নয়, দরকার হেলদি ডায়েটও। প্রচুর পরিমাণে মরশুমি ফল–শাকসবজি খান, খেয়াল রাখুন শরীরে যাতে প্রোটিনের ঘাটতি না হয়। খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিন প্রসেস্‌ড ফুড, যেমন চিজ, ক্যান্ডি, কুকিস, হোয়াট সুগার ইত্যাদি। এড়িয়ে চলতে হবে জাঙ্ক ফুড। নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাটজাতীয় খাবার খাওয়া। অর্থাৎ সুষম খাবার খাওয়ার যেমন অভ্যেস করতে হবে, তেমনই তার সঙ্গে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকতে হবে শরীরচর্চার প্রতিও। আর অবশ্যই নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং রক্ত পরীক্ষা করান।


❁ খেয়াল রাখুন ডায়াবেটিস যেন শরীরে থাবা বসাতে না পারে। কারণ, এতে শরীরে ইনসুলিন হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। এই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে বা প্রতিরোধে দরকার নিয়মিত শরীরচর্চা।

কী ধরনের ব্যায়াম?‌


❃ পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমে যোগব্যায়ামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল পেলভিক অঞ্চলের নির্দিষ্ট কিছু এক্সাসাইজ। যদি যোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে এ ধরনের এক্সাসাইজ করা যায় তাহলে পি সি ও এসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমে। এর পাশাপাশি ব্রিদিং এক্সাসাইজও করা দরকার। কারণ ব্রিদিং এক্সাসাইজ শরীর ও মন দুই–ই শান্ত করে।


❃ অনেকেরই শরীরের ওজন এতটাই বেড়ে যায় যে তাঁরা দৈনন্দিন কাজকর্মগুলো পর্যন্ত ঠিকমতো করতে পারেন না। তাঁদের জন্য সবচেয়ে ভাল যোগা হল সূর্যপ্রণাম। সূর্যের ১২টি নাম অনুযায়ী ১২টি ভঙ্গিমা রয়েছে সূর্যপ্রণামের। এই ভঙ্গিমাগুলোতে যদি ঠিকমতো সূর্যপ্রণাম করা যায় তাহলে অনেক উপকার। সূর্যপ্রণাম একটি ডায়নামিক আসন হওয়ায় এতে শরীরে তাপ উৎপন্ন হয়, যা শরীরের ফ্যাট বার্ন করতে সাহায্য করে।


❃ বাটার ফ্লাই পোজ ‌বা বন্ধ কোনাসন। এটি এক ধরনের আসন, যা পেলভিক অঞ্চলকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে। এ ছাড়া রয়েছে চাক্কি চারনাসন, সুপ্ত বজ্রাসন, সলভাসন, ক্যামেল পোজ, কোবরা পোজ, বোর্ড মেকার বা নৌক আসন ইত্যাদি।

কেন যোগ বা শরীরচর্চার প্রয়োজন?‌


পেলভিক অঞ্চলের এই আসনগুলো নিয়মিত করলে পেলভিক অঞ্চল যেমন শক্তিশালী হয় তেমনই এর সঙ্গে যদি ডায়নামিক মুভমেন্টগুলো করি তাহলে শরীরে হরমোন নিঃসরণ সঠিক মাত্রায় হবে এবং মাস্‌ল কন্ডিশনিংও হবে। ঠিক থাকবে শরীরের রক্তসঞ্চালন। ফলে প্রচুর পরিমাণ রক্ত পৌঁছবে মস্তিষ্কে। শরীরচর্চার সময় মাস্‌ল বা পেশিতে রক্তের চাহিদা বাড়ে।

মস্তিষ্কে যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ রক্ত পৌঁছয় তাহলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন মাত্রায়ও ঠিক থাকবে। তখন আমাদের নিউরন বা স্নায়ু অনেক বেশি সক্রিয় থাকে। এ ছাড়াও মস্তিষ্কের সেরোটোনিন, ডোপামাইন, এন্ডোরফিন ইত্যাদি হরমোনের নিঃসরণ ঠিকমতো হলে আমাদের মধ্যে একটা ‘‌ফিল গুড’‌ অনুভূতি তৈরি হয়।
ব্রিদিং এক্সাসাইজ যেমন কপালভাতি। ধৌতি, বস্তি, নেতি, নৌলিক, ত্রাটক ও কপালভাতি এগুলোকে বলে ষট্‌ ক্রিয়া বা হটো যোগ। এই ষট্‌ ক্রিয়ার একটা অংশ হল কপালভাতি, যা শরীর ও মন— দুই–ই সুস্থ রাখে।

মনে রাখুন


১.‌ আপনার খাদ্যই আপনার পথ্য,

২. রাস্তার খাবারের থেকে বাড়ির খাবারকেই বেশি গুরুত্ব দিন,

৩.‌ রোজ ৩০–৪০ মিনিট শরীরচর্চা এবং

৪.‌ পর্যাপ্ত ঘুম— এগুলো হল স্বাস্থ্য‌ ভালো রাখার মূল চাবিকাঠি। আরও সহজভাবে বলতে গেলে জাঙ্ক ফুড, ফাস্ট ফুড, প্রসেস্‌ড ফুড ইত্যাদিকে খাদ্যতালিকা থেকে যতটা পারেন দূরে রাখুন। নিয়মিত কিছু এক্সাসাইজ করুন, তাহলে একদিকে যেমন শরীরে অতিরিক্ত ফ্যাটের অনুপ্রবেশ ঘটবে না, তেমনই আগের সঞ্চিত ফ্যাট সহজেই বার্ন হতে শুরু করবে। কমবে কোলেস্টেরলের মাত্রাও।


ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকলেও, যোগাসনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হল ‘‌বেটার ফিল’‌। কমবয়সি মহিলা যাঁরা পিসিওএসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন, তাঁরা যদি নিজের প্রতি, লাইফস্টাইলের প্রতি এবং শরীরচর্চার প্রতি একটু সচেতন হন, তাহলেই ৯৮ শতাংশ মহিলার পিসিওএসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে।‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌

( মতামত একান্ত ব্যক্তিগত )

Comments

  • Extremely informative article written in lucid style.The younger generation needs to understand that good quality living can be achieved only through correct and healthy lifestyle.Kudos to Mr. Debjit Das for giving the right pointers.

    - Gautam Dey

    Sat, Jan 2, 2021 3:24 PM

  • খুবই প্রয়োজনীয় একটি বিষয় নিয়ে এইখানে আলোচনা করা হয়েছে.এই ব্যস্ততার যুগে কিছু অল্প সময় যদি নিজের জন্যে ব্যয় করা যায় তাহলে এই ক্রমবর্ধমান রোগটির জটিলতা থেকে নিজেকে ভালো রাখার যথেষ্ট উপাদান এই লেখায় লিপিবদ্ধ আছে.

    - Diptesh Chakrabarti

    Sun, Jan 3, 2021 5:49 PM

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *