জীবন সায়াহ্নে এসে কিছু প্রবীণ মহিলার চেতনায় জন্ম নিয়েছে নতুন প্রতিভার উন্মেষ। বল পায়ে তাঁদের প্রতিভার কাছে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে মারণ ব্যাধিও। তাঁদের অদমনীয় জেদ যেন স্ফুলিঙ্গ হয়ে রুখে দিয়েছে মৃত্যুর রথ। হতাশায় ডুবে যাওয়া মনগুলো আবার ফিরে পেয়েছে ফেলে আসা যৌবনের যাবতীয় উচ্ছ্বাস, বাঁচার ইচ্ছে
ফুটবল যখন জিয়ন কাঠি
প্রীতিময় রায়বর্মন
রোগের জ্বালা ভুলতে, দক্ষিণ আফ্রিকার লিম্পোপো রাজ্যের একদল প্রবীণ মহিলা মেতে উঠেন ফুটবলে। ফুটবলই তাদের কাছে হয়ে ওঠে ধ্যান–জ্ঞান–বাঁচার স্বপ্ন। তাঁরা প্রমাণ করেছেন শুধুমাত্র ডাক্তারি চিকিৎসাই সব নয়, আসল চিকিৎসা হল মনকে চাঙ্গা রাখা। আর মন যদি চাঙ্গা থাকে তাহলে সব রোগব্যাধিই তুচ্ছ। ফুটবলই তাঁদের মনে পুনঃরায় ফিরিয়ে দিয়েছে বাঁচার ইচ্ছা।
ফুটবলের মধ্যে দিয়ে ক্যান্সার আক্রান্ত মহিলাদের নতুন করে বাঁচার দিশা দেখানোর কারিগর বেক নাশাউশি। যিনি লিম্পোপোর ‘মাদার টেরিজা’ নামে পরিচিত। ২০০৩ সালে নাশাউশি ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। শুরু হয় চিকিৎসা। ডাক্তারের পরামর্শে চলে শরীরচর্চাও। চিকিৎসার তাগিদে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে বেড়ানোর সময় নাশাউশি লক্ষ্য করেন অনেক প্রবীণ মহিলাই বিভিন্ন রোগের তীব্র যন্ত্রণায় মৃত্যু পথযাত্রী। কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত, কেউ আবার ডায়াবেটিস বা আর্থারাইটিসে ভুগছেন।
তখনই নিজের রোগের কষ্ট ভুলে অন্য প্রবীণ মহিলাদের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন নাশাউশি। প্রথমে তিনি তাঁদের নিয়ে শুরু করেন শরীরচর্চা। ক্রমে সেই শরীরচর্চার দলই পরিণত হয় ফুটবল দলে। ২০০৫ সালে তিনি তাঁর দলের নাম রাখেন ‘ভাখেগুলা–ভাখেগুলা’। দক্ষিণ আফ্রিকায় যা ‘গোগোস’ নামেও পরিচিত। ‘ভাখেগুলা’ কথাটির ইংরেজি হল গ্র্যান্ডমাদার অর্থাৎ ঠাকুমা।
‘ভাখেগুলা–ভাখেগুলা’ ছাড়াও তিনি গঠন করেন আরও কয়েকটি ফুটবল দল। চালু করেছেন ‘সোঙ্গা লিগ’ নামক ফুটবল প্রতিযোগিতা। নাশাউশির তৈরি করা দলে যাঁরা খেলেন তাঁদের প্রত্যেকেরই বয়স ৪৯ থেকে ৮৪ বছরের মধ্যে। প্রতি সপ্তাহের মঙ্গল এবং বৃহস্পতিবার থাকে অনুশীলন আর শনিবার অনুষ্ঠিত হয় সোঙ্গা লিগের ম্যাচ। এই সকার দল এতটাই বিখ্যাত যে তারা আমেরিকার বিখ্যাত ‘ভেটারেন্স কাপ’ টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের ডাক পেয়েছিল। যদিও অর্থাভাবের কারণে সেই প্রতিযোগিতায় যোগ নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, বুন্দেশলিগা বা স্প্যানিশ লিগের মত স্কিলের যাদু কিংবা দ্রুতগতির ফুটবল না হলেও সোঙ্গা লিগের ম্যাচগুলিতে রয়েছে জরাগ্রস্ত প্রবীণ–প্রবীণাদের জন্য এক অন্য ধরনের অফুরন্ত আনন্দদায়ক অনুপ্রেরণা।
ফুটবলের মধ্য দিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখানোর এই প্রয়াস বিজ্ঞানের নতুন কোনও আবিষ্কারের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। ফুটবল ছাড়াও নানা সমাজসেবামূলক কাজের জন্য বেক নাশাউশি বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচবার পেয়েছেন ‘বিএমএফ লিম্পোপো উইমেন অফ এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড’। ২০০৬ সালে পেয়েছেন ‘প্রিমিয়ারস্ অ্যাওয়ার্ড’ এবং ‘লিম্পোপো অ্যাচিভার অ্যাওয়ার্ড’।
নাশাউশির ফুটবল নামক জিয়ন কাঠির স্পর্শে জরাজীর্ণ প্রবীণরা খুঁজে পেয়েছেন বাঁচার আনন্দ।
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments