কুইন অফ সাতপুরা
প্রীতিময় রায়বর্মন

পুরাতাত্ত্বিক সৌন্দর্যের খনি। কুইন অফ সাতপুরা। সাতপুরা পাহাড়ের ১,০৬৭ মিটার উচ্চতায় নর্মদা উপত্যকার দক্ষিণে মধ্যপ্রদেশের একমাত্র পাহাড়ি শহর পাঁচমারি। পাঁচ পাহাড়ের সমাহার। মধ্যপ্রদেশের কাশ্মীর। প্রায় ১,৩০০ চিরহরিৎ সবুজ বৃক্ষরাজের মাঝে বিভিন্ন প্রজাতির ৫০ স্তন্যপায়ী প্রাণীর আনাগোনা, ২৫০ প্রজাতির পাখির ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো, ৩০ প্রজাতির সরীসৃপের উপস্থিতি, ৫০ প্রজাতির রঙবেরঙের প্রজাপতির হাজিরা আর নাম না জানা অজস্র রঙবাহারি ফুলের সমাহার। পাহাড়ি সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলছে পাহাড়ি ঝর্না। কখনও মনে হতেই পারে, যেন এক জলপ্রপাতের দেশে এসে পড়েছি। দুরারোহ লাল বেলেপাথরের পাহাড় এখানকার সৌন্দর্যকে বাড়িয়েছে কয়েক গুণ। ব্রিটিশ সাহেব ক্যাপ্টেন ফরসিথের ব্লু-প্রিন্টে পাঁচমারিতে গড়ে ওঠে ব্রিটিশদের স্যানেটোরিয়াম ও হিল রিসর্ট। ছিল তাদের গ্রীষ্মবাসেরও জায়গা। মেঘ আর রোদ্দুরের লুকোচুরি খেলা চললেও সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের দৃশ্য এখান থেকে নয়নাভিরাম। ভোরে সূর্যোদয়ের সময় ধূপগড় আর বিকেলে সূর্যাস্তের সময় লিঙ্গরূপী মহাদেব পাহাড়ের নীলচে-লাল আভার কী চমৎকার প্রতিফলন। থাকার একটা ব্যবস্থা করে এখানকার শান্ত, সিগ্ধ, মনোরম পাহাড়ি পরিবেশে হারিয়ে যাওয়া।

পাণ্ডব গুহা: টিলার গায়ে পাঁচটি গুহা নিয়ে ক্ষয়িষ্ণু পাণ্ডব গুহা। অজ্ঞাতবাসকালে পাণ্ডবরা এখানে ছিলেন। গুহার ভেতর বৌদ্ধ বিহারধর্মী ছবির চমৎকার নকশা। আর তাই হয়ত ভূতাত্ত্বিকদের কাছে এই গুহা জৈন বা বৌদ্ধগুহা নামে পরিচিত। ভূতাত্ত্বিক গবেষণায় পাহাড়ের নীচের দিকে আরও তিনটি গুহা আবিষ্কার হয়েছে। গুহার মাথা থেকে বেশ চমৎকার লাগে পাঁচমারিকে।  
হান্ডি খো: ‘ভি’ আকৃতির ৩০০ ফুটেরও বেশি গভীর খাত। বইছে পাহাড়ি ঝর্না। ওপর থেকে কোনও কিছু খাদে ফেললে তার শব্দ শোনা যায় প্রায় ৭ সেকেন্ড পরে। এই জায়গাটিকে নিয়ে জড়িয়ে আছে শিবের নানা কাহিনী। শোনা যায়, একটা সময় সাপের উপদ্রবে শিবভক্তরা এখানে আসতে পারছিলেন না। এতে ক্রদ্ধ শিব ত্রিশূল দিয়ে মেরে ফেলেন সাপকে। আর শিবের ক্রোধে হ্রদের জল শুকিয়ে আকার নেয় রেকাবির। পাহাড় নেয় হাঁড়ির রূপ। আর তা থেকেই নাম হয় হান্ডি খো। তবে ধর্মে যাঁদের বিশ্বাস নেই তাঁদের মতে পাহাড়ের এই রূপ নেওয়ার কারণ ভূমিকম্প। কারও মতে, ভেষজ বৃক্ষ হাজো থেকে নাম হয়েছে হান্ডি।

প্রিয়দর্শিনী পয়েন্ট: এখান থেকে পাঁচমারির নৈসর্গিক শোভা চিরদিন মনে রাখার মতো। ১৮৫৭ সালে ক্যাপ্টেন ফরসিথ এখান থেকে পাঁচমারিকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ফরসিথ পয়েন্টই আজকের প্রিয়দর্শিনী পয়েন্ট। 
মহাদেব গুহা ও অন্যান্য গুহা: ছোট, বড় দুটি গুহা। গুহার গায়ে প্রিহিস্টোরিক রক আর্ট। সিঁড়ি বেয়ে উঠে শিবদর্শন। পাহাড় চুঁইয়ে অবিরাম জল পড়ার মাঝে শাল, সেগুন, আম, জাম, বাঁশের অরণ্য পেরিয়ে পথ চলা। গুহার ভেতরে কোনও কিছু লেন্সবন্দি করা নিষেধ। লক্ষাধিক শিবভক্তের সমাগমে বেশ ধুমধামের সঙ্গে এখানে পালন করা হয় শিবরাত্রি উৎসব। এ ছাড়াও এখানে রয়েছে আরও বেশ কিছু গুহা। মারাদেও গুহায় মেসোলিথিক যুগের সমাজজীবনের চিত্র ফুটে ওঠেছে গুহাগর্ভের দেওয়ালে। দেখবেন পার্বতী গুহা, গুপ্ত মহাদেব গুহা। আরণ্যক পরিবেশের পার্বতী গুহা থেকে অন্ধকারে ঢাকা গুপ্ত মহাদেব গুহা। কথিত আছে, ভস্মাসুরের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য মহাদেব লুকিয়ে ছিলেন যে গুহায়, সেই গুহাই আজ গুপ্ত মহাদেব গুহা। সরু পথ, তাই একসঙ্গে ৪-৫ জনের বেশি গুহায় প্রবেশ করা যায় না।
চৌরাগড়: এখান থেকে ৪ কিমি দূরে চৌরাগড়। পাহাড়ের মাথায় শিবমন্দির।

রাজেন্দ্রগিরি: রাজেন্দ্র পাহাড়ে সুন্দর এই বাগিচায় ঘুরতে ঘুরতে কখন যে সময় কেটে যায় খেয়ালই থাকে না। ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের নাম থেকে এই পাহাড়ের নামকরণ।
ধূপগড়: শহর থেকে দূরত্ব ১০ কিমি। রাজ্য পর্যটনের ব্যবস্থাপনায় জিপ যাচ্ছে পাহাড়ে। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখার টানেই এখানে ছুটে আসা। ৪,৪২৯ ফুট উচ্চতায় সর্বোচ্চ ধূপগড় সানসেট পয়েন্ট। এখান থেকেও পাঁচমারির নিসর্গ মনে রাখার মতো। শাল, মহুয়া, বাঁশ, কেন্দু ইত্যাদি গাছে ঢাকা অরণ্যের মাঝে ভাল্লুক, চিতা, গউর, লাঙ্গুর ইত্যাদির উপস্থিতি। রয়েছে ময়ূর, শঙ্খচিল। পাহাড় ঘুরে এখানে থাকতে চাইলে পি ডব্লু ডি রেস্ট হাউসে থাকতে পারেন। 
জটাশঙ্কর গুহা: বাস স্ট্যান্ড থেকে ২ কিমি দূরে প্রায় ১০০ ফুট নীচে খাদের মধ্যে জটাশঙ্কর গুহামন্দির দর্শনে মিলবে এক আলাদা অনুভূতি। স্ট্যালাগমাইট পাথর এখানে ধারণ করছে জটার রূপ। গুহার ভেতর শিবলিঙ্গ আর ঠান্ডা জলের প্রস্রবণ দেখে ঘুরে আসা যায় হার্পারস গুহা এবং অম্বাদেবীর মন্দির থেকে।

জলপ্রপাত
গুহা আর মন্দির দর্শন সেরে এবার দেখে নেওয়া যাক একের পর এক জলপ্রপাত। দেখুন ডাচেস ফলস। এই জলপ্রপাতের অপরূপ শোভা দেখতে হলে প্রায় ৪ কিমি নীচে নামতে হয়। পশ্চিমে প্রায় ৩ কিমি দূরে সুন্দর কুণ্ড। প্রাকৃতিক এই জলপ্রপাত দেখে ঘুরে আসা যায় যমুনা জলপ্রপাত থেকে। সাতপুরা জাতীয় উদ্যানের মাঝে যমুনা জলপ্রপাত বা বি ফলস। বি ফলসের শোভা ভালভাবে উপভোগ করতে প্রায় ২ কিমি নামতে হবে। বি ফলস দেখার প্রবেশমূল্য ১০ টাকা। মিলিটারি ব্যারাক থেকে একটু এগোলে লিটল ফলস। দল বেঁধে গেলে অপ্সরা বিহারে পিকনিকের ব্যবস্থা রয়েছে। অপ্সরা বিহার যেতে দেখে নেওয়া যায় ধুয়াধার। অপ্সরা থেকে মিনিট দশ-পনেরোর রাস্তা রজত প্রপাত। এখানেই প্রায় দেড়শো মিটার উঁচু থেকে নেমেছে বিগ ফলস। দেখুন রামকুণ্ড বা আইরিন পুল। রিচগড়ে লেডি আইরিন বসুর আবিষ্কৃত গুহা থেকে নেমে আসা ঝোরা আইরিন পুল।

আরও যা
মোড়ক সফরে একে একে ঘুরে আসা যায় ১৮৭৫ সালে তৈরি ক্রাইস্ট চার্চ, ১৮৯২ সালে ফরাসি ও আইরিশ শিল্পশৈলীতে তৈরি ক্যাথলিক চার্চ। আর অবশ্যই যেতে হবে ৫২৪ বর্গকিমি জুড়ে ১৯৮১ সালে গড়ে ওঠা সাতপুরা জাতীয় উদ্যানে। এই জাতীয় উদ্যানের মধ্যেই অপ্সরা বিহার, পাঞ্চালি কুণ্ড ও রজত প্রপাত। চার শিঙের চিতল ছাড়াও এখানকার অরণ্যে দেখা মেলে বন্য ভল্লুক, প্যান্থার, বাইসন, বাঘ ইত্যাদির। কাছেই বাইসন লজ মিউজিয়াম। ১৮৬২ সালে ফরসিথ সাহেবের তৈরি বাইসন লজ আজ বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও জীবজন্তুর সংগ্রহশালা। 

শহুরে যান্ত্রিক জীবন থেকে দিন পাঁচ-ছয়েকের ছুটি মিললে সবুজে ঢাকা পাহাড়ে প্রাগৈতিহাসিক গুহা, সে সময়কার বিভিন্ন নির্দশন আর পাহাড়ি ঝোরার মাঝে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে কাটিয়ে আসাই যায়। 

রুটম্যাপ
যাওয়া: হাওড়া থেকে ১২৩২১ হাওড়া-মুম্বই মেলে পিপারিয়া। সেখান থেকে সড়কপথে পাঁচমারির দূরত্ব ৫৪ কিমি। চাইলে ভূপাল হয়েও যেতে পারেন। কলকাতা স্টেশন থেকে ১৯৪১৪ কলকাতা-আমেদাবাদ এক্সপ্রেস‌, হাওড়া থেকে ২২৯১২ শিপ্রা এক্সপ্রেস‌। ভূপাল থেকে সড়কপথে পাঁচমারির দূরত্ব ২০০ কিমি। এ ছাড়া হাওড়া থেকে ট্রেনে জব্বলপুর, নাগপুর পৌঁছে সেখান থেকে সড়কপথে পাঁচমারি পৌঁছানো যায়। 
থাকা: মধ্যপ্রদেশ রাজ্য পর্যটনের সাতপুরা রিট্রিট (‌ফোন: ০৭৫৭৮–২৫২–০৯৭)‌; রক এন্ড মানোর (‌ফোন: ০৭৫৭৮–২৫২–০৭৯)‌; কার্নিকার বাংলো (‌ফোন: ০৭৫৭৮–২৫২–২৪৮); হোটেল হাইল্যান্ডস (‌ফোন: ০৭৫৭৮–২৫২–০৯৯)‌; গ্লেন ভিউ (‌ফোন: ০৭৫৭৮–২৫২–৫৩৩)‌; দেবদারু বাংলো (‌ফোন: ০৭৫৭৮–২৫২–২৪৯); ক্লাব ভিউ (‌ফোন: ০৭৫৭৮–২৫২–২৪৭)‌; চম্পক বাংলো (‌ফোন: ০৭৫৭৮–২৫২–০৩৪)‌; হোটেল অমলতাস (‌ফোন: ০৭৫৭৮–২৫২–০৯৮)‌‌; হিলটপ বাংলো (‌ফোন: ০৭৫৭৮–২৫২–৮৪৬)। সরকারি ছাড়াও বেসরকারি থাকার ব্যবস্থাও আছে।

বেড়ানো: মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের ব্যবস্থায় গাড়িতে পাঁচমারি বেড়ানো যায়। ফোন: ০৭৫৭৮–২৫২–১০০। টাঙ্গাতেও ঘুরতে পারেন। চাইলে সাইকেল বা মোটরবাইক ভাড়া করেও পাঁচমারি ঘোরা যায়। ট্রেকিং পছন্দ করলে ট্রেকিংয়েরও ব্যবস্থা আছে। দূষণমুক্ত পরিবেশের জন্য এখানে ডিজেলচালিত যানের প্রবেশ নিষেধ।
বেড়ানোর মনোরম সময়: মার্চ থেকে মে এবং অক্টোবর ও নভেম্বর মাস। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে প্রচণ্ড ঠান্ডা।  
বিশদ জানতে যোগাযোগ করুন: কলকাতায় মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের অফিসে। ঠিকানা: ‘চিত্রকূট’, রুম–৬৭, সপ্তমতল, ২৩০ এ, এজেসি বোস রোড, কলকাতা–৭০০ ০২০। ফোন: (‌০৩৩)‌ ২২৮৩–‌‌৩৫২৬। ই–মেল: mokolkata@mp.gov.in। মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের ২৪x৭ টোল ফ্রি হেল্পলাইন নম্বর ১৮০০–২৩৩–৭৭৭৭–এ ফোন করে বাস রুট ও বুকিং সংক্রান্ত তথ্য জানতে পারেন। ওয়েবসাইট: www.mptourism.com এবং mpstdc.com।

সব ছবি: আন্তর্জাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *