ভারতীয় গণতন্ত্রের নায়ক— এক বাঙালি
ডঃ সঞ্জীব রায়

১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশবিভাগের ক্ষত নিয়েই স্বাধীনতা পেল ভারত। তারপর কিছুদিন ধরে চলে ভাগ বাটোয়ারার পালা অর্থাৎ দু’দেশের জাতির জনকের মধ্যে এলাকা নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া। অচিরেই রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ নরমপন্থী ও চরমপন্থী দুই মহারথীর অর্থাৎ নেহরু ও বল্লভভাই প্যাটেলের। শেষমেশ সব কাজ মিটিয়ে দু’পক্ষকেই বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে দেশবাসীর হাতে সবরকম ক্ষমতা প্রত্যার্পণ করে ফিরে গেল ব্রিটিশ। স্মরণীয় সে দিনটি সূচিত হলো প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে। অবসান হল দুশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের।

১৯৫১ সাল সংসদে গঠিত হল নির্বাচন কমিশন। সমস্যা হল যে শুধু নির্বাচন কমিশন গঠিত হলে তো হবে না, তার মাথায় কাকে বসানো হবে? নির্বাচনের সময় নির্দিষ্ট হলো ১৯৫২ সালের মার্চ মাস। মাথায় বসানোর মতন যোগ্যব্যক্তি খুঁজতে খুঁজতেই সবার অবস্থা দফারফা। আলোচনা চলতেই থাকছে কিন্তু মাথা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খবরটা বিধানবাবুর কাছে পৌঁছনোর পরে তিনি একটি নাম জানিয়ে বলেছিলেন, ‘চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারো। এমনিতেই বদ্যিদের মগজ খুব পরিষ্কার হয়, তার মধ্যেও ইনি সেরার সেরা।’

সেই সেরা ব্যক্তিটির জন্ম ১৮৯৮ সালের ২ জানুয়ারি। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অঙ্কে সোনার মেডেল পাওয়া স্নাতক। পরবর্তীকালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। ১৯২১ ব্যাচের আই সি এস। নাম সুকুমার সেন। সত্যি কথা বলতে কী বর্ধমানের বিখ্যাত এই পরিবারের গোটাটাই সোনায় মোড়া। সুকুমার বড়, মেজ অশোক ডাকসাইটে উকিল এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আর ছোটটি? অমিয়, স্বনামধন্য ডাক্তার। কবিগুরুর চিকিৎসক। নোবেল জয়ী কবি ইহলোক ছাড়ার আগে শেষকথা তাঁর প্রিয় ডাক্তার অমিয়-র সঙ্গেই বলে যান।
ফিরে আসি মুখ্য নির্বাচনী কমিশনার প্রসঙ্গে। একটা কথা বলে নেওয়া দরকার যে নেহরুর রাজনীতি ফ্লপ কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে, কিন্তু মানুষটির গুণী লোক বেছে নেবার ক্ষমতা ছিল বাস্তবিকই অসাধারণ। শোনা যায়, নেহরু তাঁদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচরিতায় ‘পণ্ডিত’ বলে সম্বোধন করতেন। সুকুমারবাবুকে নিয়োগপত্র দেবার মাসখানেক পরে নেহেরুজি তাঁকে ডেকে বলেন, ‘পণ্ডিত, মনে রাখবেন আগামী বছর মার্চ মাসে দেশ জুড়ে নির্বাচন। ব্যাপারটা সামলানো কিন্তু বাস্তবিকই কঠিন।’

সুকুমারবাবু ছিলেন তেমনই একজন লোক, যিনি নিজের ক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতা বুঝতেন (‌যা আমরা অনেকেই বুঝি না)‌। সুকুমারবাবু সেদিন নেহরুজিকে আশ্বস্ত করেন। সেই সময় লোকসভা ও বিধানসভা মিলিয়ে মোট আসন ছিল ৪,৫০০। ব্যালট বাক্স তৈরি হয়েছিল ২০ লাখ। ভোট কেন্দ্র হয়েছিল ২,২৪,০০০। ১৭৬ মিলিয়ান ভোটার (‌১ মিলিয়ান = ‌১০ লক্ষ)‌ যাঁদের বয়স ২১-এর বেশি এবং যাদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ লেখাপড়া জানে না। কীভাবে ভোট দিতে হবে তা সাধারণ ভোটারদের বোঝানোর জন্য মোট ৩,০০০ টি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছিল এবং আকাশবাণী তিনমাস লাগাতার রেডিওতে প্রচার চালিয়েছিল।

ভোটারদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভোটকর্মী নিয়োগ এবং তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও হয়। তবে সব থেকে অসুবিধার কাজ ছিল ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, ভারতবর্ষে তখনও গ্রামেগঞ্জের বহু মহিলা পরপুরুষের সামনে নিজের নাম বলতেন না। ফলে আপাত ঠান্ডা মানুষ সুকুমারবাবু দেখেন খসড়া ভোটার তালিকায় লেখা কোনো মহিলার নামের বদলে রামের মা, পরেশের স্ত্রী কিংবা যাদববাবুর মেয়ে। সেই দেখে রেগে তিনি ২৮ লাখ মহিলার নাম বাদ দেন। এই বাদ দেওয়া নিয়ে প্রথমদিকে খানেক সমালোচনা হলেও পরে বোঝা যায় গেছিল তিনি সঠিক কাজই করেছিলেন, কেননা পরের নির্বাচনে (‌১৯৫৭)‌ বাদ যাওয়া মহিলা ভোটাররা নিজ নিজ নাম দিয়ে ভোটার তালিকায় নিজেদের নাম তোলেন।

প্রথম নির্বাচনে আরও একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রত্যেক দলের জন্য পৃথক ব্যালট বাক্সের ব্যবস্থা ছিল। বাক্সের উপর তাদের নিজ নিজ প্রতীক দেওয়া থাকতো। যেমন কংগ্রেসের জোড়া বলদ, কমিউনিস্টদের কাস্তে ধানের শীষ ইত্যাদি। শুধু তাই নয়, প্রথমবার নির্বাচন শেষে সেই বাক্সগুলোকে যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। ফলে ১৯৫৭ সালের নির্বাচনে এক বিশাল খরচ বেঁচে যায়। সুকুমারবাবুর প্রধান নির্বাচনী আধিকারিক হিসেবে কর্মকাণ্ড সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিশেষ অনুরোধে তিনি ১৯৫৩ সালে সুদানে গিয়ে ভোটপর্ব সমাপ্ত করেন। আজও সে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা সুকুমার সেনের নামে নামাঙ্কিত। মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক হিসেবে তিনি দায়িত্বে ছিলেন ১৯৫০ সালের ২১ মার্চ থেকে ১৯৫৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তিনি ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম পদ্মবিভূষণ সম্মানে সম্মানিত হয়েছিলেন।

১৯৬০ সালে ১৫ জুন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়। সেখানেও বিধান রায়ের অনুরোধে সুকুমারবাবুকে প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব সামলাতে হয়েছিল। বিধানবাবুর উদ্যোগে বর্ধমানের জিটি রোড থেকে গোপালবাগ অবধি যে রাস্তা তার নামকরণ হয় সুকুমার সেন রোড।
প্রতিবেদনের শেষে বলা প্রয়োজন যে পশ্চিমবঙ্গ বাস্তবিকই রত্নগর্ভা। সেখানে একাধিক সুকুমার অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন। এক সুকুমার অকাল বিদায় নেন আবোল তাবোলের স্রষ্টার মুকুট মাথায় নিয়ে। আর এক সুকুমার, ১৩ মে ১৯৬৩ সালের দুপুরে চলে গেলেন ‘গণতন্ত্রের স্রষ্টা’ হিসেবে। দুই সুকুমার-ই যুগযুগান্ত ধরে থেকে যাবেন আপামর জনগণের অন্তরে।‌

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *