মহিষাসুরমর্দিনীর নায়ক
ডঃ সঞ্জীব রায়
আকাশবাণীর জনপ্রিয় প্রভাতী অনুষ্ঠান 'মহিষাসুরমর্দিনী'র নায়ক শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়। তাঁর যাদুকন্ঠের জোরে অভাবনীয় জনপ্রিয়তার প্লাবনে ভেসে যায় এই অনুষ্ঠান। অবালবৃদ্ধবনিতার কাছে যা পরিচিতি পায় মহালয়া নামে। দেবীপক্ষের শুরুতেই কাকভোরে উদাত্ত কন্ঠে চণ্ডীপাঠ শুনবেন বলে বোধ করি দেবতারাও রাত পোয়ানোর অপেক্ষায় থাকেন। আজকের এই প্রতিবেদন সেই অসাধারণ শিল্পীর প্রতি এক আন্তরিক শ্রদ্ধার্ঘ্য।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জন্ম ৪ আগস্ট ১৯০৫ সালে কলকাতার আহিরিটোলার এক ভাড়া বাড়িতে। রায়বাহাদুর কালীকৃষ্ণ ভদ্র এবং সরলাদেবীর কনিষ্ঠ সন্তান বীরেন্দ্র। বীরেন্দ্ররা ছিলেন দুই ভাই ভুপেন্দ্র আর বীরেন্দ্র। রায়বাহাদুর কালীকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন একজন স্বনামধন্য ভাষাবিদ। ১৪টি ভাষার উপর তাঁর দখল ছিল। বীরেন্দ্র একটু বড়ো হতে না হতেই পরিবারের সবাই ৭ নম্বর রামধন মিত্র লেনে বীরেন্দ্রর ঠাকুমার কেনা বাড়িতে চলে যান। ঠাকুমা যোগমায়া দেবী পাঞ্জাবের নাভা স্টেটের মহারানীর গৃহশিক্ষিকা ছিলেন। তাঁর ইংরেজি ও সংস্কৃতে খুব ভালো জ্ঞান ছিল। তৎকালিন সময়ের নিরিখে তাঁকে উচ্চশিক্ষিতা বলা চলত। টাউন স্কুলে পড়াকালীন বীরেন্দ্রের ঠাকুমার কাছেই সংস্কৃত উচ্চারণ শেখা শুরু। ঠাকুমা তাঁর ছোটো নাতিকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।
ছোটো থেকেই বীরেন্দ্র ছিলেন ভয়ানক দুষ্টু। দুষ্টুমির পদ্ধতিও ছিল তাঁর অভিনব। একবার স্কুলে নকল টিকি চুলের সঙ্গে বেঁধে এমন ভঙ্গিমা করছিলেন যাতে মনে হবে উনি গরুর লেজ দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছেন। কপালমন্দ, মাস্টারমশাই দেখে ফেলেন। ফলে উত্তম-মধ্যম জোটে। বীরেন্দ্রর সহপাঠীরাও ছিলেন তথৈবচ। রামধন মিত্র লেনে বাড়ির ফলকে লেখা ছিল কে কে ভদ্র। বীরেন্দ্রর বন্ধুরা দুষ্টুমি করে তার পাশে খড়ি মাটি দিয়ে লিখেছিলেন, ‘বীরেন ছাড়া সবাই।’
টাউন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন বীরেন্দ্র। কিছুতেই তিনি অঙ্কের ধার পাশ দিতে হাঁটতে চাইতেন না। ম্যাট্রিক পাশ করার পর অঙ্কের বই সব গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে বলেন, ‘পাটিগণিত ও বীজগণিতকে সব জ্বালা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিলাম।’ ১৯২৬ সালে ইন্টার মিডিয়েট পাশ করার পরে ১৯২৮ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক। পাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই চাকুরি পাওয়া। ১৯২৮ সালের গোড়া থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়েতে চাকরি। চাকরি করতে করতেই নলিনীকান্ত সরকারের সূত্রে আকাশবাণীর সঙ্গে পরিচয়। তৎকালীন সময়ে কলকাতার অফিসে দুপুরে একটা বিরতি দেওয়া হত। সেই বিরতির সময় ও অফিস শেষে নিয়মিত হাজিরা দিতেন আকাশবাণীতে। সেই বছরের ২১ আগস্ট বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পরিচালনায় রেডিওতে পরিবেশিত হল নাটক পরশুরামের ‘চিকিৎসা সঙ্কট’। অপূর্ব সুন্দর এক হাসির উপস্থাপনা। ততদিনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বুঝতে পেরেছেন যে অফিস তাঁর জন্য নয়। চাকরি ছেড়ে পাকাপাকিভাবে চলে এলেন রেডিওয়। অসাধারণ বাগ্মিতায় তিনি মহিলামহলে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯২৯ সালে মেঘদূত ছদ্মনামে ‘মহিলা মজলিশ’, ভগিনী নিবেদিতা, 'সাবিত্রী', 'দ্রৌপদী' রচিত হল। বলা বাহুল্য প্রত্যেকটি শ্রোতারা গ্রহণ করল খোলা মনে। ১৯২৯ সালে আকাশবাণী থেকে প্রকাশিত হল ‘বেতার জগৎ’। সেখানেও ব্যবস্থাপনায় নলিনীকান্ত সরকার আর উৎসাহ উদ্দীপনায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
কিছুদিনের মধ্যেই বাণীকুমার রচিত এবং পঙ্কজকুমার মল্লিকের সুরারোপিত একটি দেড়ঘণ্টার প্রভাতী অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি পর্ব চলতে থাকে। ১৯৩২ সালে ষষ্ঠীর দিন এই অনুষ্ঠানের সূচনা হলেও পরের বছর থেকে দেবীপক্ষের সূচনার দিন ভোরে এটি সম্প্রচারিত হতে শুরু করে। প্রথম বছরেই বোঝা গিয়েছিল বীরেন্দ্রবাবু ও অন্যান্য শিল্পীদের সমন্বয়ে প্রস্তুত এই অনুষ্ঠানের সাফল্য শুধু সময়ের অপেক্ষা। মূলত তর্পণ করতে যাওয়া মানুষজনের কথা ভেবেই এই অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ ও সময় ঠিক করা হয়েছিল। প্রথমদিকে বেশ কয়েকবছর ‘লাইফ’ অনুষ্ঠান হত। তখনও রেকর্ডিং ব্যবস্থা চালু হয়নি। সুতরাং, সবাইকে স্টুডিওতে উপস্থিত থাকতে হত। গায়ক, গায়িকা, বাজনদাররা অনেকেই রাতে স্টুডিওতে থেকে যেতেন। তবে গোড়া থেকেই আকাশবাণীর গাড়ি ঠিক রাত দুটোর সময় বীরেন্দ্রকৃষ্ণকে নিতে আসত। বীরেনবাবু স্নান করে পাট ভাঙা ধুতি পাঞ্জাবি পরে রওনা হতেন। সাবধানী মানুষটি অনুষ্ঠানের গুরুত্ব মাথায় রেখে আগের দিন নামমাত্র আহার করতেন। ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠানের কিছু রদবদল করে নামকরণ হয় 'মহিষাসুরমর্দিনী'।
সবাইকে নির্দেশ দেওয়া থাকত অনুষ্ঠানের দিন শুরুর অন্তত আধঘণ্টা আগে সবাই যে যার নির্ধারিত জায়গায় বাদ্যযন্ত্র সমেত বসে পড়বে। বীরেনবাবু সাধারণত রাত ৩টে বাজার আগেই স্টুডিওতে পৌঁছে যেতেন। কিন্তু ছন্দপতন হল একবারই। ১৯৪২ সালে মহালয়া অনুষ্ঠানের শুরুর প্রাক্কালে দেখা গেল সবাই হাজির, কিন্তু বীরেন্দ্রবাবুর দেখা নেই। উত্তেজনায় পঙ্কজবাবু কী করবেন আর কী করবেন না সেটাই ঠিক করতে পারছিলেন না। ঠিক সেই সময় এক তরুণ বাচিকশিল্পী, সেই বছরেই ঘোষক হিসেবে আকাশবাণীতে যোগদান করা নাজিব আহমেদ এসে বলেন, ‘আমি স্কুলে থাকতে সংস্কৃতে খুব পাকা ছিলাম। স্কুল ছাড়ার শেষ পরীক্ষায় লেটার মার্কস পেয়েছি। আমায় একবার সুযোগ দিন।’ এটা সত্যি যে বিএসসি পাশ করা নাজিবের গলাটা ছিল সুন্দর। কিন্তু তাঁর সংস্কৃত উচ্চারণ সম্পর্কে কারও কিছু ধারণা ছিল না। পঙ্কজবাবু খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে একবার বসছেন পরক্ষণেই উঠে দাঁড়াচ্ছেন। সময় চলে যাচ্ছে দেখে নাজিবকে বলেই বসলেন ‘বল দেখি দু’লাইন।’ নাজিবের গলা ও উচ্চারণ শুনে ভালো লাগলো বটে কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল বীরেন ছিল কায়স্থ। তাঁর চণ্ডীপাঠ নিয়ে তো ব্রাহ্মণ সমাজ আপত্তি কম করেনি। এবার নাজিবের কথা জানাজানি হলে তো রক্ষেই থাকবে না। পঙ্কজবাবু কিছুতেই মনস্থির করতে পারছিলেন না, কিন্তু সহকর্মীরা সবাই সাহস জোগালেন। সবার রায়, উপয়ান্তর না থাকায় নাজিবকে দিয়েই শুরু হোক অনুষ্ঠান। তবে এই প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ যে নাজিবকে দিয়ে চণ্ডীপাঠ করানোর কাহিনী কিন্তু আকাশবাণী সরকারিভাবে সমর্থন করেনি। বরঞ্চ তারা সর্বদাই অস্বীকার করে এসেছে।
সাড়ে ৪টে বেজে যাবার পর হন্তদন্ত হয়ে আকাশবাণীতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের প্রবেশ। জানা গেল গাড়ি হঠাৎ বিকল হয়ে যাবার জন্যই এই বিপত্তি। আকাশবাণী ভবনের সিঁড়িতেই অবাক হবার পালা বিরূপাক্ষের। কী হল! চমৎকার চণ্ডীপাঠ করছে ছেলেটি কে? অনুষ্ঠান শেষ হল। বীরেন্দ্রবাবু সব কিছু শুনলেন, জানলেন। কিন্তু আকাশবাণীর শ্রোতারা কেউ কিছুই জানল না। কারণ সম্প্রচারের শেষে বা গোড়ায় নাজিবের নামটি উচ্চারিত হয়নি। লোক জেনেছিল বীরেনবাবুই পাঠ করেছেন। অত্যন্ত উদার মনোভাবের মানুষ ছিলেন স্বয়ং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৪৩ সালে মহালয়ার বেশ কিছুদিন আগেই বলে দিলেন, ‘পঙ্কজদা নাজিব উঠতি শিল্পী। আমরা বুড়োরা আর ক’দিন? সর্বোপরি ওর গলাটাও খাসা। আমি সঠিক সময়ে উপস্থিত থাকব কিন্তু পাঠ নাজিব পড়বে।’ পঙ্কজবাবু কথা বাড়াননি। জানতেন তাতে লাভ হবে না। ১৯৪৪ এবং ৪৫ সালে পঙ্কজবাবু আকাশবাণীর সঙ্গে ছিলেন না। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মনোমালিন্য হবার জন্য সরে যান। হেমন্তবাবু এলেন পঙ্কজবাবুর জায়গায়, তিনি নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেও নাজিবকে নিয়ে কিছু করাতে যাননি। ১৯৪৬ সালে, আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ পুনরায় পঙ্কজবাবুকেই ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
১৯৪৭ সাল স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে দেশভাগ হল। নাজিব চলে গেলেন পূর্ব পাকিস্তানে। ঢাকা বেতার কেন্দ্রে পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নিলেন তিনি। নাজিব আহমেদ ও নীলিমা সেনের কণ্ঠে ‘কচ ও দেবযানী'র কথা জীবন্ত হয়ে আজও অসংখ্য শ্রোতার অন্তরে বিরাজ করে। ১৯৬৬ সালে 'মহিষাসুরমর্দিনী'র লাইফ অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল। রেকর্ডিং বাজানো শুরু হল। কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবুর ভোরের রুটিনে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তিনি একইরকম ভাবে কাকভোরে স্নান করে কাচা কাপড় পরে আকাশবাণী ভবন চলে যেতেন। কিন্তু পরিবর্তন হল বা বলা চলে পরিবর্তনের জন্য পরিবর্তন করা হল। ১৯৭৬ সালে সে বছর হেমন্তকুমারের সুরারোপিত দেবী দুর্গতিহারিনীম মহালয়ার দিন ভোর চারটেতে অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতা ও মুম্বইয়ের শিল্পীদের নিয়ে তৈরি এই অনুষ্ঠান ‘উত্তমকুমারের মহালয়া’ নামে পরিচিত ছিল। প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়ে কর্তৃপক্ষ সেই অনুষ্ঠান বাতিল করতে বাধ্য হন। সেই বছরই ষষ্ঠীর দিন বেতারে পুনরায় 'মহিষাসুরমর্দিনী' অনুষ্ঠিত হয়। সেই থেকে আজও চলছে সগৌরবে, মাথা উঁচু করে। সেই বছর, বীরেনবাবু সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে চলে যান গঙ্গার ঘাটে। চুপচাপ বসে ছিলেন। ফেরার সময় একজন সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, অনুষ্ঠান কেমন লাগল? উত্তরে মানুষটির বক্তব্য ছিল, ‘কেন? ওরা তো ভালোই করেছে।’ ঘনিষ্ঠমহলে অবশ্য আক্ষেপ করেছিলেন যে ওরা একবার আমায় জানাল না! জানালে কী আমি বাধা দিতাম? প্রসঙ্গক্রমে জানাই বীরেন্দ্র নিজে অসাধারণ চণ্ডীপাঠ করলেও তাঁকে কখনোই ঠাকুরের সামনে বসে একটা ধূপ জ্বালাতেও কেউ দেখেনি। এই প্রসঙ্গে ওঁর মেয়ের বক্তব্য ছিল যে বাবা বলতেন ভক্তি মনে, সবাইকে দেখানোর জন্য নয়।
বীরেনবাবুর বহুমুখী প্রতিভা ছিল। তিনি সুন্দর ধারাবিবরণী দিতেন। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট বেলা বারোটা বেজে তেরো মিনিট বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমৃতলোকে যাত্রা করলেন। বেতার কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা অনুযায়ী শেষ যাত্রার ধারাবিবরণী রেডিওয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছিল। অনেকেই স্বীকার করেছিলেন যে সেদিনের সেই আবেগঘন ধারাবিবরণীতে শ্রোতাদের সকলেই চোখের জল বাঁধ মানতে চাইছিল না। পরবর্তীকালে তিনি তারাশঙ্কর ও বিধান রায়ের অন্তিম যাত্রার ধারাবিবরণী দেন। একইরকম সুন্দরভাবে।
ফিরে আসি 'মহিষাসুরমর্দিনী'র প্রসঙ্গে। এই অনুষ্ঠানটি অন্য একটি দিকে থেকেও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নীরবে একটি বাণী প্রচার হয়, যে শারদ উৎসবে ভুলেও জাতপাত বা বামুন কায়েত বিচার করতে যাবেন না। মহালয়া দিয়ে যে দেবীপক্ষের সূচনা, এই দিনের সকালের অনুষ্ঠান মহিষাসুরমর্দিনী প্রকৃত অর্থেই ছিল সর্বধর্মের সমন্বয়। বাদ্যযন্ত্র শিল্পীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন মুসলিম। যেমন সারেঙ্গী নিয়ে বসতেন মুন্সী। চেলো নিয়ে তাঁর ভাই আলি, হারমোনিয়ামে বসতেন মহম্মদ। নাজিব আহমেদের চণ্ডীপাঠের কথা তো আগেই উল্লেখ করেছি। সঙ্গে আরও একটি তথ্য জানার দরকার, অনুষ্ঠানের একেবারে শেষের দিকে উৎপলা সেনের গলায় একটা গান আছে ‘শান্তি দিলে ভরি’ এই গানের সুরকার কিন্তু হিন্দু নন, সুরকার উস্তাদ সাগরীউদ্দিন খাঁ।
শিল্পী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নাটক লেখা, অভিনয় ও পরিচালনা, হাস্যকৌতুক রচনা সব কিছুর মধ্যেই ছিল মুন্সীয়ানা। বিমল মিত্রের 'সাহেব বিবি গোলাম'-কে তিনি অপূর্ব নাট্যরূপ দেন। তাঁর রচিত ‘মেস নম্বর ৪৯’ খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। বিরূপাক্ষ ছদ্মনামে লেখা তাঁর হাস্যকৌতুকগুলির বাস্তবিকই জবাব নেই। তাঁর রচিত ‘বিরূপাক্ষের ঝঞ্ঝাট’, ‘বিরূপাক্ষের বিষম বিপদ’, ছোটদের জন্য ‘আতুপুতুর উপকথা’ হাস্যরসে অত্যন্ত উচ্চমানের।
বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের শেষে স্ত্রী পৃথিবী থেকে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আপনভোলা মানুষটিও কেমন যেন হারিয়ে গেলেন। মেয়ে সুজাতাকে প্রায় ডেকে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘হ্যাঁ রে তোর মা-কে যে অনেকক্ষণ দেখছি না।’ ১৯৯১ সালের পুজোর পরেই (৩ নভেম্বর) চিরবিদায় নিলেন হাসির রাজা এবং অসাধারণ শিল্পী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। জীবনের শেষ প্রহরে একটু অভিমান হয়েছিল মানুষটির। কেবলই বলতেন, ‘জানি সবাই ভুলে যাবে। কিন্তু বছরের অন্তত একটি দিন মনে করতেই হবে।’
এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে 'মহিষাসুরমর্দিনী'র চণ্ডীপাঠে মানুষটিকে বাঙালা ও বাঙালির অন্তরে চিরস্থায়ী জায়গা দিয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে এই অনুষ্ঠান কালোত্তীর্ণ হয়ে অমর ও অক্ষয় হয়ে থেকে গেল। শিল্পী বেঁচে থাকেন তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র তার ব্যতিক্রম নন। তাঁর কথা উত্থাপন হলেই আপামর জনতার মনে পড়বে তাঁর মাদকতাপূর্ণ গলায় সেই আওয়াজ—
আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে
উঠেছে আলোকমঞ্জীর;
ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা...
********************************************************************************************************************************
বাঙালির মহালয়া এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
(৪ আগস্ট, ১৯০৫-৩ নভেম্বর, ১৯৯১)
সুমন কল্যাণ চক্রবর্তী
তথ্যপ্রযুক্তি বাস্তুকার
‘মহালয়া’ নাম শুনলেই দুর্গাপুজোর গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন হিন্দু তথা বাঙালিরা; কারণ বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব হল দুর্গাপূজো। আর মহালয়া মানেই দুর্গাপুজোর দিন গোনা শুরু। মহালয়া শব্দটি ‘মহান’ ও ‘আলয়’ এই দুটি শব্দের সংমিশ্রণ। ‘মহান’ অর্থে ‘বৃহৎ’ বা বিশাল এবং ‘আলয়’ অর্থে ‘গৃহ’ বা বাড়ি। মহালয়ার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে, মহান আলোয় দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে চন্ডীপাঠের মধ্যে দিয়ে আহ্বান জানানো। দুর্গাপুজোর দুটি পক্ষের মধ্যে একটি হল পিতৃপক্ষ, অপরটি দেবীপক্ষ। পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে পার্বণ শ্রাদ্ধ ও তর্পণ করার আনুষ্ঠান বা রীতিকে বলে পিতৃপক্ষ। হিন্দুশাস্ত্র অনু্যায়ী, পিতৃপক্ষ হল পূর্বপুরুষদের তর্পণ করার জন্য একটি বিশেষ পক্ষ। আর, তর্পণ করার অর্থ হল ‘জলদানের মাধ্যমে পিতৃলােকের তৃপ্তি সাধন’। মহালয়া তিথিতে কোনো ব্যক্তি তাঁর পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে আত্মার শান্তি কামনা করার জন্য অঞ্জলি প্রদান করেন। সনাতন ধর্ম অনুযায়ী, এই দিনেই প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয়, তাকে ‘মহালয়’ বলে। আর ‘মহালয়’ থেকেই ‘মহালয়া’। পিতৃপক্ষেরও শেষ দিন এটি। পিতৃপক্ষের অবসান হয়ে দেবীপক্ষের সূচনা ঘটে বাংলায় ‘মহালয়া’ আসে; সূচনা হয় দুর্গাপুজোর। শরৎকালের দুর্গাপুজোর পূণ্যলগ্নই হল ‘শুভ মহালয়া’।
যার চন্ডীপাঠ না হলে বাঙালির মনে হয়ত মা দুর্গার আরাধনা অসম্পূর্ণ থেকে যেত ও যাকে ছাড়া মহালয়ার ভোরকে উপভোগ বা কল্পনা করা বাঙালির পক্ষে অসম্ভব, এবং যিনি ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-কে বেতারের মাধ্যমে চন্ডীপাঠ রূপে উপস্থাপন করে বাঙালির হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন, সেই বাচিক শিল্পী, নাট্যকার, লেখক, অভিনেতা এবং অবশ্যই বিশেষ বেতার সম্প্রচারক হলেন শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। কলকাতার আহিরীটোলায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবুর জন্মগ্রহন করেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবুর ডাকনাম ছিল ‘বুশি’। তার মায়ের নাম সরলাদেবী; এবং বাবা রায়বাহাদুর কালীকৃষ্ণ ভদ্র যিনি চোদ্দটি ভাষায় ভাষাতত্ত্ববিদ হিসেবে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবুর ঠাকুমা যোগমায়া দেবী (যিনি পাঞ্জাবের নাভা স্টেটের মহারানীর প্রাইভেট টিউটর ছিলেন)-র কাছ থেকে সংস্কৃত শিক্ষা এবং শেক্সপিয়ার ও গিরিশচন্দের নাটক শুনে এবং নিজস্ব স্মৃতিশক্তির জন্য মাত্র আট বছর বয়স থেকেই একনাগাড়ে অসাধারণ চন্ডীপাঠ করতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবু। ১৯২৬ সালে তিনি ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯২৮ সালে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক হন৷ স্নাতক হয়ে ১৯২৮ সালেই ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের ফেয়ারলি প্লেসের অফিসে চাকরিতে যোগদান করেন ঠিকই, তবে টিফিন ব্রেকে কিংবা বিকেলের অবসরে রেডিওর অফিসে গিয়ে বেতারের অনুষ্ঠানে যোগদান করতেন। বেতারের অনুষ্ঠানে আসর জমানোর গুণে মোহিত হয়ে স্টেশন ডিরেক্টর নৃপেন মজুমদার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবুকে রেলওয়ের চাকরি ছেড়ে রেডিওতে যোগদান করতে বলেন। ১৯৩০ সাল নাগাদ সম্পূর্ণরূপে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে যোগদান করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবু। প্রথমদিকে ‘মেঘদূত’ ছদ্মনামে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ‘মহিলা মজলিশ’ নামক একটি অনুষ্ঠান শুরু করেন বেতারে, যেখানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবুর কণ্ঠস্বর মহিলা মহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ফেলেছিল। পরবর্তীক্ষেত্রে বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবু ‘শ্রীবিষ্ণুশর্মা’ ছদ্মনামে বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা এবং শ্রোতাদের চিঠিপত্র পড়ে শোনাতেন রেডিওতে। চট জলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া ও উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে পরিস্থিতি সামলানোটা বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবুর বাঁ হাতের খেল ছিল বলে অনেক পুরানো রেডিও আর্টিস্টের মুখে শোনা যায়।
একসময়ে আকাশবাণীর একটি নিজস্ব কাগজ ছিল, যেটির নাম ‘বেতার জগৎ’। এই ‘বেতার জগৎ’-ই ছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবুর প্রাণ। একবার নাকি সরকার পক্ষ থেকে এই পত্রিকাটিকে বন্ধ করে দেওয়া হয়, তবুও বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবু কলকাতার জি.পি.ও-এর সামনে শীতকালের রাতে চাদরমুড়ি দিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এই পত্রিকাটিকে বিক্রিও করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবু ‘বীরুপাক্ষ’ ছদ্মনামে রেডিওতে প্রোগ্রাম করেছেন, তবে সেটি ব্যঙ্গরসের দৃষ্টিভঙ্গিতে। শোনা যায়, কোনো একটি বর্ষার দিনে রেডিওর কোনো এক শিল্পী অনুপস্থিত হওয়ায় শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে পিয়ানো বাজিয়ে এবং রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে নিজেই শিল্পী ও ভাষ্যকার হিসেবে চালিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় এবং উত্তমকুমারের প্রয়াণ যাত্রার ধারাবিবরণী তিনিই করেছিলেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বিকল্প আর কেউ হতে পারেনি, পারবেও না হয়ত!
জনপ্রিয় প্রভাতী অনুষ্ঠান ‘প্রাত্যহিকী’–র উপস্থাপক দেবাশিস বসুকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র নাকি বলেছিলেন, ‘জানো বাবা, একসময়ে এই রেডিওর জন্য অনেক কষ্ট করেছি। তোমরা একে বাঁচিয়ে রেখো।’ পরিচালক দেবনারায়ণ গুপ্ত নাকি অনেকবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে অভিনয়ের জন্য ডেকেছিলেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবু বার বার এড়িয়ে গেছেন এই প্রস্তাবটিকে; শুধু বলতেন, ‘আমি সকলকে রঙ মাখাবো, কিন্তু নিজে মাখব না।’ আকাশবাণীর একটি খবর থেকে জানা যায়, ১৯৩১ সালে অন্নপূর্ণা পুজো এবং বাসন্তী পুজো খুব কাছাকাছি পড়ায় এই দুই পুজোর মাঝখানে ‘দেবী বাসন্তেশ্বরী’ নামক একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক, বৈদ্যনাথ ভট্টাচাৰ্য্য (বাণীকুমার), বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, হরিশচন্দ্র বালি প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিরা। এই অনুষ্ঠানটি ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে যায় মানুষের কাছে। আর সেটা দেখে উৎসাহিত হয়েই আকাশবাণীর কর্তৃপক্ষ এই অনুষ্ঠানটিকে ‘চন্ডীপাঠ’ হিসেবে উপস্থাপনা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। পন্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রী, বাণীকুমারকে মার্কন্ডেয় পুরাণটা দেখিয়ে নাকি চন্ডীপাঠ করার জন্য বলেছিলেন, যেখান থেকেই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’–র উৎপত্তি। ১৯৩২ সালের দূর্গাপূজার ষষ্ঠীর দিন খুব ভোরবেলায় এই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটি প্রথম শুরু করা হয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র প্রতিবার মহালয়ার আগের দিন রাতে রেডিও স্টেশনে থেকে যেতেন, যদিও বাকী কলাকুশলীরা মোেটামুটি রাত দু–টোর পর থেকে আসা শুরু করতেন। প্রতিবার খুব ভোরবেলায় গঙ্গা স্নান করে, নতুন গরদের ধুতি ও পাঞ্জাবী পড়ে বীরেন্দ্রবাবু একটুখানি ধ্যান করে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটি শুরু করতেন। সেই ১৯৩১ সাল থেকে একটানা এই অনুষ্ঠানটি ‘লাইভ’ অনুষ্ঠান হিসেবে চলে আসলেও ১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িকতা জনিত কারণের জন্য ঐ বছর ‘লাইভ’ অনুষ্ঠানটি প্রচার করা যায়নি। তারপর থেকেই এই অনুষ্ঠানটিকে রেকর্ডিং–এর ভাবনা শুরু করে আকাশবাণীর কর্তৃপক্ষ। ১৯৬৬ সাল থেকে এই অনুষ্ঠানটির রেকর্ডিং ভার্সান শোনানো হয় আকাশবাণী থেকে।
প্রথম প্রথম চন্ডীপাঠের অংশটি সুর ছাড়াই কথ্যভঙ্গিতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র পাঠ করতেন রেডিওতে। একবার স্টুডিওতে এক বিশেষ রসিকতার ছলে স্তোত্রের সুরের অনুকরণে চন্ডীপাঠ শুরু করলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র৷ কলাকুশলীদের মধ্যে একটু হাসির ভাব জাগলেও বাণীকুমার দ্রুত রেকর্ডিং রুম থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিলেন, ‘আরে থামলে কেন? বেশ তো হচ্ছিল।’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবু বলেন, ‘আরে না না, মজা করছিলাম একটু।’ কিন্তু বাণীকুমার গভীর আগ্রহ নিয়ে বলেছিলেন, ‘হোক হোক, ঐ ভাবেই আবার করো তো। সেই বার থেকেই আকাশবাণীতে শুরু হল এক অভিনব ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানটি শুরু হওয়ার পর প্রথম দিকে ষষ্ঠীর দিন ভোরবেলায় অনুষ্ঠিত হলেও পরে সেটি মহালয়ার দিনে খুব ভোরে শোনানো শুরু করা হয় পাকাপাকিভাবে। এই অনুষ্ঠানটির প্রথম দিকে কৃষ্ণ ঘোষ, বিমলভূষণ, আভাবতী, প্রফুল্লবালা, বীণাপানি প্রমুখ বিখ্যাত শিল্পীরা ছিলেন, যারা হয়ত তেমন প্রচার না পেয়ে অগোচরেই রয়ে গেছেন। তার পরবর্তীতে অবশ্য এসেছেন দ্বিজেন মুখােপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখােপাধ্যায়, সুপ্রীতি ঘোষ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পীরা। সেই সময়ে মহালয়া অনুষ্ঠানের আগের থেকে পুরো স্টুডিওকে ফুল দিয়ে সাজানো হত, জ্বালানো হত ধূপ-ধূনো, ঠিক যাতে ১ নং, গাস্টিং প্লেসের ঐ স্টুডিওটিতে পুজোর পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
১৯৭৬ সালে আকাশবাণীর কর্তৃপক্ষ চিরাচরিত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বরের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-কে পাল্টে ‘দেবী দুর্গতিহারিণী’ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেয় একটি গোপন বৈঠকের মাধ্যমে, যেখানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে বাদ দেওয়া হয়। সেই পরিবর্তিত স্ক্রিপটি লিখেছিলেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের ‘হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট, ডঃ গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়। এই অনুষ্ঠানটিতে স্তোত্র পাঠ করানো হয়েছিল মহানায়ক উত্তমকুমারকে দিয়ে। এই অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর প্রমুখ শিল্পীরা। শোনা যায়, এই অনুষ্ঠানটির আগের দিন রাতে স্বয়ং উত্তমকুমার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বাড়িতে গিয়ে ওঁনাকে বলেছিলেন, ‘তিনি এই অনুষ্ঠানটি করতে চান নি।’ তখন নাকি উত্তমকুমারকে উৎসাহ দিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবু বলেছিলেন, ‘কেন করবেন না আপনি? অবশ্যই করুন। নতুন কিছু তো করা দরকার, আমি আপনার পাশে আছি।’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মনে কোনোদিনই কোনোরকম ইগোও ছিল না। সেইবারের উত্তমকুমারের স্তোত্রপাঠ, মহালয়ার দিন ভোরবেলায় নিজের বাড়িতে বসে শুনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবু তাঁর নিজের ছেলেকে বলেছিলেন, ‘জনতা যদি নিতে চায় নেবে। উত্তমকুমারের স্তোত্রপাঠ হতে না হতেই বাঙালির সেন্টিমেন্টে ঘা পড়ল, উঠল সমালোচনার ঝড়। বেতার অফিস ভাঙচুর হল। মাথা গরমে নিজেদের রেডিওকে বাড়ির জানালা থেকে ছুঁড়ে ফেললেন অনেক লোক। খালি ইট মারা বাকি ছিল সেদিন! বিশ্রী অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছিল সেদিন বেতার কর্তৃপক্ষকে। জনমানবের স্বার্থে সেই বছর পুনরায় ষষ্ঠীর দিন ভোরবেলায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বরের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-কে রেডিওতে শোনানো হয়েছিল। এক্ষেত্রে উত্তমকুমার কিন্তু বলেছিলেন, ‘ঠাকুরঘরকে রেনোভেট করে ড্রয়িং রুম বানালে যা হয়, তাই হয়েছে।’
চাকরি জীবনে অবসর গ্রহণের পরে কোনো একটি কাজে একবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র রেডিও স্টেশনে ঢুকতে গেলে বাধা দেয় একজন সিকিউরিটি গার্ড। সে বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবুর কাছে ‘পাস’ চেয়ে বসে। সেই শুনে বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবু রাগে চিৎকার করে বলেন, ‘জন্ম দিয়েছি রেডিওকে আমি। জন্ম দিয়েছি। আমিই জন্ম দিয়েছি। আমার কাছে পাস চাইছ।’ শোনা যায়, এই ঘটনার পর থেকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবু আর কোনোদিনই নাকি রেডিও স্টেশনে পা মাড়াননি৷ বেতার কর্তৃপক্ষ বীরেন্দ্রকৃষ্ণবাবুর বাড়িতে এসে তাঁকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করলেও তিনি তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত আর কোনোদিনই রেডিও স্টেশনে যাননি। বর্তমানে পাড়ায় মাইক লাগিয়ে বক্স বাজিয়ে মহালয়া শোনানো হয়। কিন্তু ভোরবেলায় রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সেই গলার চন্ডীপাঠ শোনার মর্যাদা ও মজাটাই যে আলাদা সেটা হয়ত অনেকে বোঝেন না। বাবা, মা, ঠাম্মাদের দেখেছি মহালয়ার দিনে কত মনযোগ দিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠের চন্ডীপাঠ শুনতেন তাঁরা।
একবার একটা অভিযােগ উঠেছিল, ‘কায়স্থ সন্তান হয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র কিভাবে চন্ডীপাঠ করবেন?’ বাণীকুমার ও পঙ্কজ কুমার মল্লিক পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছাড়া মহিষাসুরমর্দিনী অসম্ভব, বীরেন্দ্রবাবুই ছিলেন, আর উনিই থাকবেন।’ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বরের চন্ডীপাঠ মহালয়া তথা দুর্গাপূজার ইউ.এস.পি হিসেবে আজও পরিচিত। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ এই অনুষ্ঠানটিতে যন্ত্রশিল্পীদের মধ্যে হিন্দু ছাড়াও মুসলমান শিল্পী ছিলেন বলে জানা যায়। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র শ্লোকের তরঙ্গে কণ্ঠ মাধুর্যে ঐতিহ্যবাহী মহালয়া বারে বারে স্মরণ করিয়ে দেয় একটি মাত্রই নাম ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র’। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের শেষ জীবনটা খুব কষ্টের ছিল। রেডিওতে তিনি স্টাফ আর্টিস্ট হয়ে অবসর নিয়েছিলেন বলেই তাঁর কোনো পেনশন ছিল না। অবসরের পরে ‘মহাভারতের কথা’ অনুষ্ঠানটির জন্য যৎসামান্য টাকা পেতেন। শেষে অর্থাভাব মেটানোর জন্য পাড়ায় পাড়ায় অনুষ্ঠানের উদ্ধোধন করে বেড়াতেন তিনি। সারাজীবন রেডিও কিংবা অনুষ্ঠান করে তাঁর কপালে তেমন টাকা-পয়সা জোটেনি, জুটেছে কেবল অসংখ্য উত্তরীয় ও শংসাপত্র। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জীবনের শেষদিকে স্মৃতি কমে গেছিল, যার জন্য তিনি অনেককেই ঠিকঠাক চিনতে পারতেন না। তবু মাঝে মধ্যে ব্যাক ব্রাশ করা চুল, টিকালো নাক ও রোগাটে গড়নের ঐ ব্যক্তি একটা কথা বলতেন, ‘সারাবছর কেউই আমার দিকে ফিরে তাকাবে না হয়ত, কিন্তু বছরের একটি সময়ে আমাকে মানুষ ঠিক মনে করবে।’
ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments