ব্যাকওয়াটারে নৌকায় ভেসে
চলার মজাই আলাদা
প্রীতিময় রায়বর্মন
কেরা আলয়ম বা নারকেলের দেশ। কেরা আলয়ম থেকেই কেরল নামের উৎপত্তি। বলা হয় ‘গড ওন কান্ট্রি’। ঈশ্বরের নিজের দেশ। আবার প্রাচ্যের ভেনিসও বটে। পাহাড়, জঙ্গল, সি-বিচ, ব্যাকওয়াটার— কী নেই! ভিলেজ ব্যাকওয়াটারে বিসালবহুল নৌকায় ভেসে চলার মজাই যে আলাদা।
রুটম্যাপ: তিরুবনন্তপুরম–কন্যাকুমারী–ভারকালা–কোল্লাম–আলাপূজা–কোট্টায়াম–কোচি–পেরিয়ার–মুন্নার
তিরুবনন্তপুরম
একটা সময় নাম ছিল থিরুঅনন্তপুরম। অর্থাৎ পবিত্র অনন্তনাগের শহর। বর্তমানে কেরলের রাজধানী। সমুদ্র আর পাহাড়ে ঘেরা। ১৭৫০ সালে ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যের রাজধানী পদ্মনাভপুরম থেকে চলে আসে ত্রিবান্দ্রমে। এখন সেই ত্রিবান্দ্রমই তিরুবনন্তপুরম। পুরনো দিনের প্যাগোডাকৃতি ছাঁদের বাড়িগুলো বেশ নজরকাড়া। প্রাচীনত্ব আর আধুনিকতার যেন মিশেল ঘটেছে এখানে। মন্দিরদর্শন দিয়েই বেড়ানো শুরু হলে মন্দ হয় না। যাব শ্রীপদ্মনাভস্বামী মন্দির। অনন্তনাগের ওপর অনন্তশয্যায় শায়িত ভগবান পদ্মনাভস্বামী বা বিষ্ণু। মাথার ওপরে অনন্তনাগের ফণা আর পায়ের কাছে বসে দেবী লক্ষ্মী। শোনা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই বিষ্ণুমূর্তিটি জঙ্গল থেকে এনে গৃহদেবতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন ত্রিবাঙ্কুরের রাজা।
প্যাগোডাকৃতি ছাদ আর দ্রাবিড়শৈলীতে নজরকাড়া স্থাপত্যর এক নিদর্শন এই মন্দির। গ্রানাইড পাথরের সূক্ষ্ম কারুকার্যে ৩৬৮টি স্তম্ভের ওপর মূল মন্দির কুলক্ষেরা। সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশপথে রয়েছে সোনায় মোড়া সেগুন কাঠের মিনার। রয়েছে ২৮টি মনোলিথিক স্তম্ভ। পাশেই পদ্মতীর্থম সরোবর। প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল ও অক্টোবর-নভেম্বর মাসে দশ দিন ধরে এখানে চলে উৎসব। কাছেই সিভিএন কালারি সঙ্গম। আয়ুর্বেদিক ম্যাসাজ সেন্টার। চাইলে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকদের পরামর্শও পেতে পারেন। ম্যাসাজের পাশাপাশি এখানে শরীরচর্চারও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। শহর থেকে ১৬ কিমি দূরে কোভালম সৈকত। কোভালম অর্থাৎ নারকেল গাছের সারি। সৈকত জুড়ে নারকেল গাছের সারি। পাশেই তাল, পেঁপে আর কলাগাছ। রুপোলি বালির নিরালা সৈকতে আছড়ে পড়ছে নীল জলরাশির ছোট ছোট ঢেউ। ১৯৩০ সালে ইউরোপীয়রা প্রথম এখানে আসতে শুরু করেছিলেন। সমুদ্রতীরের লাইট হাউস। সৈকতে আয়ুর্বেদিক ম্যাসাজ পার্লারও রয়েছে।
কোভালম সৈকত থেকে ঘুরে আসতে পারেন ১০ কিমি দূরের দু’হাজার বছরের পুরনো পরশুরাম মন্দির থেকে। এবার আমাদের গন্তব্য স্বাস্থ্যনিবাস হিসেবে খ্যাত পোনমুডি। তিরুবনন্তপুরম থেকে সড়কপথে দূরত্ব ৫৪ কিমি। পশ্চিমঘাট পর্বতের কোলে ৩,০০২ ফুট উচ্চতায় রাবার, ইউক্যালিপটাস, বিভিন্ন ফুলের গাছে মোড়া পাহাড়িপথ। রয়েছে অবিরাম ঝর্নাধারা। এখান থেকে সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়ের দৃশ্য চমৎকার। চাইলে ট্রেকিংও করা যায়। পোনমুডি থেকে ঘুরে আসতে পারেন পিপ্পারা ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি থেকে। দেখবেন অগস্ত্যক্রোড়ম। ১,৮৬৯ মিটার উচ্চতায় সহ্যাদ্রীর সবচেয়ে নজরকাড়া শৃঙ্গ। শোনা যায়, অগস্ত্য মুনি এখানে তপস্যা করেছিলেন। ব্রিটিশ বিজ্ঞানী অ্যালেন ব্রাউনের গড়ে তোলা পর্যবেক্ষণাগারটি আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এখানে প্রচুর পরিমাণে ভেষজ উদ্ভিদ রয়েছে বলে কেরল সরকার এটিকে বায়োলজিক্যাল পার্ক হিসেবে ঘোষণা করেছে। অর্কিড ও অন্যান্য গাছপালার পাশাপাশি দেখা মেলে রংবেরঙের পাখির। এ স্থানের পরিবেশ এতটাই মনোরম যে স্থানটির দখল নিয়ে ব্রিটিশ শাসনকালে ত্রিবাঙ্কুর ও তামিলনাড়ুর প্রশাসকদের মধ্যে মামলা ইংল্যান্ডের আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। রায় গিয়েছিল ত্রিবাঙ্কুরের পক্ষে। তিরুবনন্তপুরম থেকে ৬১ কিমি দূরে বোনাচূড় থেকে হাঁটাপথে অগস্ত্যক্রোড়ম। এখানে যাওয়ার সবচেয়ে ভাল সময় ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল। যেতে হলে কেরল বন দপ্তরের অনুমতি প্রয়োজন। এবার একটু ঢুঁ মেরে নেওয়া যাক সংগ্রহশালায়। নেপিয়ার জাদুঘর। তিরুবনন্তপুরম সেন্ট্রাল রেল স্টেশন থেকে দূরত্ব ২ কিমি। মাদ্রাজের প্রাক্তন রাজ্যপাল জন নেপিয়ারের নামে নামকরণ। ১৯ শতকে তৈরি এই সংগ্রহশালায় রয়েছে দুষ্প্রাপ্য মন্দিরের রথ, প্রাচীন ব্রোঞ্জমূর্তি, অলঙ্কার, হাতির দাঁতের তৈরি নানা সামগ্রী ইত্যাদি। চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন, কে সি পানিক্কর গ্যালারি, শ্রীচিত্র আর্ট গ্যালারি, প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর ইত্যাদি নিয়ে মোট ৮০ একর এলাকা জুড়ে পার্ক ভিউ।
কন্যাকুমারী
ভারতের শেষ বিন্দু। স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতিমাখা মহামিলনের কেন্দ্র। দু’পাশে দুই সাগর। বঙ্গোপসাগর আর আরব সাগর। সামনে ভারত মহাসাগর। মূল ভূখণ্ড থেকে ৫০০ মিটার জলপথে বিকেকানন্দ রক মেমোরিয়াল। তিরুবন্তপুরম থেকে ১০০ কিমি দূরে কন্যাকুমারীতে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত লঞ্চ যাচ্ছে বিকেকানন্দ রক মেমোরিয়ালে। পাথুরে টিলার ওপর রক টেম্পল। ব্রোঞ্জের অবয়বে দাঁড়িয়ে স্বামী বিবেকানন্দ। ১৮৯২ সালে ২৪-২৬ ডিসেম্বর এখানে তপস্যা করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। আরও এক বিশাল পাথরখণ্ডে তামিল কবি থিরুভাল্লুভারের ১৩৩ ফুট উঁচু মূর্তি।
সমুদ্রতীরে কন্যাকুমারী মন্দির। চোখ জুড়ানো সাজসজ্জা দেবীর। দেবীর নাকের হীরকখণ্ডের চমক সমুদ্র থেকেও দেখা যায়। মন্দির চাতাল থেকে প্রতি পূর্ণিমায় একই সঙ্গে সূর্যাস্ত ও চন্দ্রোদয় দেখা যায়। গান্ধীজির চিতাভস্ম কন্যাকুমারীতে বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। তাঁর স্মৃতিতে তৈরি গান্ধীমণ্ডপম। এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে ২ অক্টোবর গান্ধীজির জন্মদিনে দুপুর ১২টায় সূর্যালোক মূর্তির মুখে পড়ে। কাছেই গান্ধী মিউজিয়াম। ঘুরে আসা যায় লাইটহাউস থেকেও। লাইটহাউসের ওপর থেকে ইন্ডিয়ান পেনেনসুলার শেষ প্রান্তটি কী চমৎকারই না লাগে! এ ছাড়া ৬ কিমি দূরে ১৮ শতকে পর্তুগিজদের তৈরি ভেট্টাকোট্টা, ১৩ কিমি দূরে সূচিন্দ্রম মন্দির, ১৯ কিমি দূরে নাগেরকয়েলে সর্পদেবতা মন্দির, রোমান ক্যাথলিক চার্চ, পাতালগঙ্গা ইত্যাদিও দেখে নেওয়া যায়।
ভারকালা
জড়িয়ে আছে এক পৌরাণিক কাহিনী। নারদ বেরিয়েছেন বিষ্ণুর উপাসনার জায়গা খুঁজতে, ভারকালায় এসে নারদ তাঁর ভাল্লাকালম বা বল্কল খুলে এখানেই বিষ্ণুর উপাসনার স্থান বাছেন। আর তা থেকেই নাকি জায়গাটির নাম ভারকালা। সূর্যস্নান আর সমুদ্রস্নানের জন্য বিখ্যাত ভারকালা তট। এখান থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্যও দেখার মতো। নিরিবিলিতে সময় কাটানোর জন্য আদর্শ ভারকালা তট। দেখে নিন এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দু’হাজার বছরের প্রাচীন বিষ্ণুমন্দির। তিরুবনন্তপুরম থেকে দূরত্ব ৫১ কিমি। এবার ঢুকে পড়লাম দুর্গে। আনজেঙ্গো দুর্গ। এখন এটি জাতীয় স্মৃতিসৌধ। দুর্গের দখল নিয়ে লেগেই থাকত সঙ্ঘর্ষ। কখনও দখল করেছে পর্তুগিজরা, আবার কখনও ওলন্দাজরা। সবশেষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৬৮৪ সালে তারা এই দুর্গকে কেরলের বাণিজ্যঘাঁটিতে পরিণত করে। ইতিহাসের সাক্ষী আর অন্য দিকে আশপাশের সৌন্দর্য উপভোগ। চারদিকে ছড়ানো-ছেটানো পুরনো দুর্গের ধ্বংসাবশেষ। দুর্গের ভেতর রয়েছে ১৭০৪ সালে তৈরি দেশের অন্যতম প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র।
এবারের গন্তব্য ভারকালা টানেল। ১৮৬৭ সালে ত্রিবাঙ্কুরের দেওয়ান স্যার টি মাধব রাও ৯২৪ ফুট লম্বা এই টানেলটি নির্মাণের কাজ শুরু করেন। তৈরি হতে সময় লাগে ১৪ বছর। ভারকালার পারাভুর শহরকে জনপ্রিয় করেছে পারাভুর হ্রদ। এর টানেই পর্যটকদের ছুটে আসা। হ্রদ গিয়ে পড়েছে সমুদ্রে, আর তাদের মাঝ বরাবর চলেছে সড়কপথ। আর আছে কপ্পিল হ্রদ। ভারকালা থেকে দূরত্ব ৪ কিমি। হ্রদের ওপরের ব্রিজ থেকে চোখ মেললে দিগন্ত আর প্রকৃতির সুন্দর মেলবন্ধন। চারদিকে দাঁড়িয়ে সারি সারি নারকেল গাছ। হ্রদে বোটিংয়ের ব্যবস্থা আছে। দেখবেন প্রায় দু’হাজার বছরের প্রাচীন জনার্দন স্বামী মন্দির। মন্দিরের সামনেই পাপনাশম সৈকত। এখানকার সৈকতে স্নান করলে নাকি ধুয়ে যায় সমস্ত পাপ! দেখতে পাবেন ওলন্দাজদের বাণিজ্যতরী থেকে ভেসে আসা ঘণ্টাটি। ভারকালায় টিলার মাথায় শিবগিরি মঠ। দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক শ্রীনারায়ণ গুরু শুরু করেছিলেন এই মঠ নির্মাণের কাজ। এখানেই রয়েছে তাঁর সমাধি। ৩০ ডিসেম্বর-১ জানুয়ারি তীর্থযাত্রার দিন বহু ভক্তের সমাগম ঘটে।
কোল্লাম
আগে নাম ছিল কুইলন। এখন কোল্লাম। এক সময় গুরুত্বপূর্ণ বন্দর বাণিজ্যকেন্দ্র। ব্যাকওয়াটার বা জলের দেশ। কাজুবাদাম আর মশলার দেশও বলা যায়। লেকের গা ঘেঁষে কাজু আর নারকেল গাছের সারি। শহর জুড়ে লাল টালির কাঠের বাড়ি। কোল্লাম মানেই ব্যাকওয়াটার ট্যুর। এর টানেই এখানে ছুটে আসা। বোটজেটির কাছেই পাবেন বুকিং অফিস। আট খাঁড়ি লেক অষ্টমুড়ির তীরেই কোল্লাম। চারদিকে নারকেল আর কাজুবাদামের গাছ। চাইলে লেকে নৌবিহারেও করা যায়। নারকেল গাছের ছায়ায় ঢাকা ছোট-বড় বেশ কিছু দ্বীপ রয়েছে। দেখতে পাবেন চীনামাটির পাহাড়। কোল্লামের বিখ্যাত মাতা অমৃতানন্দময়ী মিশন অমৃতাপুরী। কোল্লাম থেকে দূরত্ব ১০ কিমি। পরিবেশে যেন ধ্বনিত হয় গোটা বিশ্ব একই পরিবারের অঙ্গ। প্রতি রবিবার ও বৃহস্পতিবার প্রচুর মানুষ আসেন। প্রাচীন ইতিহাসের ঘটনাবলির সন্ধানে ঘুরে আসা যায় সাগরপাড়ের থেভ্যালি প্যালেস থেকে। এখন এখানে সরকারি দপ্তর। কাছেই মহত্মা গান্ধী সাগরবেলা। থেভ্যালি প্যালেস থেকে ৫ কিমি দূরে থঙ্গসেরি। মূলত পিকনিক স্পট। সোনার কয়েন দিয়ে বাণিজ্য চলত বলে এই স্থানের নাম ছিল সোনারগাঁ। ছিল পর্তুগিজদের বাণিজ্যবন্দর। সেই আমলের দুর্গ আর গির্জার ধ্বংসাবশেষ আজও রয়েছে।
১৯০২ সালে ব্রিটিশদের তৈরি ১৪৪ ফুট উঁচুতে অবস্থিত লাইটহাউসটি অবশ্যই দেখবেন। বিকেল ৩-৩০ থেকে ৫-৩০ পর্যন্ত লাইটহাউস খোলা থাকে। দেখে নিন ঘন জঙ্গলের মাঝে ষষ্ঠ মন্দির আচেনকয়েল। ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাস, এখানকার দেবমূর্তি খ্রিস্টাব্দের বহু আগেই প্রতিষ্ঠিত। কোল্লাম থেকে ১০ কিমি দূরে মায়ানাদ। ৯টি মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। এখানকার সুব্রামন্নার মন্দিরের শঙ্করাচার্যের মূর্তিটি সমসাময়িক। ঘুরে আসা যায় নারকেলের দড়ি ও নৌকা তৈরির জন্য বিখ্যাত সনরো দ্বীপ থেকে। কোল্লাম থেকে দূরত্ব ২৮ কিমি। স্নেক বোট (স্থানীয় নাম কেট্টুভল্লম) তৈরির জন্য খ্যাতি আছে। কোল্লাম থেকে ৩৫ কিমি দূরে ওছিরা। এখানে রয়েছে পরমব্রহ্ম মন্দির। জুন মাসে অনুষ্ঠিত হয় ওছিরাকাল্লি আর নভেম্বর-ডিসেম্বরে পানথ্রাডু ভিলাক্কু উৎসব। হাতে সময় থাকলে ঘুরে আসা যায় ৬৬ কিমি দূরে বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত ইকো-ট্যুরিজম পার্ক থেনমালা থেকে। এ ছাড়া কোল্লামে রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন গির্জা ও মসজিদ। উল্লেখযোগ্য গির্জাটি ১৭০০ সালে তৈরি পুল্লিচিড়া। দেখবেন মসজিদ চিন্নাক্কাড়া পল্লী, ১৫০৩ সালে তৈরি পর্তুগিজ দুর্গ ইত্যাদি। এ ছাড়া তিরুমুল্লাবরম তট, কোচুপিলামোড়ুর মহাত্মা গান্ধী বিচ ও পার্ক, কাজুবাদাম কারখানা ইত্যাদি দেখে নেওয়া যায়।
আলাপুজা
প্রাচ্যের ভেনিস। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়েছিলেন লর্ড কার্জন। আগে নাম ছিল আলেপ্লি। তিরুবনন্তপুরম থেকে ১৪৭ কিমি ও কোচি থেকে ৬৩ কিমি। খাল, খাঁড়ি, হ্রদ আর নদীর দেশ। পাশেই আরব সাগর। আলা মানে খাল আর পুজা মানে নদী। সত্যিই নামটি সার্থক। এক সময় ত্রিবাঙ্কুর রাজাদের বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। ভারতের সবচেয়ে বড় হ্রদ ভেম্বানাদ হ্রদ। ব্যাকওয়াটারে কে টি ডি সি-এর প্যাকেজ ট্যুরে হাউসবোটে ঘোরার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া নৌকা ও মোটর বোটও রয়েছে ব্যাকওয়াটারে ঘোরার জন্য। লঞ্চে চেপে ঘুরে আসা যায় হ্রদের বুকে নির্জন দ্বীপ পাথিরামালাম ও সবুজ দ্বীপ কুমারাকোম পক্ষীরালয় থেকে। শীতে এই পক্ষীরালয়ে স্টর্ক, ইগ্রেট, হেরন ইত্যাদি পাখির দেখা মেলে। এবার যাব আলাপুজা তট। মূলত পিকনিক স্পট হিসেবে খ্যাত। লাইট হাউস, বিজয়া বিচ পার্ক ও ১৩৭ বছরের পুরনো সমুদ্রের ওপরের লম্বা সাঁকোটি দেখার মতো। সমুদ্রের জলে যাতে চাষের খেত নষ্ট না হয়, তার জন্য বিশাল এলাকা জুড়ে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। আর-ব্লক। সমুদ্রতল থেকে অনেকটাই উঁচুতে চলেছে কৃষিকাজ। পাশেই বাসস্থান। পাশ দিয়ে খাল বয়ে চলেছে। সেখানে নৌকায় ঘোরার ব্যবস্থা রয়েছে। ৭৪০ সালে তৈরি কৃষ্ণপুরম প্রাসাদ। স্থাপত্য ও ভাস্কর্য বেশ নজরকাড়া।
মার্তণ্ডু বর্মার তৈরি প্রাসাদ। গজেন্দ্রমোক্ষ আখ্যানের ওপর দেওয়াল চিত্রগুলি তুলনাহীন। প্রাসাদের সংগ্রহশালায় রয়েছে ব্রোঞ্জের সামগ্রী, প্রাচীন ভাস্কর্য। মঙ্গল থেকে শনি, সকাল ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত প্রাসাদ খোলা থাকে। আলাপুজা থেকে ২০ কিমি দূরে কুমারাকোড়ি। মালয়ালম সাহিত্যের ‘কবি শেলি’ কামারানাসনের বাসস্থান ছিল এখানে। মূল শহর থেকে ৩২ কিমি দূরে নাগরাজা মন্দির। কেরলের সবচেয়ে বড় নাগদেবতার মন্দির। ঘুরে আসা যায় সারদা মন্দিরম থেকে। বিখ্যাত কবি ও বৈয়াকরণ এ আর রাজারাজা তাঁর বাসস্থান হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন এই সারদা মন্দিরম। তাঁর স্মৃতিধন্য এই বাড়িটি এখন কেরল সরকারের সাংস্কৃতিক দপ্তরের অধীনে। এ ছাড়া নৌকায় চেপে ঘুরে আসা যায় ১৮৭০ সালে তৈরি চম্পাকুলামের ম্যারি ফোরেন চার্চ থেকে। কাছেই কাঠের তৈরি ২ মিটারের যিশুমূর্তিও দেখা নিতে পারেন। আর আলাপুজা মানেই স্নেক বোট রেস। আলাপূজার সবচেয়ে বড় উৎসব। আগস্ট মাসের দ্বিতীয় শনিবার পম্পা নদীতে বসে স্নেক বোট রেসের আসর। ১৯৫২ সালে জওহরলাল নেহরু এই প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেছিলেন। বিজয়ীর হাতে তুলে দেওয়া হয় নেহরু ট্রফি।
কোট্টায়াম
১৮ শতকের মাঝামাঝি সময় থেক্কুমকুর রাজার রাজধানী ছিল কোট্টায়াম। আলেপ্পি থেকে ব্যাকওয়াটার সফরপথে কোট্টায়াম পৌঁছনো যায়। পশ্চিমঘাট আর ভেম্বানাদ লেকের মাঝে কোট্টায়াম। চারদিকে পর্ণমোচী আর চিরহরিৎ বৃক্ষের অরণ্য। চা, কফি, কোকোর পাশাপাশি বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এলাচ, গোলমরিচ, রবারের চাষ।
শহর জুড়ে রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীতে গড়া চার্চ। উল্লেখযোগ্য চেরিয়াপাল্লি, সেন্ট মেরিজ, ভালিয়াপাল্লি ইত্যাদি। এর্নাকুলাম থেকে কোট্টায়াম যাওয়ার সড়কপথে পড়ে এট্টুমানুর ও ভাইকুম মন্দির।
কোচি
মালাবার উপকূলের ব্যস্ত শহর। গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও তৈল শোধনাগার। আরব সাগর, ভেম্বানাদ লেক ও ব্যাকওয়াটারের মাঝে ছোট-বড় ১০টি দ্বীপ নিয়ে কোচি শহর। জনপ্রিয়তার কারণ ব্যাকওয়াটার। উইলিংডন দ্বীপ, বোলগেটি, গুন্ডু, ভাল্লারপদম, ফোর্ট কোচি দ্বীপগুলিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক সম্পদের মেলবন্ধন। রাজ্য পর্যটন দপ্তরের কন্ডাক্টেড ট্যুরে লঞ্চসফরে এগুলি ছাড়াও একে একে দেখা নেওয়া যায় ডাচ প্যালেস, সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ, জুইস সিনাগগ, চাইনিজ ফিশিং নেট ইত্যাদি। পর্তুগিজদের তৈরি হলেও পরে ওলন্দাজরা নতুন করে সাজিয়ে তোলে কোচি-রাজার মাত্তানচেরি প্রাসাদটি এবং নাম হয় ডাচ প্যালেস। দেওয়ালে আঁকা ছবিতে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ কাহিনী। সঙ্গে রাজাদের ব্যবহৃত জিনিসের প্রদর্শনী। প্রাসাদের পাশেই শিব, বিষ্ণু ও ভগবতী মন্দির।
কাছেই এক সময়ের ইহুদিদের গ্রাম জুইস টাউন। দেখবেন ১৫৬৮ সালে নির্মিত ইহুদিদের প্রার্থনা মন্দির জুইস সিনাগগ। শনিবার বন্ধ থাকে। অবশ্যই দেখবেন ফোর্ট কোচি দ্বীপে ভারতের প্রাচীনতম চার্চ সেন্ট ফ্রান্সিস। ভেম্বানাদ লেকে চীনা জেলেদের তৈরি চাইনিজ ফিশিং নেট। ঘুরে আসা যায় কোচি বন্দর থেকে।
কালাডি, আথিরাপল্লী ও ভাজাচলে: কালাডিতে আট শতকে জন্ম শঙ্করাচার্যর। পূর্ণা নদীর তীরে তাঁর মন্দির। আথিরাপল্লী বিখ্যাত জলপ্রপাতের জন্য। শোলোয়ার পাহাড়ের প্রায় ৮০ ফুট উঁচু থেকে নেমে আসা চালাকুডি নদীটিই জলপ্রপাত হিসেবে খ্যাত। ১০ কিমি দূরে জঙ্গলঘেরা ভাজাচলে। এ ছাড়া ঘুরে আসা যায় হিস্ট্রি মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালারি, হিল প্যালেস মিউজিয়াম। থাই কোট্টারাম অর্থাৎ মাতৃপ্রাসাদটিও বেশ সুন্দর। তিনতলায় অনন্তশয়ানে বিষ্ণু, লক্ষ্মীনারায়ণ, অর্ধনারীশ্বর, কৃষ্ণ ও নটরাজ বিরাজমান।
পেরিয়ার
কোল্লাম বা কুইলন থেকে বাসে বা ট্রেনে পৌঁছনো যায় পেরিয়ারে। পেরিয়ার নদীতে বাঁধ দিয়ে যে হ্রদের সৃষ্টি হয়েছে, তার পাশে প্রায় ৭৭৭ বর্গকিমির বিশাল এলাকা নিয়ে বিখ্যাত পেরিয়ার ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি। ১৮৯৯ সালে অভয়ারণ্যের মর্যাদা পায় এই অঞ্চল। হাতিদের মুক্তাঞ্চল। হাতিদর্শনের জন্য পর্যটন উন্নয়ন নিগম বা বন দপ্তরের ব্যবস্থায় রয়েছে লঞ্চ সাফারি।
সকাল থেকে সন্ধ্যা বিভিন্ন সময়ে হয় এই ট্যুর। দু’ঘণ্টার জল-সফরে হাতির পাশাপাশি বাঘ, হরিণ, নীলগাই, বুনো শুয়োর, বিভিন্ন প্রজাতির পাখির দেখা মিলতেই পারে। চাইলে হাতির পিঠে চেপেও স্বাদ নেওয়া যায় জঙ্গল সাফারির। জঙ্গলের গভীরে রয়েছে পাথরের তৈরি এক বহু প্রাচীন মন্দির। থেক্কাডিতে হ্রদের পাশেই কে টি ডি সি এবং বন দপ্তরের অফিস। রয়েছে বেশ কিছু ইকো-ট্যুরিজম অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরও।
মুন্নার
কোচি থেকে দূরত্ব ১২৯ কিমি। কুন্ডালা–মুদ্রাপুঝা–নাল্লাথানির নদীর মিলনস্থলে ১,৬০০ মিটার উচ্চতায় নির্জন শৈলশহর মুন্নার। চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে নদী, হ্রদ আর পাহাড়ের বুক চিরে নেমেছে ঝর্না। পাহাড়ের ঢালে চা আর মশলার বাগান। দেখবেন এরাভিকুলাম ন্যাশনাল পার্ক। ১৬ কিমি দূরে ৯৭ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে এই জাতীয় উদ্যান। এখানেই দক্ষিণ ভারতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আনাইমুদি (২,৬৯৫ মিটার)। সবুজে ঢাকা অরণ্যাঞ্চলটি রাজামালাই অভয়ারণ্য নামেও পরিচিত। বাফার এরিয়া পর্যন্ত গাড়িতে গিয়ে বাকি ৩ কিমি মতো হাঁটাপথ। এই পথে দেখা মেলে হরিণাকৃতির নীলগিরি থর। বর্ষার সময় অরণ্য বন্ধ থাকে। মুন্নার থেকে ১৬ কিমি দূরে দেবীকুলাম। দেখবেন সীতা দেবী সরোবর। দেখবেন মাডুপেটি ও কুন্ডালা নামে দুটি বাঁধ। সারা এলাকা ইউক্যালিপটাসের সুগন্ধে ভরপুর।
রয়েছে নৌকাবিহারের ব্যবস্থা। মাডুপেট্টি হ্রদের ধারে পিকনিক স্পট। মাডুপেট্টি ও কুন্ডালা হ্রদে রয়েছে বোটিংয়ের ব্যবস্থা। দেখবেন পাইন ঘেরা বনভূমি ইকো পয়েন্ট। ৪৫ কিমি দূরে কেরল ও তামিলনাড়ুর সীমান্তে টপস্টেশন। আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে নীচে তাকালে কী অপূর্ব তামিলনাড়ুর সমতল এলাকা! এখানেই দক্ষিণ ভারতের সর্বোচ্চ (২,২০০ মিটার) চা-বাগান। সূর্যাস্ত দেখার জন্য বিখ্যাত পোথামেডু চা-বাগানের ভিউ পয়েন্ট। আছে ইন্দো-সুইস প্রজেক্ট। এ ছাড়াও হাতে সময় থাকলে ইউরোপিয়ান আদলে তৈরি ব্লসম ইন্টারন্যাশনাল পার্কটি দেখে নেওয়া যায়। সরু নদীর দু’পাশে ফুলবাগান, ট্রি-হাউস এবং নির্জনতা। চাইলে ক্যাম্প ফায়ারও করা যায় এখানে।
ট্রাভেলরুট
যাওয়া: সাঁতরাগাছি থেকে রয়েছে ২২৬৪২ শালিমার-ত্রিবান্দ্রম সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস, ১২৬৬০ গুরুদেব এক্সপ্রেস। এ ছাড়া হাওড়া থেকে ১২৮৪১ করমণ্ডল এক্সপ্রেস, ১২৮৩৯ হাওড়া-চেন্নাই মেল-এ চেন্নাই সেন্ট্রাল পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে চেন্নাই-আলেপ্পি, চেন্নাই-ত্রিবান্দ্রম মেলে এর্নাকুলাম টাউন বা এর্নাকুলাম জংশন। কেরল পৌঁছে প্রতিটি জায়গায় বেড়ানোর জন্য সরকারি বাস, লোকাল ট্রেন, গাড়ি আর নৌকাবিহার তো রয়েছেই। কলকাতা থেকে কোচি বা ত্রিবান্দ্রম যাওয়ার জন্য রয়েছে ইন্ডিগো, জেট এয়ারওয়েজ, গো এয়ার, এয়ার ইন্ডিয়া, স্পাইস জেট-এর বিমান।
থাকা: কেরলের সর্বত্রই রয়েছে কেরল ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের (কে টি ডি সি) হোটেল ও থাকার ব্যবস্থা। অনলাইন বুকিংয়ের জন্য লগঅন করুন: www.ktdc.com। এ ছাড়াও রয়েছে ভালো মানের বেশ কিছু বেসরকারি হোটেল।
উৎসব
কেরলের একদম নিজস্ব কিছু উৎসব রয়েছে, যার মধ্যে বিখ্যাত হল এপ্রিলে নববর্ষে ধানকাটার উৎসব ওনাম। মার্চ-এপ্রিল ও অক্টোবর-নভেম্বর মাসে দশ দিন ধরে তিরুবনন্তপুরমের শ্রীপদ্মনাভস্বামীর মন্দিরে চলে উৎসব। এ ছাড়া আগস্ট মাসের দ্বিতীয় শনিবার আলেপ্পির পম্পা নদীতে বসে বোট রেসের আসর।
কেরল ভ্রমণ সম্পর্কে আরও জানতে যোগাযোগ করুন— ডিপার্টমেন্ট অফ ট্যুরিজম, গভর্নমেন্ট অফ কেরল, পার্ক ভিউ, তিরুবনন্তপুরম, কেরল, পিন–৬৯৫০৩৩। ফোন: (৯১) ৪৭১–২৩২–১১৩২। ট্যুরিস্ট ইনফরমেশনের টোল ফ্রি নম্বর: ১–৮০০–৪২৫–৪৭৪৭ (শুধুমাত্র ভারতে)। ই–মেল: info@keralatourism.org। ওয়েবসাইট: www.keralatourism.org
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments