মোয়ার রাজা
জয়নগরের মোয়া

সুমন কল্যাণ চক্রবর্তী

ইতিহাসের পাতায় সুস্বাদু মিষ্টি তো অনেকই আছে। কিন্তু স্পেশাল কিছু আস্বাদ করতে গেলে আপনাকে পশ্চিমবঙ্গে আসতেই হবে। এ এমনই বিশেষ ধরনের মিষ্টি যেটি পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে জন্ম নিয়ে প্রতি বছর মাত্র তিন-চার মাসেই (‌নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি)‌ আমাদের রসনা তৃপ্তিকে ত্বরান্বিত করে পূর্ণতায় রূপ প্রদান করে, সে আর কেউ নয়, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণার জেলার ‘জয়নগরের মোয়া’— যা শীতকাল এলেই বাঙালির চাই-ই-চাই। কী কী দিয়ে তৈরি হয় এই ‘মোয়া’? এই মোয়ার ইতিহাসই বা কী? এই মোয়া শিল্পে জড়িত কারিগরদের বছরের বাকি মাসগুলো কাটেই বা কীভাবে? আসুন জেনে নিই তারই কিছু ঐতিহাসিক বিবৃতি।

জয়নগরের এই মোয়া সম্পূর্ণরূপে একটি মরশুমি মিষ্টি। জনপ্রিয় এই মোয়া রাজ্যের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার জয়নগর শহরের নিকটবর্তী বহরু গ্রামে জনৈক যামিনীবুড়োর হাত ধরে আবিষ্কার বলেই জানা যায়। জনশ্রুতি আছে, শীতকালে পারিবারিক একটি অনুষ্ঠানে তিনি নিজের ক্ষেতে উৎপাদিত কনকচূড় ধানের খই ও নলেন গুড় সহযোগে এক বিশেষ ধরনের মিষ্টান্ন প্রস্তুত করে পরিবেশন করেন, যেটি সেই সময়ে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত হয়ে ওঠে, সেটিই হল ‘জয়নগরের মোয়া’। এই মোয়া ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও জয়নগর শহরের শ্রী পূর্ণচন্দ্র ঘোষ (‌ওরফে বুঁচকিবাবু)‌ এবং শ্রী নিত্যগোপাল সরকার এই মোয়াকে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে কিছু সহজলভ্য উপাদান ও সুগন্ধী দ্রব্য যুক্ত করে ১৯২৯ সালে মোয়া তৈরির কারখানা ও ‘শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ দোকানটি তৈরি করে মিষ্টান্ন মহলে হইচই ফেলে দেন।

জানা যায়, এই নিত্যগোপাল সরকারের মামার বাড়ি ছিল জয়নগর অঞ্চলে। তিনি বাংলাদেশ থেকে এসে তার মামার বাড়িতে থাকাকালিন ফুটবল খেলার মাঠে পূর্ণচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়। বাড়তে থাকে বন্ধুত্বের গাঢ়ত্ব। বয়স বাড়তেই রোজগারের চিন্তায় দুজনে এই মিষ্টান্নটিকে আরও সুস্বাদু ও জনপ্রিয় করে তোলায় উদ্যোগী হন। সেই থেকেই পরিচিতি লাভ করে এই জয়নগরের মোয়া।
দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার নামখানা, কাকদ্বীপ ও কুলপি অঞ্চলের প্রায় চারশো বিঘা জমিতে কনকচূড় ধানের চাষ করা হয়ে থাকে। জিরেন কাঠ (‌যে খেজুর গাছকে কয়েকদিন বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে এমন গাছ থেকে)‌ থেকে খেজুর রস সংগ্রহ করেন শিউলিরা, তারপর সেই রস স্বল্প আঁচে জ্বাল দিয়ে নলেন গুড় প্রস্তুত করা হয়। কনকচূড় ধানের খই, নলেন গুড় ও গরুর দুধের গাওয়া ঘি দিয়ে তৈরি করা হয় এই মোয়া। এ ছাড়া, স্বাদ বাড়াতে খোয়াক্ষীর, এলাচ গুঁড়ো, পেস্তা, কিসমিস, কাজুবাদাম ও অল্প পরিমাণে পোস্ত ব্যবহার করা হয়।

মাঠ পর্যায়ে তেমনভাবে কনকচূড় ধানের চাষ কমে গেছে ও তার সঙ্গে ‌দিন দিন খেজুর গাছের পরিমাণ কমে যাওয়ায় এই মোয়া উৎপাদনের ক্ষেত্রে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কনকচূড় ধানের খইয়ের পরিবর্তে নিম্নমানের খই এবং নলেন গুড়ের পরিবর্তে রাসায়নিক সুগন্ধী দ্রব্য মিশিয়ে বাজারে বিক্রি করছে। এর ফলে মিষ্টিপ্রেমীরা প্রকৃত জয়নগরের মোয়ার আস্বাদ গ্রহন করতে পারছেন না। স্বভাবতই ‘জয়নগরের মোয়া’-র মৌলিকত্বটি হারিয়ে যেতে বসেছে। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে বহড়ু হাইস্কুলের মাঠে ক্রেতাকে আসল ‘জয়নগরের মোয়া’ সম্বন্ধে জানাতে এক সচেতনতা শিবির গড়ে তোলা হয়েছিল। এই শিবিরেই ক্রেতাকে কণকচূড় ধানের খই ও আসল নলেন গুড়ের পরিচিতিও জানানো হয়েছিল।

পূর্ণচন্দ্র ঘোষের ছেলে শ্রী অশোক ঘোষ মহাশয়ের (‌যিনি শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার দোকানের দায়িত্বে আছেন)‌ থেকে জানা যায়, আসল জয়নগরের মোয়া প্রস্তুত করার জন্য বাইরে থেকে কারিগর আসেন। গুড় প্রস্তুত করা ও অন্যান্য কাজও তারাই করেন। এই কাজ করার জন্য চুক্তিভিত্তিক পদ্ধতিতে তাদের নেওয়া হয় মোটা টাকার বিনিময়ে। বছরের বাকি মাসগুলো প্রায় এরা সবাই কর্মহীন হয়ে কেউ চাষাবাস কিম্বা কেউ গাড়ি চালানোর কাজ করে তাদের সংসার চালান বলে জানা যায়। 

যাই হোক, ২০১৫ সালে ‘জয়নগরের মোয়া’ জি.‌আই (‌জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন)‌ পেয়েছে, পেয়েছে নম্বরও। যদিও এখনও পর্যন্ত আলাদা কোনো সার্টিফিকেট বা কোনো কাগজপত্র পায়নি। এই মোয়া শিল্পের সাথে কমবেশি প্রায় এক লক্ষ মানুষ জড়িত। বলতে দ্বিধা নেই, এই মোয়া পাড়ি দিচ্ছে দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই ইত্যাদি অঞ্চলে। যেটি অবশ্যই গর্বের বিষয়। মোয়া শিল্প ও শিল্পীদের কারিগরীতে মিষ্টান্নপ্রেমীরা শীতকালে যে ‘জয়নগরের মোয়া’-র অপূর্ব স্বাদ গ্রহণ করেন, তা যেন চিরন্তন ও শাশ্বত হয়ে থাকে।

সব ছবি: আন্তর্জাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *