ছবি তুলে দেওয়ার জন্য আর কাউকে প্রয়োজন নেই। হাতে স্মার্টফোন বা ট্যাব থাকলেই কেল্লাফতে। সেলফি। শুধু জেন ওয়াই–ই নয়, খুদে থেকে বুড়ো, টেকনোলজিতে একটু বোঝদার হলেই সেলফিতে মাতচ্ছেন সবাই। যুগের এই ‘সেলফি’ হাওয়ার সঙ্গে তাল মেলাচ্ছেন প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা থেকে খেলোয়াড়, অভিনেতা–অভিনেত্রী সবাই। কোনও আনন্দ অনুষ্ঠান বা বিশেষ মুহূর্তকে ফ্রেমবন্দী করা বা যে কোনও খেলায় জয়ের সেলিব্রেশনের এক অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেলফি।
প্রথম সেলফি তোলা হয়
১৮৩ বছর আগে!
প্রীতিময় রায়বর্মন
প্রশ্ন হল আমরা সেলফি তুলি কেন? সেলফি হল আত্মপ্রকাশের অন্যতম এক সহজ উপায়। সবার মধ্যেই রয়েছে নার্সিসিজম বা আত্মপ্রেম অর্থাৎ আত্মকেন্দ্রিকতা। আর সেগুলোই আমাদের উদ্বুদ্ধ করে সেলফি তোলায়। তবে সেলফিতে শুধুমাত্র নিজের আত্মপ্রকাশই হয় না, আত্মপ্রচারও হয়। নিজেকে অন্যের কাছে সুন্দরভাবে তুলে ধরার জন্য যেমন সেলফি, তেমনই সেলেবদের নিজের প্রচার বা জনসংযোগেরও একটি মাধ্যম সেলফি।
বিশ্বের প্রথম সেলফি। রবার্ট কর্নেলিয়াস।
সেলফির এতটা রমরমা বা জনপ্রিয়তা খুব বেশি দিনের না হলেও, প্রথম সেলফিটি তোলা হয়েছিল ১৮৩ বছর আগে, ১৮৩৯ সালে। যখন ‘সেলফি’ শব্দটিরই জন্ম হয়নি। শুধুমাত্র নিজের শখের বশবর্তী হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক তরুণ রসায়নবিদ রবার্ট কর্নেলিয়াস তুলেছিলেন নিজেই নিজের ছবি। তিনি ক্যামেরাটিকে সামনে রেখে একমিনিট পোজ দিয়ে দাঁড়ান। ফটোগ্রাফিতে তাঁর খুবই আগ্রহ ছিল। সেই সময় ছবি তোলার জন্য ব্যবহৃত হত ‘দাগেরোটাইপ’ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতেই তিনি তাঁর সেলফিটি তুলেছিলেন। প্রথম সেলফি তোলার চারবছর পর কর্নেলিয়াস ফের একবার নিজেই নিজের ছবি তোলেন। এবার গবেষণাগারে গবেষণারত অবস্থায়।
১৯৬৬ সালে জেমিনি–১২ মিশনে বাজ অ্যালড্রিন মহাকাশে প্রথম সেলফি তোলেন। এর পর সেলফি নিয়ে কারও খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। ২০১০ সাল থেকে আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করে এর জনপ্রিয়তা।
ছবি তোলার ইতিহাসের একেবারে শুরুর দিকে ফটোগ্রাফারদের কাছে ছবি তোলার জন্য ‘দাগেরোটাইপ’ ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয় এক কৌশল। এই পদ্ধতির আবিষ্কারক ছিলেন ফ্রান্সের লুই দাগেরে। তাঁর নাম অনুসারের এই পদ্ধতির নাম হয় ‘দাগেরোটাইপ’। এই পদ্ধতিতে ছবির অনুলিপি তৈরির সুযোগ ছিল না। এটা একধরনের সরাসরি ছবি তোলার পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে আয়োডিনের বাষ্পের মাধ্যমে জমা সিলভার হ্যালাইডের আস্তরণ দেওয়া রূপোর পাত যা আয়নার মতন নিঁখুত, তার উপর সরাসরি বস্তুর প্রতিবিম্ব ফেলা হত।
এই পদ্ধতিতে এক্সপোজার টাইম লাগত অনেক বেশি। এক্সপোজার টাইমকে কমানোর জন্য পরবর্তীকালে আয়োডিনের বাষ্পের বদলে ব্রোমিন ও ক্লোরিনের মিশ্রনে উৎপন্ন বাষ্প ব্যবহার করা হত। এই পদ্ধতিতে ছবি উঠত উল্টো। তারপর আয়নার মতো নিখুত রূপোর পাতের উপর সেই ছবিকে ফেলে তার সামনে অনুজ্জ্বল তল বিশিষ্ট কিছু বা কালো পর্দা ধরে ছবির প্রতিফলন ফেললে রূপোর পাতে রাখা ছবিটি তখন সোজা অর্থাৎ সঠিক আকার পেত। এই ‘দাগেরোটাইপ’ পদ্ধতিতেই ওঠেছিল বিশ্বের প্রথম সেলফি।
ইংরেজি সেলফি শব্দটির বাংলা করলে দাঁড়ায় নিজের প্রতিকৃতি বা নিজস্বী। যদিও বাঙালি সমাজে বাংলা কথাটির খুব একটা চল নেই। সবাই সেলফি বলেই অভ্যস্ত। ২০১৩ সালে অক্সফোর্ড অভিধানে বর্ষসেরা শব্দের স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিল ‘সেলফি’ শব্দটি। অক্সফোর্ড অভিধানে ‘সেলফি’–র অর্থ বলা হয়েছে, কোনও ছবি, যা নিজেরই তোলা নিজের প্রতিকৃতি, যা তোলা হয় স্মার্টফোন বা ওয়েব ক্যাম দিয়ে এবং যা সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা হয়। অক্সফোর্ড সূত্রে জানা যাচ্ছে, সেলফি শব্দটি ২০০২ সালে অনলাইন ফোরাম প্রথম ব্যবহার করেছিল।
যুগের এই সেলফি–প্রেম কাড়ছে প্রাণও। আমারা দেখেছি চলন্ত ট্রেনে সেলফি তুলতে গিয়ে গেছে প্রাণ! নিজের বীরত্বের বহিঃপ্রকাশ করতে গিয়ে স্থান–কাল–পাত্র অনেকেই ভুলে যান। তখনই ঘটে অঘটন। সেলফি বীরত্ব প্রকাশের জায়গা নয়, সেলফি হল নিজের বা আশপাশের নান্দনিক সৌন্দর্য প্রকাশের চলমান এক মাধ্যম।
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments