স্মরণে হেমন্ত
তমাল দীপ রায়
‘‘এই পথ যদি না শেষ হয়
তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?’’
এই বহুপরিচিত ও অসম্ভব জনপ্রিয় গানে মহানায়ক উত্তম কুমারের জন্য যিনি সুর ও কণ্ঠ দিয়েছিলেন তিনিই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, বাংলা তথা ভারতের সঙ্গীতাকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি ছিলেন একাধারে একজন গায়ক, সঙ্গীত পরিচালক ও প্রযোজক। শুধুমাত্র বাংলা নয়, গোটা ভারতবর্ষই তাঁর সুরের মুর্ছনায় আপ্লুত। বাংলা ও হিন্দির পাশাপশি আরও কিছু ভারতীয় ভাষাকেও গানের আদলে আপন করে নিয়েছেন এই অবিস্মরণীয় শিল্পী, জনপ্রিয়তা পেয়েছেন সর্বস্তরে।
১৯২০ সালের ১৬ জুন এই কিংবদন্তির জন্ম হয় বারাণসীতে তাঁর মামাবাড়িতে, বাবা কালীদাস মুখোপাধ্যায় ও মা শ্রীমতী কিরণ বালা দেবী। তবে কয়েক বছর পর পরিবারের সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন হেমন্ত এবং এখানেই তাঁর বড়ো হয়ে ওঠা। নাসিরউদ্দিন স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু হয় তাঁর এবং পরবর্তীতে ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনে পড়ালেখা করেন হেমন্ত। গানের সঙ্গে সখ্যতা তাঁর ছোটবেলা থেকেই। এই সঙ্গীতের টানেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েও আর শেষমেশ ইঞ্জিয়ার হয়ে ওঠা হয়নি হেমন্তের। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে সরে এসে নিজেকে নিবেদন করলেন সঙ্গীতের পায়ে।
তবে প্রথমদিকে সাহিত্যিক হওয়ার স্বপ্নই দেখেছিলেন হেমন্ত। খুব কম বয়স থেকেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হন এবং তাঁর লেখা ছোটগল্প ‘একটি দিন’ দেশ পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উৎসাহেই সঙ্গীত জগতে প্রবেশ ঘটে হেমন্তের। ১৯৩৫ সালে তাঁর প্রথম গান রেকর্ডিং হয় আকাশবাণী’তে— ‘আমার গানেতে এলে তুমি নবারূপী চিরন্তনী।’ সান্নিধ্য পেয়েছেন শৈলেশ দত্তগুপ্তের মতো খ্যাতনামা সঙ্গীতজ্ঞের, তালিম নিয়েছেন ফনীভূষণ ব্যানার্জির কাছে। শুরুর দিকে পঙ্কজ কুমার মল্লিক’কে অনুসরণ করার জন্য ‘ছোট পঙ্কজ’ নামেও পরিচিত ছিলেন হেমন্ত।
১৯৩৭ সাল থেকে সম্পূর্ণভাবে সঙ্গীত’কে ঘিরেই বাঁচতে শুরু করেন হেমন্ত। এই সময় গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়া (জি. সি. আই) যেন আশীর্বাদস্বরূপ আসে তাঁর জীবনে। এই বছরেই তাঁর প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশিত হয় জি.সি.আই থেকে, নরেশ ভট্টাচার্য্য ও শৈলেশ দত্তগুপ্তের কথায় গান করেন হেমন্ত— ‘জানিতে যদি গো তুমি’ এবং ‘বলো গো বলো মোরে’। এই ‘গ্রামোফোন কোম্পানি অফ ইন্ডিয়া’র হাত ধরেই ১৯৪০ সালে তাঁর প্রথম হিন্দি গান— ‘কিতনা দুখ ভুলায়া তুমনে’ এবং ‘ও প্রীত নিভানেওয়ালি’ প্রকাশিত হয়। এভাবেই ধারাবাহিকভাবে জি.সি.আই থেকে প্রকাশিত হতে থাকে হেমন্তের গান। তবে এগুলো কোনোটাই চলচ্চিত্রের গান ছিল না। ১৯৪১ সালে প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য গান করেন হেমন্ত, চলচ্চিত্রের নাম ‘নিমাই সন্যাস’।
শুধুমাত্র গায়ক হিসেবেই থেমে থাকেন নি এই কিংবদন্তি, ১৯৪৪ সালে অমিয় বাগচীর লেখা দুটো গানে সুর দিয়ে ফেললেন এই প্রতিভাবান শিল্পী, সুরকার হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করলেন নিজেকে। তাঁর প্রথম সুর আরোপিত গানদুটি হল— ‘কথা কোয়ো নাকো শুধু শোনো’ এবং ‘আমার বিরহ আকাশে প্রিয়’। এভাবেই শুরু হলো কণ্ঠের পাশাপাশি এক নতুন সুরের যাত্রা। এরপর ‘আনন্দমঠ’, ‘শর্ত’–এর মতো অনেক বাংলা চলচ্চিত্রের গানে সুর দিয়েছেন হেমন্ত। শুরুর দিকে চলচ্চিত্রের গানে সুর দেওয়ার জন্য মাঝারি জনপ্রিয়তাই পেয়েছিলেন।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বহুমুখী প্রতিভার মধ্যে একটি অন্যতম দিক হলো তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনা। তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে তিনি ছিলেন উল্লেখযোগ্য ও অগ্রগণ্য। তাঁর অসাধারণ কন্ঠের যাদুতে তিনি বিভিন্ন চলচ্চিত্রে ও চলচ্চিত্রের বাইরেও বহু রবীন্দ্রসঙ্গীত’কে অনবদ্য উপস্থাপনার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। হিন্দি চলচ্চিত্র ‘ইরাদা’–তে প্রথম একজন অন্যতম রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন হেমন্ত, তারপর বাংলা চলচ্চিত্র ‘প্রিয় বান্ধবী’–তেও ‘পথের শেষ কোথায়’ রবীন্দ্রসঙ্গীতে কণ্ঠ দিয়েছেন। চলচ্চিত্রের বাইরে জি.সি.আই– এ রেকর্ড হয় তাঁর কণ্ঠে— ‘আমার আর হবে না দেরি’ ও ‘কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’, আকাশবাণীতে রেকর্ড হয় ‘আমার মল্লিকা বনে’। তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ যেন জীবিত হয়ে উঠেছেন বারবার। আজও তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের কাছে অমূল্য সম্পদ। বিশিষ্ট শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে বলেছেন যে, রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে হেমন্ত ছিলেন ‘দ্বিতীয় নায়ক’।
গায়ক ও সুরকার সত্বাকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৪৭ সালে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও নিজেকে দাঁড় করালেন এই শিল্পী। ‘অভিযাত্রী’ নামক বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম সঙ্গীত পরিচালনা করেন তিনি। এরপর ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সদস্য হিসেবে সলিল চৌধুরির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। এরই ফলশ্রুতিতে সলিল–হেমন্ত জুটি গড়ে ওঠে এবং এঁদের যৌথ প্রয়াসে নতুন নতুন গানের জন্ম হতে থাকে। তবে এসবের মধ্যে বাংলার দুর্ভিক্ষ নিয়ে সলিল চৌধুরির কথা ও সুর এবং হেমন্ত’র কণ্ঠে ‘গাঁয়ের বধূ’ গানটিকে একটি ঐতিহাসিক গান বলে অনেকে মনে করেন।
এভাবেই একটা সময় মুম্বাইয়ের একজন নামী প্লে–ব্যাক সিঙ্গার বা নেপথ্য গায়ক হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন হেমন্ত। বিভিন্ন চলচ্চিত্রে দেব আনন্দ–এর জন্য গান গেয়েছেন এই গায়ক। সেসব গানের মধ্যে ‘য়েহ চাঁদনি ফির কাঁহা’, ‘চুপ হ্যায় চাঁদ সিতারে’ ও ‘চুপ হ্যায় ধরতি’– এর মতো গান অন্যতম। এছাড়াও তিনি প্রদীপ কুমার, সুনীল দত্ত ও ধর্মেন্দ্র’র জন্যও কণ্ঠ এবং অনেক গানে সুরও দিয়েছেন। ১৯৫৪ সালে ‘নাগিন’ চলচ্চিত্রের গানে সুর দিয়েছিলেন হেমন্ত, যা ভীষণ জনপ্রিয়তা লাভ করে সেই সময়ে। একের পর এক এভাবে হেমন্ত তাঁর কণ্ঠ, সুর ও পরিচালনা শক্তি ঢেলে দিয়েছেন হিন্দি চলচ্চিত্রের গানে এবং ১৯৫৫ সালে পেয়েছেন ‘ফিল্মফেয়ার বেস্ট মিউজিক ডাইরেক্টর অ্যাওয়ার্ড’।
একাধারে এসময় তিনি বাংলাতেও জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। উত্তম–হেমন্ত জুটি মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিল একের পর এক গানের মাধ্যমে। ‘শাপমোচন’, ‘সপ্তপদী’, ‘শেষ পর্যন্ত’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে উত্তম ও হেমন্ত’র মেলবন্ধন আজও দৃষ্টান্ত স্বরূপ। এছাড়াও তাঁর কিছু জনপ্রিয় গান— ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’, ‘রানার ছুটেছে রানার’, ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়’, ‘এই রাত তোমার আমার’ প্রভৃতি এখনও আমাদের সঙ্গী। বাংলা চলচ্চিত্রেও তাঁর অবদান অসামান্য। ‘হারানো সুর’ সিনেমায় ‘তুমি যে আমার’ গানটি তাঁরই পরিচালনার ফসল। এছাড়াও ‘দীপ জ্বেলে যাই’ চলচ্চিত্রেও তাঁর সৃজনশক্তির ছাপ আজও বিদ্যমান।
১৯৫০–এর দশকের শেষের দিকে চলচ্চিত্র প্রযোজনার কাজেও নিযুক্ত হন হেমন্ত। ‘হেমন্ত–বালা প্রোডাকশন’ ব্যানারে শুরু হয় এই নতুন পথ চলা। রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক পাওয়া মৃণাল সেনের ‘নীল আকাশের নীচে’ চলচ্চিত্রটির প্রযোজক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এছাড়াও হিন্দিতে ‘খামোশি’, ‘বিশ সাল বদ’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রের প্রযোজনা করেন। গোটা জীবন ধরেই নানা ক্ষেত্রে তাঁর এই অসামান্য অবদানের জন্য পুরষ্কৃত হয়েছেন বহুবার। ‘ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট মেল প্লে–ব্যাক সিঙ্গার’–এর পুরষ্কারও পেয়েছেন এই শিল্পী। এই কিংবদন্তি ১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
তিনি চলে গিয়েও যেন থেকে গেছেন আমাদের মাঝে, রেখে গেছেন তাঁর সৃষ্টিকে। আজও তাঁর গানে মুগ্ধ হই আমরা। আসলে গানের কোনো বয়স হয়না, শিল্পের কোনো দেশ হয় না। তাঁর সুর, গান আজও আধুনিক। সম্প্রতি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও লতা মঙ্গেশকর–এর একটি অনবদ্য গান ‘দে দোল দোল দোল’ আধুনিক সঙ্গীতশিল্পী অরিজিৎ সিং-এর কণ্ঠে ও এক নতুন পরিবেশনায় সোশ্যাল মিডিয়ায় অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এভাবেই সময়ের বেড়াজাল ভেঙে বেঁচে থাকুক হেমন্ত'র গান, এভাবেই তাঁর গান পার করে যাক শত–সহস্র হেমন্ত। তবে একটা কথা বলতেই হয়, নাম হেমন্ত হলেও তাঁর কণ্ঠে কিন্তু বসন্তের নির্মল স্নিগ্ধতা বিরাজমান।
ছবি সৌজন্যে: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments