আজ উল্টোরথ। সাতদিন মাসির বাড়িতে কাটিয়ে বলরাম, সুভদ্রাকে নিয়ে বাড়ি ফিরছেন জগন্নাথ। কিন্তু প্রশ্ন হল জগন্নাথদেবের মাসি কে? কোথায় তাঁর বাড়ি? কেনই বা তিনি মাসির বাড়ি যান?
জগন্নাথদেবের মাসি কে?
প্রীতিময় রায়বর্মন
প্রাচীন ভারতের মালবদেশের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ছিলেন বিষ্ণুর উপাসক ও তাঁর পরম ভক্ত। তিনি এক মন্দির তৈরি করেন, নাম দেন শ্রীক্ষেত্র। বর্তমানে যা জগন্নাথধাম। মন্দির তো হল, কিন্তু মন্দিরে নেই কোনও বিগ্রহ। রাজ দরবারে একদিন এক ব্যক্তি নীলমাধবের কথা বলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে। নীলমাধব আর কেউ নন, বিষ্ণুরই এক রূপ। রাজা তখন নীলমাধবকে খুঁজতে লোক পাঠালেন চারদিকে। কিন্তু কেউই তাঁর খোঁজ পেলেন না। সবাই ফিরলেন খালি হাতে। ফিরলেন না বিদ্যাপতি। পথ ভুলে হারিয়ে গেলেন জঙ্গলে। জঙ্গল থেকে তাঁকে উদ্ধার করেন শবররাজ বিশ্ববসুর কন্যা ললিতা। বিদ্যাপতি ও ললিতার মধ্যে জমে উঠল ভাব–ভালোবাসা। বিদ্যাপতির জীবনে লাগে প্রেমের ছোঁয়া। কিছুদিনের মধ্যে দু’জনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। জঙ্গলেই গড়ে ওঠল তাঁদের শান্তির নীড়, সুখের সংসার।
বেশ ক’দিন ধরে বিদ্যাপতি লক্ষ্য করছিলেন রোজ সকালে স্নান সেড়ে তাঁর শ্বশুর কোথাও একটা যান। একদিন স্ত্রী ললিতাকে জানতে চাইলেন এ ব্যাপারে। ললিতা জানালেন, তাঁর বাবা শবররাজ স্নান সেড়ে রোজ সকালে জঙ্গলের গভীরে নীলমাধবের পুজো দিতে যান। সব শুনে বিদ্যাপতি খুব খুশি। তিনিও যে নীলমাধবের খোঁজেই বেরিয়েছিলেন। শ্বশুর শবররাজকে অনুরোধ করলেন তাঁকে নীলমাধবের কাছে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু শবররাজ কোনওভাবেই জামাইয়ের ইচ্ছা পূরণে রাজি নন। এদিকে জামাইও নীলমাধবের দর্শন পেতে নাছোড়বান্দা। শেষপর্যন্ত জামাইয়ের অনুরোধ রাখতে রাজি হলেন শবররাজ। শর্ত বিদ্যাপতিকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাবেন। এমন শর্ত জেনে বিদ্যাপতিও করলেন চালাকি। হাতের মুঠোয় সরষে নিয়ে রাখলেন। যাবার পথে তা ছড়াতে ছড়াতে গেলেন। নীলমাধবের দর্শন পেয়ে ভক্তি ভরে তাঁর পুজো করেন বিদ্যাপতি। তারপর হঠাৎ–ই ভেসে এলো এক দৈববানি, ‘আমি এবার মহা–উপচারে পুজো নেব রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছে।’ ক্ষিপ্ত শবররাজ আটকে রাখে জামাইকে। পরে মেয়ের দুঃখ সহ্য করতে না পেরে ছেড়ে দেন বিদ্যাপতিকে।
এদিকে নীলমাধবের খবর পৌঁছয় রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছে। তিনি মহাসমারহে নীলমাধবকে নিতে জঙ্গলে গেলে নীলমাধবের দেখা পেলেন না। আবারও দৈববাণী এলো ইন্দ্রদ্যুম্নের উদ্দেশ্যে, ‘সমুদ্রে ভেসে আসবে কাঠ, সেই কাষ্ঠখণ্ড দিয়েই তৈরি হবে আমার বিগ্রহ।’ হঠাৎ–ই একদিন সমুদ্রের জলে ভেসে এলো কাঠ। শুরু হল বিগ্রহ তৈরির কাজ। কিন্তু দেখা দিল এক সমস্যা। সমুদ্রের জলে ভেসে আসা কাঠ এতটাই শক্ত যে তাতে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে হাতুড়িই ভেঙে যাওয়ার জোগার! তাহলে সেই কাঠ দিয়ে কীভাবে নীলমাধবের বিগ্রহ তৈরি হবে? মহাসঙ্কটে পড়লেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। কী করবেন কিছুই যখন বুঝে উঠতে পারছে না।
এমন সময় শিল্পীর ছদ্মবেশে রাজপ্রাসাদে এসে হাজির স্বয়ং দেবতা। বললেন, তিনিই গড়বেন বিগ্রহ। দিলেন একটি শর্ত। তিন সপ্তাহের আগে কেউ তাঁর নির্মিত কাঠের মূর্তি দেখতে পারবেন না। শর্তানুযায়ী তিনি শুরু করলেন মূর্তি তৈরির কাজ। কিন্তু একদিন রাতে রানী গুণ্ডিচা ঘর থেকে মূর্তি তৈরির কোনও আওয়াজ শুনতে না পেয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢোকেন। দেখেন কারিগর নেই। অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় রয়েছে তিনটি মূর্তি। গোল গোল চোখ, গাত্র বর্ণসহ অসমাপ্ত মূর্তির নেই হাত, পা। মাথা ঘুরে যায় রানী গুণ্ডিচার। ইন্দ্রদ্যুম্ন ও গুণ্ডিচা দু’জনেই দুঃখে ভেঙে পড়েন। ভাবেন শর্ত না মানার ফল এটা। অনুশোচনায় কাতর রাজা–রানীকে স্বপ্নে দেখা দিলেন জগন্নাথদেব। বলেন, ‘আমি এই রূপেই পূজিত হতে চাই।’ দিকে দিকে শুরু হয় জগন্নাথদেব আরাধনা৷ রথযাত্রা পরিণত হয় জগন্নাথদেবের প্রধান উৎসবে। দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে রথে চেপে পাড়ি দেন মাসির বাড়ি। সেখানে সাতদিন কাটিয়ে আবার রথে চেপে ফেরেন নিজগৃহে। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুণ্ডিচার বাড়িই হল জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার মাসির বাড়ি।
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments