প্রথম সারির যোদ্ধাদের
এখন দরকার বুস্টার ডোজ
ডাঃ শুভ্রজ্যোতি ভৌমিক
ডিরেক্টর, ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাকাডেমিক, পিয়ারলেস হসপিটাল অ্যান্ড বি কে রায় রিসার্চ সেন্টার, কলকাতা
অতিমারি মোকাবিলায় কোথায় দাঁড়িয়ে আমাদের দেশ? কেমন চলছে ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম? কবে পাবে শিশুরা ভ্যাকসিন? ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে ভ্যাকসিন কি সত্যিই কাজ করবে না? চলুন খুঁজে নিই উত্তর
ভারতে ভ্যাকসিনেশন কেমন চলছে?
ডাঃ ভৌমিক: ভ্যাকসিনেশনের হার বেশ ভালোই। প্রায় ১২২ কোটি মানুষ প্রথম ডোজ পেয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় ডোজে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে। এখনও পর্যন্ত ৪০ শতাংশের কাছাকাছি মানুষকে টোটাল ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনা গেছে। এই ৪০ শতাংশকে যতক্ষণ না ৭০–৭৫ শতাংশে নিয়ে যেতে পারছি ততক্ষণ সংক্রমণের হাত থেকে রেহাই নেই। আমরা জানি, ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ অর্থাৎ সিঙ্গেল ডোজে ভাইরাসের বিরুদ্ধে তেমন প্রতিরোধ তৈরি হয় না। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজের পরেই ভ্যাকসিন এফিকেসি বা কার্যকারিতা ৬০ শতাংশের উপরে পৌঁছয়।
করোনা প্রতিরোধে কি এবার বুস্টার ডোজ?
ডাঃ ভৌমিক: ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার’স অর্থাৎ প্রথম সারির করোনা যোদ্ধা চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী বা পুলিশ— তাঁরা প্রত্যেকেই ৯ মাস হয়ে গেছে দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন। প্রথম সারির এইসব যোদ্ধারা এখনও প্রতিদিন করোনার সঙ্গে লড়াই করছেন। তাই এই মুহূর্তে তাঁদের বুস্টার ডোজ দেওয়া দরকার। বলা যায় বুস্টার ডোজ দেবার সঠিক সময় চলে এসেছে। ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ প্রথম সারির যোদ্ধাদের বুস্টার ডোজের ব্যবস্থা যেন দ্রুত করা হয়।
বাচ্চাদের ভ্যাকসিনেশন কোথায় দাঁড়িয়ে?
ডাঃ ভৌমিক: ভারতে এখন ভালোই ভ্যাকসিন উৎপাদন হচ্ছে। যদিও বাচ্চাদের ভ্যাকসিনেশন এখনও শুরু করা যায়নি, এটা একটা চিন্তার বিষয়। জাইকোভ-ডি ভ্যাকসিন প্রায় দেড়মাসের উপর হয়ে গেল অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু এখনও প্রয়োগ শুরু হল না! ২ বছরের উপর বাচ্চাদের কোভ্যাক্সিন প্রয়োগের জন্য ড্রাগস কন্ট্রোলার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া (ডিসিজিআই)–র কাছে সুপারিশ করা হয়েছে। আশা করা যায় দ্রুত অনুমোদন মিলবে। ১৮ বছরের কম বয়সীদের ভ্যাকসিনেশন শুরু হওয়া খুব দরকার। কারণ স্কুল, কলেজ চালু রাখতেই হবে। তা না হলে সমাজের পিছিয়ে পড়া অবধারিত। স্কুল, কলেজ বন্ধ থাকায় পড়ুয়াদের মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অনলাইন ক্লাসের ফলে দেখা দিচ্ছে চোখের সমস্যাও। স্কুল, কলেজ চালু রাখার জন্য ১৮ বছরের কম বয়সীদের ভ্যাকসিনেশনে কেন্দ্রীয় সরকারের দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন। শোনা যাচ্ছে ভ্যাকসিন নাকি এর বিরুদ্ধে কাজ করবে না!
ডাঃ ভৌমিক: এটা একেবারেই ভুল কথা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, এমন কোনো বিবৃতি দেয়নি। প্রথম সারির ব্রিটিশ মাইক্রোবায়োলজিস্টরা বারবার বলছেন, এমন কোনো তথ্য তাঁদের কাছে নেই। ওমিক্রনের হদিশ যেখানে প্রথম মেলে সেই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেও এমন কোনো তথ্য আমরা পাইনি, যে এর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন কাজ করবে না। যে ভ্যাকসিনগুলো সম্পূর্ণ কিলড ভাইরাস ভ্যাকসিন, যেমন কোভ্যাক্সিন, এটা শরীরে প্রবেশের পর ভাইরাসের সব প্রোটিনের বিরুদ্ধেই অ্যান্টিবডি তৈরি করে, তাই ভাইরাস মিউটেশন করলেও এই ধরনের ভ্যাকসিনের একটা প্রতিরোধ নিশ্চয়ই থাকবে। ভ্যাকসিন কাজ করবে না— এমন মন্তব্য আতঙ্ক ছড়ানো ছাড়া আর কিছুই নয়। ওমিক্রন এবং ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা যেমন চলছে তেমনই চলবে। তবে এখনকার ভ্যাকসিনগুলো যদি ওমিক্রনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ না দেয়, তাহলে ওমিক্রন প্রতিরোধক ভ্যাকসিন তৈরিতেও প্রস্তুতকারকদের সমস্যা হবে না, কারণ আমরা এখন এই ভাইরাসের চরিত্র এবং ভ্যাকসিন তৈরির পদ্ধতি জানি।
অনেকেই ভ্যাকসিন নেওয়ার পর জনবহুল স্থানে মাস্ক না পরেই চলে যাচ্ছেন। এটা কতটা বিপদজনক?
ডাঃ ভৌমিক: ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও করোনা প্রতিরোধক নূন্যতম স্বাস্থ্যবিধিগুলো (মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব মেনে চলা এবং বারবার হাত স্যানিটাইজ করা) মানে স্বাভাবিক জীবনযাপন বজায় রাখতে হবে। দেশের প্রতিটি নাগরিকেরই দায়িত্ব নিতে হবে, আমারা এমন কোনো আচরণ করবো না, যাতে দেশে আবার লকডাউন হয়। লকডাউন হলে সাধারণ মানুষের পক্ষে খেয়ে–পরে বাঁচা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। অনেকেই আছেন যাঁরা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নেওয়ার পর দ্বিতীয় ডোজ আর নেননি! এটা করবেন না। নির্দিষ্ট দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ নিন, নিজে সুরক্ষিত থাকুন এবং সমাজকে সুরক্ষিত রাখুন।
অনেকেই নির্দিষ্ট দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ নিতে পারেননি। সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর নিয়েছেন। এতে কি ভ্যাকসিন এফিকেসি কমবে?
ডাঃ ভৌমিক: যখন একটা ভ্যাকসিন বাজারে আসে তখন তাকে অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে আসতে হয়। করোনা প্রতিরোধক ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা হয়েছে কতদিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ দিলে কার্যকারিতা সবচেয়ে বেশি হবে। কোভিশিল্ডে যেমন দেখা গেছে ৮৪ দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ দিলে কার্যকারিতা ৮০ শতাংশের কাছাকাছি, তেমনই কোভ্যাক্সিনে দুটো ডোজের মাঝে ৪-৬ সপ্তাহের ব্যবধান থাকলে কার্যকারিতা ৭৭ শতাংশ। কিন্তু এখনও আমরা জানি না ৮৪ দিনের বদলে ২০ সপ্তাহ পর কোভিশিল্ডের দ্বিতীয় ডোজ নিলে কার্যকারিতা বাড়ছে না কমছে, কারণ এর কোনো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল রিপোর্ট আমাদের হাতে নেই। যে সময়টা সরকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছে তার মধ্যেই ভ্যাকসিন নেওয়ার চেষ্টা করুন। ওটা মিস না করাই ভালো। আর মনে রাখুন, ভ্যাকসিনের কোনো ডোজই অপচয় হয় না। তাই সময় পেরিয়ে গেছে বলে দ্বিতীয় ডোজ আর নিলাম না—এমনটা করবেন না।
সাক্ষাৎকার: প্রীতিময় রায়বর্মন
সব ছবি সৌজন্যে: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments