ইংরেজি বছরের শুরুতে আমাদের ক্যালেন্ডার–প্রীতি আকাশছোঁয়া। হিড়িক পড়ে যায় ক্যালেন্ডার সংগ্রহের। এই ক্যালেন্ডারের বার, তারিখ, মাসের উপরেই যে আমাদের প্রতিদিনের চলাফেরা, কাজকর্ম, দিনযাপন। বাংলা নববর্ষে হালখাতা করতে গিয়ে পাওয়া বাংলা ক্যালেন্ডারটা এখন শুধুমাত্র বাড়ির প্রবীণদের জন্যই বরাদ্দ— অমাবস্যা, পূর্ণিমা;‌ বিভিন্ন তিথি, নক্ষত্র;‌ বিয়ে, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি দেখার জন্য। যত নজর, আগ্রহ সবটাই গ্রাস করেছে ইংরেজি ক্যালেন্ডার। এই ইংরেজি ক্যালেন্ডার কিন্তু হঠাৎ করে তৈরি হয়নি। এর জন্ম ইতিহাস বেশ বড় এবং জটিল। অনেক বিবর্তন, পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেমন মানুষের সৃষ্টি, ঠিক তেমনই সুদৃশ্য ইংরেজি ক্যালেন্ডারের জন্মও অনেক বিবর্তন, পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই।

‌ক্যালেন্ডারের জন্মবৃত্তান্ত
প্রীতিময় রায়বর্মন

আগুন জ্বালানো, চাষবাস, বাসস্থান গড়া ইত্যাদির মতো মানুষ একদিন শিখল সময়ের গণনা। চাঁদকে দিয়েই শুরু হয় সেই হিসেব। চাঁদের বিভিন্ন আকার ও অবস্থান দেখে বিভিন্ন সময়কে চিহ্নিত করা হত। আকাশে যখন সরু ফালির মতন চাঁদের দেখা মিলত সেই সময়কে বলা হত ‘ক্যালেন্ডাস’। আর আকাশে যখন অর্ধেক চাঁদ থাকত তখন সময়টা হল ‘নুনেস’। আকাশে পুরো গোল চাঁদ থাকার সময়কে বলা হত ‘ইডেস’।

প্রাচীন সভ্যতাগুলির অন্যতম মেসোপটেমীয় সভ্যতা। মেসোপটেমীয় সভ্যতায় ছিল চারটে ভাগ— সুমেরীয়, ব্যাবিলনীয়, ক্যালডীয় ও আসিরীয় সভ্যতা। খ্রীষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে মেসোপটেমীয়ার ব্যাবিলনীয় সভ্যতাতেই প্রথম শুরু হয় বছর গণনা বা বর্ষবরণ। তবে মাস বা তারিখ দেখে তখন বর্ষবরণ হত না। শীতে যখন গাছের পাতা ঝড়ে পড়ত, তখন সেটা বছরের শেষ। আর বসন্তে যখন গাছে আসত নতুন পাতা, ফুটতে শুরু করত ফুল, সেই সময়টা তাঁদের কাছে ছিল নতুন বছরের শুরু। নববর্ষ। 

মেসোপটেমীয় সভ্যতার মতো আরও একটি প্রাচীন সভ্যতা মিশরীয় সভ্যতা। এই সভ্যতাতেই শুরু হয় সৌর ক্যালেন্ডার। জ্যোর্তিবিজ্ঞানীদের ধারণা, এই সভ্যতাতেই খ্রীষ্টপূর্ব ৪৩৬ অব্দ থেকে চালু হয়েছিল ক্যালেন্ডার।
আজকের ক্যালেন্ডারের তারিখ, মাস, বছর এই সবের হিসেব এসেছে রোমানদের কাছ থেকে। প্রাচীন যে রোমান ক্যালেন্ডারের অস্তিত্ব পাওয়া যায় তাতে মাসের সংখ্যা ছিল ১০। অর্থাৎ ১০ মাসে একবছর। ১০ মাস হত ৩০৪ দিনে। রোমানরা তাঁদের এই ক্যালেন্ডার তৈরির কৌশল শিখেছিল গ্রীক গাণিতজ্ঞ ও জ্যোর্তিবিজ্ঞানীদের কাছ থেকে। শীতকালের মাঝামাঝি সময় থেকে বসন্তের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত মোট ৬০ দিন তাঁরা তাঁদের এই বছর গণনায় আনত না। তাঁদের নতুন বছর শুরু হত মার্চ মাসে। অর্থাৎ ১ মার্চ হল বছরের প্রথম দিন। ৬০ দিন বছর গণনায় বাদ থাকায় সেই সময়টায় কাল্পনিক ভাবেই দিন, মাসের হিসেব করতে হত। ফলে সেই সময় ক্যালেন্ডারের খুব একটা জনপ্রিয়তা ছিল না।

খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ৭৩৮ সালে সম্রাট রমুলাস নতুনভাবে রোমান ক্যালেন্ডার চালুর চেষ্টা করেন। সম্রাট নুমা পন্টিলাস ১২ মাসে এক বছরের সূচনা কর্তা। তিনি ১০ মাসের সঙ্গে আরও দুটো মাসকে যুক্ত করেন। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি। জানুয়ারি হল ২৯ দিনে আর ফেব্রুয়ারি হল ২৮ দিনে। খ্রীষ্টপূর্ব ১৫৩ সালে রোমান সিনেট ঠিক করে জানুয়ারি হবে বছরের প্রথম মাস। জানুয়ারির নামকরণ ‌হয়েছিল রোমান দেবতা জানুসের নামানুসারে। লাতিন শব্দ ‘‌জানুসের’‌ অর্থ দরজা। সেই সময় ফেব্রুয়ারি বছরের শেষ মাস। এ ছাড়াও তিনি আরও একটি মাসকে ক্যালেন্ডারে যুক্ত করেন। যার নাম মারসিডানাস। এই মাসটি ছিল ২২ দিনের। মাসটি আসত এক বছর অন্তর, ফেব্রুয়ারি মাসের ২৩ ও ২৪ তারিখের মাঝে।

এরপর সম্রাট নুমা খ্ৰীষ্ট পূর্ব ৪৩২ অব্দে এই ক্যালেন্ডারে পরিবর্তন আনেন। ঠিক হয় চার বছর অন্তর হবে লিপ ইয়ার। তখন চার বছর অন্তর ক্যালেন্ডারে একটি করে দিন যোগ হত। কিন্তু এই হিসেবে দেখা দেয় সমস্যা। দিনের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যেতে থাকে।
এরপর সম্রাট জুলিয়াস সিজার মিশরীয় ক্যালেন্ডার চালু করলেন রোমে। মিশরীয়দের ক্যালেন্ডার অর্থাৎ সৌর ক্যালেন্ডার। মিশরীয়রা সৌর বছর গণনা করত ৩৬৫ দিনে। অর্থাৎ পৃথিবীর একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা। জুলিয়াস সিজার গণিতজ্ঞ ও জ্যোর্তিবিজ্ঞানীদের পরামর্শে খ্রীষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের মাঝখানে ৬৭ দিন ও ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে ২৩ দিন অর্থাৎ মোট ৯০ দিন যুক্ত করেন ক্যালেন্ডারে।

মার্চ, মে, কুইন্টিলিস ও অক্টোবর মাসের দিন সংখ্যা ছিল ৩১। আগে জানুয়ারি ও সেক্সটিনিস মাস ছিল ২৯ দিনের। তিনি এই দুটি মাসের সঙ্গে আরও ২ দিন যুক্ত করেন। ফলে জানুয়ারি ও সেক্সটিনিস মাসের দিন সংখ্যাও দাঁড়ায় ৩১–এ। ফেব্রুয়ারি মাস হবে ২৮ দিনে। প্রতি চারবছর অন্তর যুক্ত হবে ১ টি করে দিন। জুলিয়ান সিজারের এই ক্যালেন্ডার ‘‌জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’‌ নামে পরিচিত। পরবর্তিকালে তার নামানুসারেই কুইন্টিলিস মাসের নাম হয় জুলাই। তেমনই সম্রাট অগাস্টাসের নামানুসারে সেক্সটিনিস মাসের নাম হয় আগষ্ট।
খ্রীষ্টান পাদরি ডাইওনিসিয়াম এক্সিগুয়াস যীশু খ্রীষ্টের জন্মের বছর গণনা করে ৫৩২ অব্দ থেকে খ্রীষ্টাব্দের সূচনা করেন। 

১৫৮২ সালে রোমান পোপ এ‌য়োদশ গ্রেগরি জ্যোর্তিবিদদের পরামর্শে জুলিয়াস সিজার প্রবর্তিত জুলিয়াস ক্যালেন্ডারে সংস্কার করেন। জুলিয়ান সিজারের ক্যালেন্ডারে একটি সৌর বছর অর্থাৎ একটি মহাবিষুব থেকে আরেকটি মহাবিষুব পর্যন্ত সময়কাল ধরা হয়েছিল ৩৬৫.২৫ দিন। যা প্রকৃত সময়ের চেয়ে প্রায় ১১ মিনিট কম। এর ফলে ৪০০ বছর অন্তর মূল ঋতু থেকে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রায় তিনদিন ব্যবধান ঘটত। ত্র‌য়োদশ গ্রেগরি যখন পোপ তখন সেই ব্যবধান বেড়ে দাঁড়ায় ১০ দিন। মহাবিষুব ২১ মার্চের পরিবর্তে পড়েছিল ১১ মার্চ।

ইস্টারের দিন নির্ণয়ের সঙ্গে যেহেতু মহাবিষুব জড়িত তাই রোমান ক্যাথলিক গির্জা এই জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নিয়ে পড়েছিল বেশ সমস্যায়। তখন পোপ ত্রয়ােদশ গ্রেগরি এই ক্যালেন্ডার ও ইস্টারের তারিখ নির্ণয়ের জন্য গির্জায় ব্যবহৃত চান্দ্র পঞ্জিকার সংস্কার করেন। এর পাশাপাশি তিনি ঘোষণা করেন, যে বছর ৪০০ দিয়ে ভাগ হবে সেই বছরটি হবে লিপ ইয়ার। সেই বছর ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনের পরিবর্তে হবে ২৯ দিনের।

সংশোধিত ক্যালেন্ডার নাম হয় ‘‌গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’‌। আজ আমদের ঘরের দেওয়ালে যে ইংরেজি ক্যালেন্ডার ঝোলে সেটি এই ‘‌গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’‌। সত্যি, দেখে বোঝার বিন্দুমাত্র উপায় নেই এতো জটিল হিসেব–নিকেশ, পরিবর্তন–বিবর্তনের মধ্যে দি‌য়ে আজকের সুদৃশ্য ইংরেজি ক্যালেন্ডারের জন্ম!

সব ছবি:‌ আন্তর্জাল‌‌‌

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *