‌একটা বিপদ যেতে না যেতেই আরেকটা হাজির। হঠাৎ করে ভয়ঙ্কর রূপে অ্যাডিনো। সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে বাচ্চাদের। কাড়ছে প্রাণ। আবার শোনা যাচ্ছে কোমর্বিডিটি শব্দটি। জ্বর বা সর্দি, কাশি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। চিকিৎসকের কাছে আজ নয়, কাল যাবো— এমনটা করবেন না‌


ইমিউনিটি গ্যাপ–ই কি ভয়ঙ্কর
করল অ্যাডিনোকে?‌

ডাঃ শুভঙ্কর সরকার
পেডিয়াট্রিক্স (‌অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস, দিল্লি)‌;‌ ফেলোশিপ, পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি–আইএসপিএন, ‌অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক‍্যাল সায়েন্সেস, দিল্লি, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হসপিটাল‌, সিঙ্গাপুর;‌ কনসালট্যান্ট পেডিয়াট্রিশিয়ান, পিয়ারলেস হসপিটাল অ্যান্ড বি কে রায় রিসার্চ সেন্টার

হঠাৎ করে অ্যাডিনো এতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল কেন?‌ 
ডাঃ সরকার:‌ অ্যাডিনো নতুন কোনও ভাইরাস নয়, বহুকাল ধরেই এর অস্তিত্ব রয়েছে। হঠাৎ করে এ বছর আতঙ্কের কারণ হয়েছে দাঁড়িয়েছে। নতুন কোনও মিউটেশন হয়েছে কিনা তার কোনও প্রমাণ এখনও পর্যন্ত আমাদের হাতে নেই। আমরা জানি, ভাইরাস মিউটেশন করে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে। অ্যাডিনোর ক্ষেত্রেও সে রকম কিছু হয়েছে কিনা, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

বাচ্চারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে কেন?‌
ডাঃ সরকার:
খুব ছোট বাচ্চারা অ্যাডিনোভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে।‌ বিশেষ করে দু’‌বছরের কমবয়সীরা এতে বেশি ভুগছে। করোনা–কালে ছোটরা ঘরবন্দিই থেকেছে। স্কুলে যাওয়া, খেলতে যাওয়া, আত্মীয় পরিজন বা প্রতিবেশীরদের বাড়ি যাওয়া সবই করোনার জন্য শেষ দু–তিন বছর অনেকটাই কমে গেছিল। এটা স্বাভাবিক থাকলে;‌ বাইরের পরিবেশ, মানুষজনের সংস্পর্শে এলে বাচ্চারা হয়তো কোনও মাইল্ড ইনফেকশন বা মৃদু সংক্রমণে আক্রান্ত হতো, কিন্তু এতে হয়তো তাদের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হতো। যা পরবর্তীকালে শরীরে নতুন কোনও ভাইরাস ঢুকলে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলত। এই ইমিউনিটি গ্যাপ অ্যাডিনোর মতো সাধারণ ভাইরাসকে ভয়ঙ্কর করে তুলতে পারে। যেহেতু অ্যাডিনোর কোনও ভ্যাকসিন নেই, তাই এর প্রতিরোধে প্রধান ভরসা ন্যাচরাল ইমিউনিটি।

মৃত্যুও তো হচ্ছে!‌‌
ডাঃ সরকার:‌
ফুসফুসে সংক্রমণ বা অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম (‌এআরডিএস)–ই মৃত্যুর জন্য মূলত দায়ী। সংক্রমণের ফলে ফুসফুস যখন পুরোপুরি নিজের কার্যক্ষমতা হারাচ্ছে, তখন বাচ্চাদের ভেন্টিলেশনের প্রয়োজন পড়ছে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু জটিলতা দেখা দিচ্ছে। অনেক সময় সংক্রমণ ফুসফুসকে এতটাই বিকল করে দিচ্ছে যে খুব হাই–ভেন্টিলেশনেও বাচ্চাকে আর বাঁচানো যাচ্ছে না। অনেক সময় মৃত্যুর জন্য দায়ী দেরি করে চিকিৎসা শুরু। জ্বর, শ্বাসকষ্ট বাড়িতেই কমে যাবে— এই ভাবনা নিয়ে দু–তিনদিন কাটিয়ে যখন বাচ্চাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, তখন দেখা যায় ফুসফুসে সংক্রমণ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে শুধুমাত্র অক্সিজেনে তো কোনও কাজই হয় না, এমনকী ভেন্টিলেশন বা হাই–প্রেশার ন্যাজাল ক্যানুলা দিয়েও কোনও উপকার মেলে না।

কোমর্বিডিটি কতটা দায়ী?‌
ডাঃ সরকার:‌
কোমর্বিডিটি থাকলে বাচ্চা বা প্রাপ্তবয়স্ক সবারই স্বাভাবিকের তুলনায় শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি কম থাকে এবং অন্যান্য শারীরিক ক্ষমতাতেও সে অনেকটাই পিছিয়ে থাকে। তাই কোনও ভাইরাস বা সংক্রমণ তাকে ধরলে সেটা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তার খুব একটা থাকে না। আর তখনই রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করে। করোনার ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছিলাম বেশিরভাগ মৃত্যু বা রোগের জটিলতার জন্য দায়ী ছিল কোমর্বিডিটি। অ্যাডিনোভাইরাসের ক্ষেত্রেও সেই একই জিনিসই দেখা যাচ্ছে। তাই কোমর্বিডিটি থাকলে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন।

অ্যাডিনোর হানা থেকে বাচ্চাকে সুরক্ষিত রাখবো কীভাবে?‌
ডাঃ সরকার:‌
অ্যাডিনো করোনার মতো অতি–সংক্রামক নয়। একটি পাড়ায় একজনের হলে সাত বা চোদ্দদিনের মধ্যে পাড়ার সবাই আক্রান্ত হবে, এমনটা নয়। অ্যাডিনোর স্প্রেড বা ছড়ানোর ক্ষমতা আছে, কিন্তু সেটা খুব একটা ভয়ঙ্কর নয়। তবুও বলব, অহেতুক জনসমাগম নয়। বাচ্চাকে আনন্দ দেবার জন্য কোনও ভিড়ে না নিয়ে গিয়ে তাকে বাড়িতেই রাখুন। করোনার সময় যে সব নিয়মগুলো আমরা মেনে চলতাম যেমন শারীরিক দূরত্ব, হাত স্যানেটাইজ করা বা সাবান দিয়ে ধোয়া— এগুলো মানতে হবে। কারও সর্দি, কাশি হলে তার থেকে বাচ্চাকে দূরে রাখুন। মা–বাবাদের বলব, বাইরে থেকে এসে জামা–কাপড় ছেড়ে ভালো করে হাত, মুখ ধুয়ে বা স্নান করে তবেই বাচ্চার সংস্পর্শে আসুন। আর সর্দি, কাশি হলে মা–বাবাকেও বাচ্চার থেকে দূরে থাকতে হবে।

অবশ্যই খেয়াল রাখুন বাচ্চার খাওয়াদাওয়ার দিকে। এমনভাবে ডায়েট চার্ট তৈরি করুন যাতে বাচ্চাদের শরীরে সবরকম পুষ্টি সঠিকমাত্রায় পৌঁছয়। খেতে হবে পরিমিত পরিমাণ জল। এর পাশাপাশি বাচ্চাদের জ্বর, সর্দি, কাশি হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। দেখতে হবে সেটা অ্যাডিনোভাইরাস না অন্য কোনও ভাইরাস। অ্যাডিনো ছাড়াও ইনফ্লুয়েঞ্জা, মেটানিমো–সহ প্রায় ১০ থেকে ১৫টা ভাইরাস এখন সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। তবে অ্যাডিনোই সব থেকে বেশি ভোগাচ্ছে এবং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অনেকে আবার একসঙ্গে দুটো বা তিনটে ভাইরাসও আক্রান্ত হচ্ছে, এতে জটিলতা আরও বাড়ছে। 

কী কী উপসর্গ দেখা দিলে বাচ্চাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবো?‌ 
ডাঃ সরকার:‌
যদি দেখা যায় জ্বরের সঙ্গে বাচ্চার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, ব্রিদিং বা রেসপিরেটরি রেট স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই বেশি, বাচ্চা যদি কিছু না খেয়ে নেতিয়ে পড়ে— তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সমস্যাটা অন্য জায়গায়, আমরা বড়োরা পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা হলে বলতে পারি;‌ কিন্তু বাচ্চারা তাদের কষ্টটা বলতে পারে না। তাই জ্বর বা সর্দি, কাশি হলে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। ‘‌আজ নয়, কাল যাবো’‌— এমনটা না করবেন না।

সাক্ষাৎকার:‌ প্রীতিময় রায়বর্মন‌‌‌
সব ছবি: আন্তর্জাল
ব্যবহৃত ছবির সঙ্গে রোগের কোনও সম্পর্ক নেই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *