সাহিত্যাকাশে এক উজ্জ্বল নীহারিকা
শ্রীপর্ণা দে
উনিশ শতকে মহাকাব্য এবং আখ্যানকাব্যের উদ্দাম স্রোতের অন্তরালে গীতিকবিতার নিঃশব্দ ফল্গুধারা প্রবহমান ছিল। মহাকাব্য এবং আখ্যানকাব্য রচয়িতারাই সাদরে এই ফল্গুধারাকে হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন। বিহারীলাল চক্রবর্তী এই গীতিকবিতার ধারক ও বাহক হলেও পরবর্তীকালে তাঁর পথ অনুসরণ করে অনেকেই আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। পুরুষ- কবিদের পাশাপাশি উনিশ শতকের মাঝামাঝি এক ঝাঁক মহিলা-কবিদের কুণ্ঠিত আত্মপ্রকাশ ঘটে গীতিকবিতার মাধ্যমে। সাহিত্য-উদ্যানে এই ভিড়ের মধ্যেই সাবলীলভাবে প্রস্ফুটিত হয় এক পুষ্প— নাম কামিনী রায় (১৮৬৪-১৯৩৩)।
উনিশ শতকের শেষার্ধে বাংলা সাহিত্যে মহিলা কবি হিসেবে কামিনী রায় সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত। কামিনী রায় ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ১২ অক্টোবর বাখরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত বাসন্ডা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উচ্চশিক্ষিতা, অভিজাত বংশে ব্রাহ্ম আদর্শে কামিনী রায় লালিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সে-যুগের খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও ম্যাজিস্ট্রেট চণ্ডীচরণ সেনের কন্যা এবং স্ট্যাটুটারি সিভিলিয়ান কেদারনাথ রায়ের পত্নী। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বেথুন কলেজ থেকে এনট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা অনার্স গ্র্যাজুয়েট হন সংস্কৃত বিষয়ে। তারপর ‘ইলবার্ট বিল’ আন্দোলন তথা সুরেন্দ্রনাথের কারাবরণের সময় কামিনী রায় বেথুন স্কুলের ছাত্রীদের নেতৃত্ব দেন। তৎকালীন সময়ে বেথুন স্কুলের ছাত্রীদের মধ্যে তাঁর নেতৃত্বে জাতীয়তাবোধ জাগরিত হয়েছিল তা আমরা সরলা দেবী চৌধুরাণীর স্মৃতিচারণায় পাই—
‘‘...এদিকে স্কুলে উপর ক্লাসের কতকগুলি মেয়েদের নেতৃত্ব-প্রভাবে আমার জাতীয়তার ভাব উত্তরোত্তর বর্ধিত হতে লাগল। তাঁদের মধ্যে অন্যতম নেত্রী ছিলেন কামিনী দিদি ও অবলা দিদি- কবি কামিনী রায় ও লেডি অবলা বসু।’’(‘জীবনের ঝরাপাতা’, রূপা প্রকাশনী, পৃষ্ঠা- ২৮) কলেজের শিক্ষা শেষ করে কামিনী রায় প্রথমে বেথুন স্কুলে এবং পরে ওই কলেজে অধ্যাপনার কাজে বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন।
পিতা চণ্ডীচরণ সেন তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা কামিনী রায়ের মধ্যে সাহিত্যবোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর অনূদিত ‘টম কাকার কুটীর’ সর্বজনপরিচিত গ্রন্থ। ইতিহাসকে কেন্দ্র করেও বেশ কয়েকটি গ্রন্থ (‘অযোধ্যার বেগম’, ‘ঝাঁসীর রানী’, ‘দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ’) তিনি রচনা করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলিতে তিনি রাজরোষ উপেক্ষা করে সত্য উদ্ঘাটনের দুঃসাহস দেখিয়েছেন। সরকারি কর্মের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও ‘মহারাজ নন্দকুমার’ লিখে সরকারের কাছে তর্জিত হয়েছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলিতে সমাজ, রাজনীতি সম্পর্কে তিনি যে কতটা অবহিত ছিলেন তার পরিচয় পাই। পিতা চণ্ডীচরণ সেনের নৈতিক আদর্শ কামিনী রায়ের মধ্যে সুপ্ত ছিল। বালিকা বয়সেই তিনি পিতার সহায়তায় নানা গ্রন্থ পড়তে শুরু করেন, পুরাত্ন বাংলা সাহিত্যের (রামায়ণ- মহাভারত) সঙ্গেও পরিচিত হন। পিতার তত্ত্বাবধানে এবং ব্রাহ্ম আদর্শে বাল্য-কৈশোর-প্রথম যৌবন গড়ে ওঠে তাঁর। সাহিত্যিক পিতার প্রতিভার ফল্গুস্রোত কামিনী রায়কে স্পর্শ করেছিল। অন্তরে সেই প্রতিভার ফল্গুস্রোতকে আত্মস্থ করে কামিনী রায় কবিতা রচনায় ব্রতী হন মাত্র আট বছর বয়সে।
কামিনী রায় তাঁর ষোলো বছর বয়সে লেখা ‘সুখ’ কবিতায় কবিখ্যাতি অর্জন করেন পাঠকমহলে-যদিও তখন তিনি এনট্রান্স পরীক্ষার্থী। ষোলো বছরের স্বল্প জীবনাভিজ্ঞতা কবির মনকে বিষাদাতুর করে তুলেছিল বলেই হয়তো তিনি লিখেছিলেন-‘‘নাই কি রে সুখ ?/এ ধরা কি শুধু বিষাদময়?’’ কামিনী রায়ের প্রথম মুদ্রিত কবিতা ‘প্রার্থনা’ ও ‘উদাসিনী’। কবিতা দুটি মেদিনীপুর থেকে ‘মেদিনী’ নামে এক স্থানীয় সাপ্তাহিকে প্রকাশিত হয়। সেই সময় কবির পিতা কর্মসূত্রে মেদিনীপুরে বদলি হন, কবি তাঁর পিতার সঙ্গেই থাকতেন। ‘মেদিনী’ সাপ্তাহিকের কর্তৃপক্ষের অনুরোধে কামিনী রায় প্রথম ছাপার অক্ষরে আত্মপ্রকাশ করেন।
কামিনী রায় মূলত হেমচন্দ্রের কবিতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহিত্যক্ষেত্রে আত্মনিয়োগ করেন। রবীন্দ্রনাথের প্রায় সমসাময়িক হয়েও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি। সুরেশ্চন্দ্র সমাজপতি, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ ব্যক্তিত্বরা রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছিলেন, কামিনী রায়ও তার ব্যতিক্রম নন। রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য— ‘‘আজকাল রবীন্দ্রযুগ-এ আর্টের দিকেই বিশেষত রবীন্দ্রনাথের আর্টের দিকেই মানুষের অধিক মনোযোগ। কবিতার প্রভাব (effect) কানের উপর যতটা, ততটা প্রাণের উপর হয় কিনা কেহ দেখে না... কেহ হয়তো মনে করিবেন আমি রবীন্দ্রনাথকে অগভীর বলিতেছি। কিন্তু তাহা নহে।... তিনি যে রুচির সৃষ্টি করিয়াছেন, ইংরাজীতে বলিতে গেলে, তিনি যে ‘স্কুলের’ প্রবর্তক, তাহা গভীরতা ও সজীবতার তত সন্ধান করে না, মিষ্টতা চাহে স্পষ্টতা চাহে না। ছন্দ, সুর, নিখুঁত মিল, উপলাহত গিরিস্রোতের কল-কল ধ্বনি, ইন্দ্রধনুর নানা বর্ণের ক্ষণিক খেলা, আবছায়া স্বপ্নের আবেশ এই সব তাঁহাদের মতে কবিতার একান্ত আবশ্যক উপাদান। এগুলি উপাদান বটে এবং অতিশয় উপভোগ্য তাহারও ভুল নাই, কিন্তু এইগুলি দিয়াই হৃদয় পরিতৃপ্ত হয় না, আরও কিছু চাই।’’ কামিনী রায়ের এই মন্তব্য রবীন্দ্র-অনুগামীদের প্রতি নিক্ষিপ্ত হলেও, এই সমালোচনার বাণ রবীন্দ্রনাথকে পরোক্ষে বিদ্ধ করেছে। অথচ যখন এই চিঠি (১১ জুলাই ১৯২৩) লিখেছেন কামিনী রায় তখন রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সাহিত্যে এমনকি বিশ্বসাহিত্যে আন্তর্জাতিক সম্মান লাভ করেছেন। এর কয়েক বছর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়ে বিশ্বকবির মর্যাদা লাভ করেন তা কামিনী রায়ের নিশ্চয়ই অজানা ছিল না। কিন্তু রবীন্দ্র-সমসাময়িক হয়ে কামিনী রায় রবীন্দ্রযুগে ততটা সম্মান পাচ্ছেন না বলে হয়তো কিছুটা বিষণ্ণ হয়ে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে ‘আরো কিছুর অভাব’ দেখেছিলেন তা হয়তো তাঁর কবিতার উচ্চ ভাব, আদর্শ, নীতি, উপদেশ ইত্যাদিকে বোঝাতে চেয়েছেন। স্পষ্টতই তিনি বলেছেন—‘‘সুখ, দুঃখ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, আশা, আকাঙ্ক্ষা, গভীর আনন্দ ও তীব্র বেদনা এই সকল দিয়া যে মানবজীবন, তাহার একটা জাগ্রত মস্তিষ্ক আছে; এবং তাহার একটা সরল সবল প্রকাশের উপযোগী কবিতা আছে ও থাকিবে।’’
কামিনী রায় হেমচন্দ্রের গুণমুগ্ধ পাঠিকা ছিলেন বলেই তাঁর কবিতার প্রথমদিকে হেমচন্দ্রের গীতিকবিতার আদর্শ লক্ষিত হয়। কামিনী রায় প্রথমপর্বে হেমচন্দ্রের দ্বারা অনেকখানি অনুপ্রাণিত হয়েছেন। হেমচন্দ্রের জীবনীকার মন্মথনাথ ঘোষকে লিখিত পত্রে তিনি বলেছেন—‘‘হেমচন্দ্রের কবিতা বাল্যে আমাকে উদ্বুদ্ধ করিয়াছে।’’ তাঁর কবিতার আদর্শও ছিলেন হেমচন্দ্র— ‘‘তাঁহার জলদগম্ভীর ভাষা শুনিয়া আমাদের তরুণ প্রাণ আনন্দে ও উৎসাহে নৃত্য করিয়া উঠিত।’’ এর থেকেই বোঝা যায় হেমচন্দ্রের প্রতি তিনি কতখানি প্রসন্ন ছিলেন।
কামিনী রায় তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্য ‘আলো ও ছায়া’-র মাধ্যমে সাহিত্যের পথে যাত্রা শুরু করেন। এই গ্রন্থে তিনি স্বভাবসুলভ
লজ্জা ও সংকোচবশত সাহিত্যসমাজে অর্থাৎ পাঠকসমাজে আত্মপ্রকাশ করতে চাননি। এই প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্যটি গ্রহণীয়— ‘‘প্রথম জীবনে, কেবল প্রতিকূল সমালোচনা ও উপেক্ষার ভয়ে নহে, এক দারুণ লজ্জাবশতই আপনার নিভৃত চিন্তাগুলি অবগুণ্ঠন মুক্ত করিয়া সকলের সম্মুখে উপস্থিত করিতে পারিতাম না। সেই লজ্জা এবং ভীরুতা দূর করিবার জন্য আমার নাম, ধাম ও নারীত্ব গোপন রাখিয়া, কোনো পূজণীয় পিতৃবন্ধু কবিবর হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের নিকট লইয়া যান।’’ হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতাগুলি অল্পবয়সি নারীর রচনা—বিশ্বাসই করতে পারেননি। পরে পরিচয় পেয়ে তিনি নবীনা কবির উচ্চ প্রশংসা করেন। কবিতা পাঠ করে মুগ্ধ হেমচন্দ্র ‘আলো ও ছায়া’-র ভূমিকা লিখে দেন। কবিতাগুলিতে ভাবের গভীরতা, রুচির নির্মলতা এবং সর্বত্র হৃদয়গ্রাহিতার জন্য পাঠকসমাজে সমাদৃত হয়।
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কামিনী রায়ের ‘আলো ও ছায়া’-র অন্তর্গত কবিতাগুলিকে বলেছেন— ‘‘কবিতাগুলি আজকালের ছাঁচে ঢালা।’’ কিন্তু সমকালের ‘ভারতী’ পত্রিকার একটি প্রবন্ধে লেখা হয়েছিল—‘‘কোন সমাজের কোন দিকই কামিনীর ভালো করিয়া দেখিবার অবসর বা সুবিধা ঘটে নাই। সামাজিক জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁহার বড়ই কম। তাঁহার আদর্শ বেশিরভাগ ইংরাজী ও সংস্কৃত সাহিত্য-জগৎ হইতে লব্ধ ও কল্পনাপ্রসূত। কাজেই তাঁহার কবিতাগুলি পুরাতন ছাঁচে ঢালা হইতে পারে নাই।’’(‘আলো ও ছায়া রচয়িত্রী’,‘ভারতী’, ১৩১৭ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা) নানা বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও ‘আলো ও ছায়া’ গ্রন্থটি সুপরিচিত ও সর্বজনবিদিত হয়।
কামিনী রায়ের ‘আলো ও ছায়া’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘সুখ’ কবিতাটি পাঠকসমাজে বহুপঠিত এবং হৃদয়গ্রাহী। ‘সুখ’ কবিতায় কবি মনের বিষণ্ণতা, বিষাদ, নৈরাশ্য ও হতাশা ধ্বনিত হয়েছে। কবির পরিচিত পৃথিবীও তাই কবির চোখে হয়ে উঠেছে বিষাদময়। এই উপলব্ধি থেকেই কবি বলেছেন—
নাই কিরে সুখ? নাই কিরে সুখ?
এ ধরা কি শুধু বিষাদময়?
যাতনে জ্বলিয়া, কাঁদিয়া মরিতে
কেবলই কি নর জনম লয়?
এখানে আমরা জীবনের প্রতি কবির যে বেদনাবোধ তা প্রত্যক্ষ করি। ক্ষণিক বিষাদে কবি ভারাক্রান্ত হলেও এই বিষাদ থেকে তিনি মুক্তি পেলেন—
বল্ ছিন্ন বীণে, বল্ উচ্চৈঃস্বরে, না-না-না, মানবের তরে
আছে উচ্চ লক্ষ্য সুখ উচ্চতর, না সৃজিলা বিধি কাঁদাতে নরে।
ভালো সাহিত্য এই প্রকাশই করে বিষণ্ণতা, হতাশা, নৈরাশ্য থেকে জীবনের উত্তরণ। মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশা, বিষণ্ণতা, নৈরাশ্য সবই যেমন চরম সত্য, তেমন সত্য এই থেকে মানবজীবনের মুক্তি। সব কিছু থেকে মুক্তিলাভ করেই মানুষ জীবনের পথে জয়ী হয়, আত্মপ্রতিষ্ঠায় সফল হয়। কবি কামিনী রায়ও জয়ী হয়েছেন। তাই নির্দ্বিধায় বিশ্বাসের পথে পা বাড়িয়েছেন—
পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও
তার মত সুখ কোথাও কি আছে
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
কামিনী রায় বিশ্বাসের পথে নেমেই বুঝেছেন ব্যক্তিগত সুখ নয়, বিশ্বহিতে স্বার্থত্যাগ করতে হবে—
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী’ পরে
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।
এ কবিতা নীতিশিক্ষামূলক এবং উচ্চ আদর্শমূলক। ব্যক্তিগত সুখের জন্য ব্যাকুল না হয়ে সমাজকল্যাণে এই ক্ষুদ্র স্বার্থত্যাগ করতে হবে-এটাই কবির উপদেশ। কবিতাকে মাধ্যম করে তিনি সমগ্র পাঠকসমাজকে শিক্ষা দিতে চেয়েছেন।
‘আলো ও ছায়া’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘সুখ’ ব্যতীত ‘প্রণয়ে ব্যথা’, ‘সে কি?’, ‘ডেকে আন’, ‘দিন চলে যায়’ কবিতাগুলি উল্লেখযোগ্য। কবিতাগুলিতে কবির হৃদয়ের আর্তি, স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা, নৈরাশ্য কবিকে বেদনায় ভারাতুর করে তুলেছে। ‘প্রণয়ে ব্যথা’ কবিতায় ধরা পড়েছে ব্যর্থ প্রণয়িনীর দীর্ঘশ্বাস—
কেন যন্ত্রণার কথা, কেন নিরাশা ব্যথা
জড়িত রহিল ভবে ভালবাসা সাথে
কেন এত হাহাকার, এত ঝরে অশ্রুধার?
কেন কণ্টকের কূপ প্রণয়ের পথে?
এই গভীর ভাবনায় ভাবিত হয়ে দিন কেটে গেছে। মহাকালের স্রোতে জীবনের পাতা থেকে এক-একটা দিন চলে গেছে। ‘দিন চলে যায়’ কবিতায় কবির আক্ষেপের সুর ধরা পড়েছে—
একে একে হায় ! দিনগুলি চলে যায়।
কালের প্রবাহ পরে প্রবাহ গড়ায়
সাগরে বুদ্বুদ মত উন্মত্ত বাসনা যত
হৃদয়ে আশা শত হৃদয়ে মিলায়
আর দিন চলে যায়।
কামিনী রায় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আলো ও ছায়া’(১৮৮৯) লিখে সাফল্য পেয়ে একের পর এক কাব্য রচনায় ব্রতী হন। তাঁর পরবর্তী কাব্যগুলি হল— ‘নির্মাল্য’(১৮৯১), ‘মাল্য ও নির্মাল্য’(১৯১৩), ‘সাদ্ধিকী’(১৯১৩)। এই কাব্যগ্রন্থগুলি ছাড়া তিনি ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখ বিজড়িত নাট্যকাব্য ও শোকগাথা লিখেছেন। সেগুলি
হল—‘পউরাণিকী’(১৮৯৭), ‘অম্বা’(১৯১৫), ‘অশোকসঙ্গীত’(১৯১৪), ‘অশোক স্মৃতি’(প্রয়াত পুত্রের জীবনী, ১৯১৩), ‘সিতিমা’(১৯১৬), ‘দীপ ও ধূপ’(১৯২৯), ‘জীবনপথে’(১৯৩০) ইত্যাদি। ছোটোদের জন্য তাঁর রচিত শিশুসাহিত্য ‘গুংজন’(১৯০৫), টলস্টয়ের গল্পের অনুবাদ ‘ধর্মপুত্র’(১৯০৭), ‘ঠাকুমার চিঠি’ উল্লেখযোগ্য।
কামিনী রায়ের আর একটি কবিতা ‘আমার স্বপন’ বহু আলোচিত। আশার সন্ধান পেয়েছেন কবি নিজে—
তোরা শুনে যা আমার মধুর স্বপন ,
শুনে যা আমার আশার কথা—
এখানে কবি হতাশা, নৈরাশ্যর পথ অতিক্রম করে ভারতসন্তানদের ওপর ভরসা করে আশার গান শোনালেন। কবির ভাবনা, স্বপ্নে ধরা দিলো ভারতে নবযুগের আবির্ভাব হয়েছে, পুণ্যতোয়া জাহ্নবী, যমুনা, কৃষ্ণা, গোদাবরী, নর্মদা, কাবেরী- নদীকূলে দেবস্তোত্র ধ্বনিত হচ্ছে, প্রাচীনকালের মতো ভারতবাসী একতার দ্বারা প্রবুদ্ধ হয়ে উন্নত শিরে সংগ্রামে প্রস্তুত হয়েছে। কবি তাঁদেরই উদ্দেশে লিখলেন—
ঘরে ভারত- রমণী সাজাইছে ডালি,
বীর শিশুকুল দেয় করতালি,
মিলি যত বালা গাঁথি জয়মালা
গাহিছে উল্লাসে বিজয়গাথা।
কামিনী রায়ের ওপর বঙ্গের মহাকবি হেমচন্দ্রের প্রভাব পড়েছিল। হেমচন্দ্রের কবিতার দেশাত্মবোধ, স্বদেশপ্রীতি তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। কামিনী রায় হেমচন্দ্রের প্রশংসা করে লিখেছেন— ‘‘রবীন্দ্রের অভ্যুদয়ের পূর্বে হেমচন্দ্র বঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন। তাঁহার জ্বলন্ত স্বদেশ-প্রীতি, নারীজাতির প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধাপূর্ণ অকপট সহানুভূতি, দেশাচারের প্রতি ঘৃণা ও ধিক্কার, জাতীয় পরাধীনতায় ক্লেশ ও লজ্জাবোধ—এ সকল তাঁহার মত তেজস্বিতা ও সহৃদয়তার সহিত তাঁহার পূর্বে কেহ প্রকাশ করিতে পারেন নাই। এখনকার বিচারে তাঁহার রচনার মধ্যে অনেক ত্রুটি পাওয়া যাইতে পারে, কিন্তু আমরা সেকালে কলাকুশলতা (art) হইতে কবির উচ্ছ্বসিত হৃদয় (heart) দেখিয়া মুগ্ধ হইতাম।’’ (মন্মথনাথ ঘোষকে লেখা চিঠি, ১১,৭,১৯২৩ উদ্ধৃত, উজ্জ্বলকুমার মজুমদার, ‘বাংলা কাব্যে পাশ্চাত্য প্রভাব’, পৃষ্ঠা-২১৪)
কামিনী রায়ও হেমচন্দ্রকে আত্মস্থ করে ‘স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের
ইতিহাস’-এর স্বপন দেখেছিলেন। ‘মাতৃপূজা’ কবিতায় কবি মাতৃভূমির উদ্দেশে বলেছেন—
যেই দিন ও চরণে ডালি দিনু এ জীবন
হাসি অশ্রু সেই দিন করিয়াছি বিসর্জন।
হাসিবার কাঁদিবার অবসর নাহি আর;
দুঃখিনী জনমভূমি- মা আমার, মা আমার।
… … …
মরিব তোমার কাজে, বাঁচিব তোমারি তরে,
নহিলে বিষাদময় এ জীবন কেবা?
যত দিন না মুছিব তোমার কলঙ্কভার,
যাক প্রাণ, থাক প্রাণ- মা আমার, মা আমার।
কবির দেশপ্রেমমূলক কবিতায় দেশপ্রেমের তীব্র আবেগের অভাব রয়েছে এ-কথা স্বীকার করতেই হয়। তিনি এই গোত্রের কবিতার চেয়ে উষ্ণ হৃদয়ের কবিতা রচনায় আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন—যার সঙ্গে তাঁর ছিল ব্যক্তিগত হৃদয়ের স্পর্শ। প্রেমের কবিতায় কবির যদিও আবেগের উত্তাপ কিছুটা ম্লান, তথাপি কবিতায় কিছু মানবিক স্পর্শ পাওয়া যায়। ‘যবে ছিল ভালবাসা’ কবিতায় কিছু মানবিক স্পর্শ পাওয়া যায়। ‘যবে ছিল ভালবাসা’ কবিতায় কবি লিখেছেন—
প্রাণে যবে ছিল ভালোবাসা, চোখে সব লেগেছিল ভাল
ভালোবাসা জীবনের মধু, ভালবাসা নয়নের আলো।
ভিতরে, বাহিরে প্রিয়, মোর কোনো কিছু হয়নি বদল,
তুমি প্রেম হারাইলে বলে, মোর চোখে বহাইলে জল।
কামিনী রায় বাইরে গৌরব, সম্মান, বিপুল পরিচিতি লাভ করলেও ব্যক্তিগত জীবনে সুখ ক্ষণিকের জন্য তাঁর জীবনে এসেছিল। স্বামী ও পুত্রের অকালমৃত্যু তাঁকে চরম আঘাত দিয়েছিল। ব্যক্তিগত হৃদয়ের আর্তি তাঁর কবিতায় আছড়ে পড়ে। তাঁর একটি সনেটে তিনি লোকান্তরিত স্বামীর কথা ব্যক্ত করেছেন—
প্রিয়তম, বিচ্ছেদের আছে অবসান
হেথায় পেয়েছি বহু তার পূর্বাভাস।
তবু কভু ঢাকি আঁখি করি অবিশ্বাস,
না শুনি অন্তরবাণী; জ্ঞান, সন্দিহান,
সত্যেরে কল্পনা বলি করে প্রত্যাখ্যান।
… … …
আজ অশ্রু আবরিত ক্ষীণ দৃষ্টি লয়ে
সেই সুদিনের তরে চেয়ে আছি পথ।
মোর দীর্ঘ তপস্যায় করুণার্দ্র হয়ে
দেবতা করুণ পূর্ণ এই মনোরথ—
সেবি এই ধরণীরে, সুখ দুঃখে ভরা,
লোকান্তরে হই তব সখী যোগ্যতরা।
জ্যেষ্ঠপুত্রের অকালমৃত্যুও কামিনী রায়ের মাতৃহৃদয়কে ব্যাকুল করে তুলেছিল। শোকস্তব্ধ মাতৃহৃদয়ের কান্না তাঁর লেখায় ধরা পড়েছে—
অন্ধকার ছায় যথা ধরণীর বুক,
তেমনি আমার বক্ষঃভরে বেদনায়
এই শান্ত সন্ধ্যাকালে। দূরে শোনা যায়
আনন্দ- সঙ্গীতধ্বনি। হাস্য ও কৌতুক,
নিরুৎসাহ চিত্ত মম অতি নিরুৎসুক
খোঁজে লুকাবার স্থান, নীরবতা চায়
লয়ে তার স্মৃতিখানি। আঁধারের গায়
সে আমার স্থির তারা চিত্ত জাগরূক।
হৃদয়ে রেখেছি তারে শুধু এ হৃদয়
কাঁদে নিত্য। এত কাছে ছিল না তো আরো?
ততদূরে গেছে বলি চোখে ঝরে জল
এক পুত্র গেছে মোর, তাহে মনে হয়
হয়েছি একান্ত নিঃস্ব। আশা নাহি জাগে
আলোকিত কর্মপথ, দেহে দিতে বল।
এই দুঃখ-বেদনা তাঁকে বাকি জীবন বয়ে চলতে হবে বলে কবির বিলাপ—
তবুও চলিতে হবে পথ দিবালোক
যতনে রাখিতে হবে পৃষ্ঠে গুরুভার
যতই দুর্বহ হোক, কে বহিবে আর?
জীবন হয়তো এভাবেই ফুরিয়ে যায়, ফুরিয়ে যায় মানুষও। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে জীবনের নতুন রং আনে বসন্ত। কবি কামিনী রায়ের জীবনের অন্তিম পর্বেও বসন্ত ধরা দেয়। বসন্তে ফোটে ফুল, কিন্তু সে ফুলে মধুর অভাব। কবির আক্ষেপ ধরা পড়ে কবিতায়—
বসন্ত কি সহসা এ নির্জন আবাসে
পশিয়াছে চুপি চুপি? নবীন পল্লবে
সাজিয়াছে তরুরাজি। ঝেড়ে দিল কবে
পুরাতন জীর্ণ পত্র? শীতল বাতাসে
বাতাবি ফুলের গন্ধ ধীরে ভেসে আসে
আমার গবাক্ষ পথে। ঘন কুহু রবে
মুখরিত আম্রবন, বসন্তই হবে।
… … …
রসে স্পর্শে দিতে চাহে দেহে আর চিত্তে
সব প্রাণ, কিন্তু হায়, নিঃশেষে ভরিয়া
কই দিতে পারে মধু? দূরে কোনখানে
থাকে অদেহীরা বঁধু, পার বলে দিতে?
বসন্ত আসে কিন্তু পরপার থেকে ‘অদেহী’-র বার্তা শোনা যায় না। কামিনী রায়ের চিন্তায় নৈরাশ্য, আশাভঙ্গ, স্বপ্নভঙ্গ মধ্য দিয়েই জীবনের পথ অতিক্রম করার কথা বারবার এসেছে। কবির একমাত্র আকাঙ্ক্ষা ছিল—
যশঃ আমি চাহি নাই, চেয়েছিনু স্নেহ ,
চেয়েছিনু একখানি শান্তিভরা গেহ
নহে কলরবপূর্ণ সভা-সম্মিলনে
অজস্র চক্ষের দৃষ্টি।
কবির ব্যক্তিগত জীবন-যন্ত্রণা সেই শান্তিসুখ থেকে কবিকে বঞ্চিত করেছে। ব্যক্তিগত জীবনের ছায়া কবিতার মধ্যে পড়ে পাঠক হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। সংস্কৃত সাহিত্যে কামিনী রায়ের যে যথেষ্ট দখল ছিল, ‘চন্দ্রাপীড়ের জাগরণ’- কবিতায় সেই চিহ্ন পাওয়া যায়—
অন্ধকার মরণের ছায়
কত কাল প্রণয়ী ঘুমায়?
চন্দ্রাপীড়, জাগো এইবার।
বসন্তের বেলা চলে যায়,
বিহগেরা সান্ধ্যের গীত গায়,
প্রিয়া তব মুছে অশ্রুধার।
কামিনী রায়ের কবিতা একসময় পাঠকসমাজের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। চার দশকের অধিক কাল (১৮৮৯-১৯৩০) নানা ধরনের কবিতা লিখে তিনি ছটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। ‘নব্যভারত’, ‘প্রবাসী’, ‘বিচিত্রা’ ও ‘বঙ্গলক্ষ্মী’-তে কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হয়, কিন্তু সে কবিতা কোনো সংকলন গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সাহিত্যচর্চা ছাড়াও কামিনী রায় দেশ ও দশের কাছ থেকে সমাদর লাভ করেছিলেন জনকল্যাণমূলক কাজে। দৈনন্দিন কাজকর্মের মধ্যে থেকেও কবি নারী সেবামূলক ও নারীশিক্ষা বিস্তারের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। ‘Some Thoughts on the Education of our Women’(১৯১৮) গ্রন্থে তিনি আমাদের নারীশিক্ষা সম্বন্ধে মৌলিক চিন্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘সরোজিনী বসু’ সুবর্ণপদক দিয়ে সম্মানিত করে। বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে (১৯শ সম্মেলন, ১৯৩০) তিনি সাহিত্যশাখার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেরও সহকারী সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
কামিনী রায়ের চিন্তাভাবনা পুরাতনপন্থী, কাব্যে সরসতার অভাব, বিষাদময়তা, নৈরাশ্য—এসব অভিযোগ উঠলেও উনিশ ও বিশ শতকের মহিলা কবিদের মধ্যে এখনও তিনি নিজ প্রতিভা বলে স্বাতন্ত্র্য ও গৌরব রক্ষা করছেন। কামিনী রায়ের কবিতা একান্তভাবেই নারীচিত্তের বৈশিষ্ট্যে অনুরাগরঞ্জিত। তাঁর বাচনভঙ্গির মধ্যেও আমরা সৌকুমার্য লক্ষ করি। হেমচন্দ্রের মতো কামিনী রায় প্রবহমান, যতিপ্রান্তিক পয়ার, ত্রিপদী, চৌপদী বিশিষ্ট কলামাত্রিক ছন্দে লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের অনুসরণে সমিল পয়ার ছন্দেও কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। পেত্রার্কের অনুভাবনায় কবি সনেট লিখেছেন শতাধিক। কল্পনার ঐশ্বর্যে উজ্জ্বল কামিনী রায়ের সনেটগুলি। উনিশ ও বিশ শতকের মহিলা কবিরা গার্হস্থ্য ও পারিবারিক জীবনের বাতায়ন থেকে বিশ্বকে লক্ষ করেছিলেন তার জন্য সাধুবাদ দিতেই হয়। কামিনী রায় সেই কবি যাঁর দৃষ্টি সুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। শেষ জীবনে নির্বাচিত সংগ্রহ যখন প্রকাশ করার কথা ভাবা হচ্ছিল, তখন কামিনী রায় উদাসীনভাবে বলেছিলেন— ‘‘যে যাত্রার পর প্রত্যাবর্তন নাই, তাহার জন্য উন্মুখ হইয়া আছি ; কাছাকাছির দিকে মন দিতে পারিতেছি না।’’ তিনি লিখেছেন—
যাহা আছে রেখে যাই, গাহিতে সময় নাই
বুঝি না জমেছে গীত যত ;
কি যে তার দামী, কিবা খেলো কি যে শুধু কথা এলোমেলো
কতটুকু প্রাণহীন, কতটুকু বাঁচিবার মত।
কবি কামিনী রায়ের জীবনে কিছু অব্যক্ত কথা থাকলেও, প্রকাশে যে গীত বেঁচে আছে সেই গীতকেই পাঠকসমাজ বিপুল পরিমাণে হৃদয়ঙ্গম করেছিল বলেই বাংলা কাব্যজগতে উনিশ ও বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে আসীন। আপামর বাঙালিকে যা উজাড় করে দিয়েছেন তিনি তা সত্যিই অভিনব।
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments
সুন্দর লেখা। কামিনী রায়কে নিয়ে এত তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ লেখার জন্য লেখককে ধন্যবাদ। পড়ে রসাস্বাদন করলাম।
- Pritha Chatterjee
Sun, Jun 13, 2021 9:45 PM
Khub sundor lekha.
- Priti pal
Mon, Jun 14, 2021 6:06 AM