১১ শতকে বাংলায় তখন চলছে পাল যুগ। চক্রপাণি দত্ত ছিলেন সে সময়কার একজন বিখ্যাত চিকিৎসক। তাঁর লেখা ‘‌দ্রব্যগুণ’‌ বইটিতে তখনকার দিনে চালু নানা ধরনের খাবার-দাবারের ভালো–‌মন্দ বিষয়ে অনেক তথ্যই জানা যায়। সেই বইটিতে তিনি ‘‌লুচি’‌র বর্ণনা দিয়েছিলেন ‘‌সুমিতায়া ঘৃতাক্তায়া লোপত্রীং কৃত্বা চ বেল্লয়েৎ। আজ্যে তাং ভজ্যয়েৎ সিদ্ধাং শঙ্কুলী ফেনিকা গুণাঃ’‌ বলে। যেটি বাংলা করলে দাঁড়ায়:‌ গম চূর্ণকে ঘি দিয়ে মেখে, লেচি করে বেলে, গরম ঘিয়ে ভেজে তৈরি করা হয় শঙ্কুলী, যার গুণ ফেনিকার মতো।’‌ এই শঙ্কুলীই হল যুগ যুগ ধরে বাঙালির রসনায় তুমুলভাবে ভর করে থাকা ঐতিহ্যবাহী লুচি বা ‘‌নুচি’‌র আদি রূপ। চক্রপাণির সময়ে এই শঙ্কুলী বা লুচির তিন ধরনের প্রকারভেদ ছিল— খাস্তা, সাপ্তা ও পুরি। এর মধ্যে খাস্তা লুচি তৈরি হত ময়ান দিয়ে ময়দার লেচি বেলে ও ভেজে। ময়ান ছাড়া ময়দার লেচি থেকে তৈরি লুচিকে বলা হত সাপ্তা, আর ময়দার বদলে আটার লেচি থেকে ভাজা লুচির নাম ছিল পুরি। তবে যে নামেই পরিচিত হোক, লুচি কিন্তু বাঙালির খাদ্যতালিকায় ছিল এবং আছে প্রথম সারিতেই— সে-যুগে, এ-যুগেও। বিভিন্ন উপলক্ষ্যেই লুচি দিয়ে আহার বাঙালি হিন্দুদের জীবনের অঙ্গ হয়ে ছিল এবং আছে। যে-কোনো পুজোতেও ভোগ হিসেবে লুচি নিবেদন এবং তা প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ দীর্ঘকালের ঐতিহ্য হিসেবে আজও বর্তমান। পাকা দেখা থেকে প্রীতিভোজ— বাঙালিবাড়ির বিয়ের প্রতিটি অনুষ্ঠানে লুচি, আলুর দম, ছোলার ডাল আর বোঁটা–‌সহ লম্বা ফালি করে কাটা বেগুন ভাজার পুরোনো ঐতিহ্য ফিকে হয়ে এলেও এ-দেশীয় বহু পরিবার থেকে এখনও তা পুরোপুরি বিদায় নেয়নি।
পুরাকালের ধর্মমঙ্গল কাব্যেও জনপ্রিয় খাবার হিসেবে লুচির উল্লেখ যেমন আছে, তেমনই উনিশ শতকের বাংলাতেও যে উত্তম ফলারের সর্বপ্রথম উপাদান হিসাবে খাবারের তালিকায় লুচি ছিল বহাল তবিয়তে, তার নমুনা পাওয়া যায় খ্যাতনামা রামনারায়ণ তর্কালঙ্কার মশাইয়ের ‌বিখ্যাত ‘‌কুলীন কুলসর্বস্ব’‌ নাটকের সংলাপে। পাল যুগের পরিচিত খাস্তা শঙ্কুলীই হল আজকের মুখরোচক নোনতা খাবার লুচি। আটার লুচি অর্থাৎ সেই সময়কার পুরি উত্তর ভারত তথা হিন্দি বলয়ে আজও সেই একই নামে দিব্য টিকে আছে। তবে লুচি বা পুরির ভেতরে কোনো পুর থাকে না, পুর ভরা হলেই তা হয়ে যায় লুচির রকমভেদ, অর্থাৎ ডালপুরি, রাধাবল্লভী বা কচুরি। লুচির পাশাপাশি তার এই প্রকারভেদও কিন্তু খাবার হিসেবে বেশ জনপ্রিয়।
লুচি তৈরির মূল উপকরণ হল ময়দা, নুন, জল আর ঘি কিংবা তেল। কখনো-কখনো আরও উপাদেয় করে তুলতে সামান্য সুজি বা চিনিও মেশানো হয় এই উপকরণগুলির সঙ্গে, আরও বেশি ফুলকো করে তোলার জন্য। আর কে না জানে, খাবার পাতে গরম গরম ফুলকো লুচির জন্য অধিকাংশ বাঙালি আজও জাস্ট পাগল। সে যে কোনো বিশেষ অনুষ্ঠান থেকে পুজো কিংবা ছুটির দিনের জলখাবার— যা–‌ই হোক না কেন। তবে এক সময় শুধুমাত্র খাঁটি গব্য ঘৃত বা গাওয়া ঘিয়ে ভাজা হলেও এখন খরচ বাঁচাতে ঘিয়ের বদলে সর্ষের তেল থেকে শুরু করে নানাবিধ ভোজ্য তেল বা ডালডা দিয়েও লুচি ভাজা হয়। তবে ভোজনে প্রকৃত তৃপ্তি পেতে মোলায়েম, ফুলকো লুচিই হল ফার্স্ট চয়েজ, যার জন্য অবশ্যই দরকার ভালো ঘিয়ের ময়ান দেওয়া খাঁটি ঘিয়ে ভাজা লুচি। ১৬ ভাগ ময়দার জন্য এক–‌দুই ভাগ ঘিয়ের ময়ানই হল প্রকৃত লুচি বানানোর চাবিকাঠি। ময়ান দেওয়া, নুন ও জল দিয়ে মাখা ময়দার মণ্ডটিকে যত ঠাসা হবে, ততই উৎকৃষ্ট লুচির উৎপাদন নিশ্চিত হবে। ময়ানের অভাবে যেমন লুচি কড়া বা শক্ত হয়ে যায়, তেমনই বাড়তি ময়ান লুচিকে নিটোল থাকতে দেয় না, ভেঙে যায় লুচির শরীর। ঘি, নুন, জল দিয়ে মাখা ময়দার মিশ্রণটি তৈরি হয়ে গেলে তা থেকে ছোটো ও গোলাকার লেচি, লেট্টি কিংবা গুটি কেটে চাকিতে বেলে চ্যাপটা এবং গোল লুচির আকার দিয়ে তাকে শেষমেশ কড়ায় গরম করা ঘি বা ছাঁকা তেলে ছেড়ে দিলে যদি ঠিকঠাক ফুলে ওঠে, তাহলেই ফুলকো লুচির মর্যাদা লাভ করে তা হয়ে ওঠে জিভে জল আনা লোভনীয় খাবার। সঙ্গে ছোলার ডাল বা বেগুনভাজা কিংবা আলুর দম— ব্যস, ভোজনরসিক বাঙালিকে আর পায় কে!‌ আড়াই প্যাঁচে যেমন জিলাপি তৈরি হয়, তেমনই চাকিতে আড়াই টানে ময়দার লেচিকে লুচিতে রূপ দেওয়ার প্রথাও বহু বাঙালি ঘরে বিদ্যমান।


বিশুদ্ধ লুচির রং অবশ্যই সাদা হতে হবে। কোনো কারণে তা লালচে হয়ে গেলেই বিশুদ্ধ ভোজনরসিকের কাছে তার নম্বর কাটা যাবে!‌ আর আজকাল যে ময়দার সঙ্গে আটার মিশেলে, বা কখনও শুধু আটা দিয়ে লুচি বানানো হয়, তার তো ছিটেফোঁটা দামও দেবেন না প্রকৃত খাদ্যরসিক, বিশেষ করে এ-দেশীয় বাঙালি পরিবার। বাঙালি হিন্দু অভিজাত পরিবারে আবার এর সঙ্গে তিন আঙুলে, অর্থাৎ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ, তর্জনী আর মধ্যমার ডগা দিয়ে ছিঁড়ে ব্যঞ্জন সহকারে লুচিকে মুখে চালান করা যাচ্ছে কিনা তা দিয়েই বিচার হয় লুচির শ্রেষ্ঠত্ব। অর্থাৎ লুচি হল বাঙালির পুরোনো আভিজাত্যের প্রতীক। 
তবে স্থানবিশেষে লুচির মাপের ভিন্নতাও দেখা যায় এই বঙ্গে। খোদ শহর কলকাতায় লুচির ব্যাস তিন থেকে চার ইঞ্চি হলেও গ্রাম বাংলার প্রচলিত লুচির ব্যাস এর প্রায় ডবল, মানে ছয় থেকে আট ইঞ্চি। কোথাও কোথাও আবার বগি থালা, বড়ো প্লেট কিংবা সত্যিকারের হাতির পায়ের মাপের লুচির প্রচলনও আছে। দেবদেবীর পুজোতেও বাংলার নানা এলাকায় এই ধরনের লুচি ভোগের উপচার হিসেবে নিবেদিত হয়। আবার এক–‌দেড় ইঞ্চি ব্যাসের ক্ষুদ্রতম লুচিও দেবতার ভোগে জায়গা করে নেয় কোথাও কোথাও। কোনো-কোনো বাঙালি হিন্দু পরিবারের জন্মাষ্টমী পুজোয় ময়দার বদলে তালের মণ্ড দিয়ে বানানো তালের লুচিও ভোগে নিবেদিত হয়। তবে বিশুদ্ধ লুচির আভিজাত্য নিয়ে বনেদি বাঙালি পরিবারের যত বড়াই থাকুক না কেন, পুজোর ভোগের লুচি নিয়ে তত ছুঁৎমার্গ নেই কারওরই। প্রসাদ হিসেবে তা সবার কাছেই সহজে গ্রহণীয় এবং স্বাদে বিচ্যুতি ঘটলেও যথেষ্ট উপাদেয়।
এবার জানাই নানা অঞ্চলের খ্যাত–‌অখ্যাত বিভিন্ন পুজোয় দেবদেবীকে উৎসর্গীকৃত ভোগের লুচির বিস্তারিত তথ্যে। খোদ কলকাতায় বড়োবাজারের বসাক বাড়ির তিনশো বছরের পুরোনো অষ্টধাতুর সিংহবাহিনী দুর্গাপুজোয় প্রতিদিন ছোলা–‌মটর–‌মুগডালের পাঁচ কড়াই ভোগের সঙ্গে থাকে অন্যতম পদ হিসেবে গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি। সঙ্গে পাঁচ রকমের ভাজা, কুমড়োর ছক্কা, ধোঁকার ডালনা, পাঁপড় ভাজা, হালুয়া, চাটনি, রকমারি মিষ্টি ও ফলের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পদ। কোনো অন্নভোগ দেওয়া হয় না। জোড়াসাঁকোর ঐতিহ্যবাহী বন্দুকওয়ালা দাঁ বাড়ির দুর্গাপুজোতেও প্রতিদিনের ভোগে থাকে লুচির সঙ্গে মিহিদানা, ল্যাংচা, বালুসাই, গজা, চন্দ্রপুলি, নাড়ু, ক্ষীর, রাবড়ি, দই আর চাল ও ফলের নৈবেদ্য। এখানেও রান্না করা অন্নভোগের ব্যবস্থা নেই। 


জবাকুসুম–‌খ্যাত বর্ধমানের অম্বিকা কালনার ঐতিহ্যবাহী সেন পরিবারের তিনশো বছরের পুরোনো দুর্গাপুজোয় প্রতিদিনের ভোগে থাকে খাঁটি গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি আর মিহিদানা, বোঁদে, গজা, মাখা সন্দেশ–‌সহ দশ রকমের মিষ্টি ও ফল। এ ক্ষেত্রেও কোনোরকম অন্নভোগ দেওয়া হয় না। মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজার ছোটো রাজবাড়ির পুজোতেও লুচি ভোগ হল অন্যতম উপচার। তিনশো বছরের প্রাচীন এই পুজোয় দিনে ভোগ হিসেবে অন্য পদের সঙ্গে লুচি থাকলেও রোজ সন্ধের শীতল ভোগে লুচিই হল প্রধান পদ। সঙ্গে পায়েস, সুজি ও ক্ষীর। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরে কান্তনগরে রয়েছে কান্ত জিউ মন্দির। সেখানে এক সময় যে লুচি ভোগ হিসেবে দেওয়া হত, তা ছিল এক–‌একটা বগি থালার আকৃতির। দু’‌হাতে ছিঁড়ে ডাল, দই বা ক্ষীর মাখিয়ে তা ভক্ষণ করতেন মন্দিরের ভক্তজন। মালদা জেলায় দেখা যায় ১২ ইঞ্চিরও বেশি ব্যাসের লুচি। মালদার ইংরেজবাজারের কাছে সাদুল্লাপুর শ্মশান এলাকায় দেবতার ভোগ হিসেবে যে লুচি দেওয়া হয় তার এক–‌একটার আকৃতি সত্যিকারের হাতির পায়ের মাপের। তাই একে বলা হয় হাতিপায়া লুচি। মকর সংক্রান্তির দিন ভাগীরথী নদীতে স্নান সেরে ভক্তরা সেই লুচি খান। মেদিনীপুর জেলার রাধামোহনপুর স্টেশনের কাছে পলাশী গ্রামে অবস্থিত নন্দী পরিবারের ঠাকুরবাড়িতে ভোগে দেওয়া হয় এক–‌দেড় ইঞ্চি মাপের ছোট্ট ছোট্ট লুচি। এটিকেই সমগ্র ভারতের মধ্যে সম্ভবত ক্ষুদ্রাকার লুচি হিসেবে মতপ্রকাশ করেছেন গবেষক প্রণব রায়।  
বাঙালি হিন্দুদের জীবনে লুচির যে বিশেষ স্থান বা মর্যাদা রয়েছে, তা আগেই লিখেছি। প্রাতরাশ থেকে বিকালের আহার হিসেবে তো বটেই, এমনকি মধ্যাহ্ন বা নৈশভোজেও লুচির একটা আলাদা জায়গা আজও বর্তমান, বিশেষত অভিজাত, বনেদি পরিবারে। নানা উপলক্ষ্যে লুচির প্রচলন ফাস্ট ফুড, জাঙ্ক ফুডের এই রমরমার দিনেও অব্যাহত। আর পুজোআচ্চায় দেবতার ভোগে লুচির হাজিরা তো প্রায় একচেটিয়া। পুজোর পর ভোগের লুচি প্রসাদ হিসেবে পেতে কে না উৎসুক হয়!‌ দুর্গাপুজোর ষষ্ঠী, অষ্টমীতে বিশেষ করে লুচির সঙ্গে ছোলার ডাল বা লাবড়া কিংবা আলুরদম আর বেগুনভাজা পেলে বাঙালি লোভ সামলাতে পারে না। এমনকি ভাতের ওপর যখন কোনো অনুষ্ঠান বা পরবে বিধিনিষেধ থাকে, তখন সগৌরবে সেই স্থান দখল করে নেয় লুচিই। ধর্মীয় অনুষ্ঠান কিংবা পুজোপার্বণে তো বটেই, অন্যান্য অনেক উপলক্ষ্যেই বাঙালির পাতে লুচির হাজিরার কমতি নেই কোনো। 
ভোগের লুচি বিষয়ে একটু আগেই উল্লেখ করে এসেছি নানাবিধ মিষ্টান্ন সহযোগে তা দেবদেবীর পুজোয় অর্পণ এবং পরে ভোগ হিসেবে গ্রহণের কথা। মিহিদানা, বোঁদে, ল্যাংচা, ক্ষীর, রাবড়ি, মাখা সন্দেশ, যে মিষ্টি দিয়েই হোক না কেন, লুচির সঙ্গে আহার বা প্রসাদ হিসেবে জমে না— এ-কথা মুখে আনার মতো বাঙালি কি সত্যিই খুঁজে পাওয়া যাবে!‌ জাঙ্ক বা ফার্স্ট ফুডে অভ্যস্ত এই প্রজন্মের প্যাংলা থেকে মোটকু ছেলেমেয়েদের সামনে প্লেটে বাড়িয়ে দিয়ে দেখুন, অন্য খাবারে রুচি না থাকলেও এ-ক্ষেত্রে এতটুকু না নেই!‌ এমনকি একটু গুড় বা চিনি দিয়েও দিব্য সাঁটিয়ে দেওয়া যায় গন্ডা খানেক লুচি!‌ আর যদি সঙ্গে থাকে বেগুন বা সরু করে কাটা আলু ভাজা, কিংবা ধোঁকার ডালনা বা আলুর দম কিংবা ছোলার ডাল— পাতে পড়তে পাবে না!‌ এটাই লুচির আসল মাহাত্ম্য। যা–‌ই দাও সঙ্গে, খাই মহানন্দে!‌
এবার আসা যাক বাংলার কিছু বিখ্যাত মন্দিরের লুচি ভোগের প্রসঙ্গে। ‌‌বীরভূমের প্রখ্যাত তারাপীঠের মন্দিরে দুপুরের নিত্যভোগে পোলাও, খিচুড়ি, অন্নভোগ, বলির মাংস, মাছ ইত্যাদি নিবেদন করা হলেও বছরের একটা দিন এ নিয়মের ব্যতিক্রম হয়। কোজাগরি লক্ষ্মীপুজোর আগের দিন, অর্থাৎ আশ্বিন মাসের শুক্লা চতুর্দশী তিথিটিকে তারা মায়ের আবির্ভাব দিবস হিসেবে ধরা হয়, সেদিন দেবীমূর্তিকে সারাদিন মূল মন্দিরের বাইরের চত্বরে বিরাম মঞ্চে রাখা হয়। সেখানেই দর্শন চলে এবং দুপুরের নিত্যভোগে অন্নভোগের বদলে থাকে লুচি, নাড়ু, মিষ্টি। সন্ধের পর যখন দেবীমূর্তিকে মূল মন্দিরে স্বস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে সন্ধ্যারতি শুরু হয়, তখন দুপুরের অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। বংশ পরম্পরায় সারা বছর এই মন্দিরের ভোগ রান্না করেন ময়ূরেশ্বর থানার দক্ষিণগ্রামের কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা। মায়ের লুচি ভোগও তাঁরাই বানান বলে জানালেন এই মন্দিরের সেবায়েত সমিতির সভাপতি তারাময় মুখোপাধ্যায়।
কালীঘাট মন্দিরে বিশেষ বিশেষ পুজোর দিনে সন্ধের শীতলভোগে থাকে ময়দার লুচি, সঙ্গে আলুভাজা, রাবড়ি, রসগোল্লা আর পান। হাজারের ওপর মানুষ প্রসাদ গ্রহণ করেন এইসব দিনে বলে জানা গেল অন্যতম সেবায়েত গৌরহরি গাঙ্গুলির কাছ থেকে। চক্রবর্তী ও ভট্টাচার্য পরিবারের ব্রাক্ষণরা মাছ–‌মাংস–‌শুক্তো–‌ভাজা–‌সহ পোলাও, পায়েস, চাটনি, খিচুড়ি থেকে লুচি— ভোগের যাবতীয় পদ রান্নার দায়িত্বে থাকেন।
দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী কালী মন্দিরের রাতের ভোগে থাকে লুচি, ছানার তরকারি, রাবড়ি–‌সহ পাঁচ রকমের মিষ্টি। হুগলির বিখ্যাত মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরে সারা বছর শীতল ভোগে থাকে হাতিপায়া লুচি, নানা অঞ্চলে যে লুচির চলের কথা আগেই বলেছি। এখানে বিশালাকার হাতিপায়া লুচি–‌সহ যাবতীয় ভোগ রান্নার দায়িত্ব পারিবারিক সূত্রেই গত প্রায় ২৫ বছর ধরে সামলাচ্ছেন পঞ্চানন চক্রবর্তী ও শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য, জানালেন প্রধান সেবায়েত সৌমেন অধিকারী। উল্লেখ্য, এই হাতিপায়া লুচি কোনো-কোনো অঞ্চলে কেজি দরেও বিক্রি হতে দেখা যায়। 
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুকের বর্গভীমা মন্দির জনপ্রিয় এক সতীপীঠ। এখানেও সন্ধের শীতলভোগে নিত্য নিবেদিত হয় লুচি, সঙ্গে আলুভাজা, পাঁচ রকমের মিষ্টি, ক্ষীর এবং ফল। কাঠের আঁচে গাওয়া ঘি দিয়ে ভাজা হয় এই ভোগের লুচি। নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দির কিংবা মায়াপুরের বিখ্যাত ইসকনের মন্দিরেও অন্নভোগের পাশাপাশি নিবেদন করা হয় লুচি ভোগ।
তামাম বাংলা জুড়েই প্রকৃত ভোজনরসিকের হৃদয়ে লুচির একাধিপত্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। বাঙালির লুচিপ্রীতির ভূরি ভূরি প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে গোটা বাংলা জুড়েই। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে কথায় কথায় লুচির ছররা ছুটত বলে জানা গেছে অবন ঠাকুরের লেখায়। বিখ্যাত বাঙালি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীকে বলা কিরণময়ীর সংলাপটি মনে পড়ছে— ‘‌আমার সঙ্গে রান্নাঘরে এসো, দু’‌খানা লুচি ভেজে দিতে আমার দশ মিনিটের বেশি লাগবে না।’‌ আমাদের ছেলেবেলাতেও দেখা, রবিবারের সকাল মানেই লুচি–‌ভোজ। কুমড়োর ছক্কা, না ছোলার ডাল, নাকি আলুরদম বা বেগুনভাজা— কে হবে তার দোসর— তা নিয়েও ঘরে ঘরে যুক্তি–‌তর্কের আসর বসে যেত। অতিথি আপ্যায়নেও ছিল লুচির বিশেষ ভূমিকা। সে-সব দিন কিন্তু আজ এই ডিজিটাল যুগে, সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমা দিনেও যে একেবারে গত হয়নি, তার প্রমাণ ফেসবুকে গাদা গাদা লুচি ভাজা ও ভোজের ছবি পোস্ট কিংবা ইউ টিউবে লুচি শিক্ষণ প্রণালির ভিডিয়ো আপলোডিং!‌ গেরস্থ বাড়ির বিশেষ প্রাতরাশ বা নৈশভোজ থেকে শুরু করে দেবদেবীর পুজোর ভোগে লুচির বিশেষ গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য যে আজও বর্তমান, সেও তো এ লেখার সামান্য কিছু নমুনা পেশের মধ্য দিয়েই বোধগম্য হল!‌ নেহাত আজকাল মাসি–কাকি–‌‌পিসিসহ যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবারের ছবিটা বিদায় নিয়েছে, পাশাপাশি পরিবারগুলো ভেঙে ভেঙে ক্রমেই মাইক্রো হয়ে পড়ছে, ফলে হাতে হাতে ময়দা মেখে, লেচি বানিয়ে, বেলে লুচি ভেজে খাওয়ার মতো সময়ে টান পড়েছে, তবু বাঙালি নারীরা রান্নাঘরে একটু সময় বরাদ্দ করতে পারলে নানাবিধ রেসিপির পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পাশাপাশি, ফিউশন ফুড নিয়ে ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে সেকেলে লুচির কথাও ভুলতে পারেন না!— আহা, কর্তাটি একটু লুচি–‌ছোলার ডাল বা বেগুন ভাজা পেলে আর কিছু চায় না, কিংবা বাবুটা যে পান্তুয়া দিয়ে লুচি খেতে কী ভালোবাসে— এমত কেয়ারিং ভাবনা থেকে। আজও তাই চিরকালীন প্রথা হিসেবে লুচি বা নুচি দিব্য স্বমহিমায় বিরাজমান বাঙালি হেঁশেল কিংবা ডাইনিং টেবিলে!‌ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *