ভোজেশ্বর পালচৌধুরি পরিবারের
পুজো এবার ৩৫৩ বছরে
প্রীতিময় রায়বর্মন

বন্দরে ব্যবসার কাজ সেরে একদিন বাবা ও তিন ছেলে নদীপথে নৌকায় বাড়ি ফিরছিলেন। আস্তে আস্তে পশ্চিমাকাশে অস্ত যাচ্ছে সূর্য, নামছে সন্ধে। এমন সময় লালপাড় সাদা শাড়ি পরিহিত অল্পবয়সী এক মহিলা এসে তাঁদের অনুরোধ করেন তাঁকে তাঁর গন্তব্যে পৌঁছে দেবার। কিন্তু মহিলার সঙ্গে কোনও পুরুষ না থাকায়, নৌকায় থাকা তিন ছেলে মহিলাকে নৌকায় তুলতে রাজি হননি। পরে বাবার অনুরোধে তাঁরা ওই মহিলাকে নৌকো করে তাঁর গন্তব্যে পৌঁছে দেন। ইতিমধ্যে অনেকটাই রাত হয়ে যাওয়ায় বাড়ি ফেরা সম্ভব নয় বুঝে তাঁরা ঠিক করেন রাতটা জঙ্গলেই কাটাবেন। রাতে তাঁরা প্রত্যেকে স্বপ্নে দেখেন তাঁদের নৌকায় নদী পার হওয়া ওই মহিলা আসলে স্বয়ং মা দুর্গা। তাঁদের ব্যবহারে খুশি হয়ে দেবী তাঁদের আশীর্বাদ করেন এবং স্বপ্নাদেশ দেন তাঁর পুজো করার।

কিন্তু পুজোর অনেক খরচের কথা তাঁরা দেবীকে জানালে, স্বয়ং দেবী তাঁদের আশ্বস্ত করেন, তাঁরা পুজো করলে তিনিই তাঁদের সব ব্যবস্থা করে দেবেন। দেবী তখন তাঁদের পরেরদিন আবার বন্দরে যাওয়ার আদেশ দেন এবং বলেন, বন্দরে গিয়ে যে জিনিসটা প্রথম দেখবে সেটাই যেন তাঁরা কিনে নেয়। দেবীর কথা অনুযায়ী তাঁরা বন্দরে যান এবং দেখেন এক চাষী নৌকো ভর্তি শুকনো লঙ্কা নিয়ে বসে আছেন, তখন তাঁরা ওই চাষীর কাছ থেকে নৌকো বোঝাই শুকনো লঙ্কা কিনে নেয়। এর কিছুক্ষণ পরেই এক ইংরেজ এসে দ্বিগুণ দামে তাঁদের কাছ থেকে সেই শুকনো লঙ্কা কেনেন। ব্যবসার এই বিপুল মুনাফা দিয়েই শুরু হয় তাঁদের পরিবারে মা দুর্গার আরাধনা। এরপর তাঁদের উন্নতির অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটতে থাকে। তাঁরা হন ভোজেশ্বরের জমিদার। পরবর্তীকালে ইংরেজদের কাছ থেকে পান চৌধুরি উপাধি। ওপার বাংলায় সেই ইংরেজ আমল থেকেই শুরু ভোজেশ্বর পালচৌধুরি পরিবারের দুর্গাপুজো। দেশভাগের পর এপার বাংলায় স্থানান্তরিত হয় পুজো। ওপার বাংলা থেকে ঘটের মাটি এনে পুজো প্রতিষ্ঠিত হয় এপার বাংলায়। পুজো শুরুর ইতিহাস সম্পর্কে এমনই তথ্য উঠে এল পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য সুবীর পালচৌধুরি এবং অঞ্জনা পালচৌধুরির সঙ্গে কথোপকথনে। 

ওপার বাংলায় শুরু হওয়া ঐতিহ্যবাহী ভোজেশ্বর পালচৌধুরি পরিবারের পুজো এবার ৩৫২ বছর পূর্ণ করে পদার্পণ করল ৩৫৩ বছরে। সাধারণত দুর্গার ডানদিকে লক্ষ্মীর পাশে থাকে গণেশ এবং বাঁদিকে সরস্বতীর পাশে থাকে কার্তিক। কিন্তু এখানে ডানদিকে লক্ষ্মীর পাশে কার্তিক ও বাঁদিকে সরস্বতীর পাশে গণেশ— স্বপ্নে এভাবেই ছেলে–মেয়েদের নিয়ে দেখা দিয়েছিলেন মা দুর্গা। সেই রীতি আজও অক্ষুন্ন।   
পুজোয় থাকে নানারকম আচার–বিচার বা নিয়ম। এ ব্যাপারে কথা হল পুরোহিত তাপস বশিষ্ঠের সঙ্গে। তাপসবাবুর বাবা, ঠাকুরদা, তাঁর বাবা অর্থাৎ পূর্বপুরুষরা পারিবারিক ভাবে এই পুজো করে আসছেন সেই ওপার বাংলা থেকে। তাপসবাবু নিজে পুজো করছেন টানা ৪০ বছর। তাঁর বাবাও পুজো করেছিলেন প্রায় ৫০–৬০ বছর। তাপসবাবু জানালেন, রূপোর অলংঙ্কারে সেজে ওঠেন মা দুর্গা। খাঁড়া থেকে ত্রিশূল, পদ্ম সবই রূপোর। মায়ের জন্য একেকদিন একেকরকম ভোগের ব্যবস্থা থাকে। যেমন মন্ডা–মিঠাই, ক্ষীর, ছানা, নানারকম সন্দেশ, উপ্‌রা ইত্যাদি। রোজই মাকে উৎসর্গ করা হয় কুমড়ো, চাল কুমড়ো, মানকচু, নারকেল, বাতাবি লেবু ও আখ। মহালয়ার আগে পঞ্জিকানুযায়ী শুভ তিথিতে পরিবারের সব মহিলা সদস্য (‌প্রায় ৭০–৮০ জন)‌ এক জায়গায় মিলিত হয়ে বানান দুর্গা ও লক্ষ্মী পুজোর নারকেল নাড়ু, ক্ষীরের নাড়ু, মোয়া, উপ্‌রা ইত্যাদি।  

পুজো পরিচালনা ও দেখভালের জন্য রয়েছে ট্রাস্টি বোর্ড। শরিকি এই পুজো পালা করে অনুষ্ঠিত হয়। সবচেয়ে কম ৪ বছর এবং সবচেয়ে বেশি ১৬ বছরের পালা। অর্থাৎ কোনও শরিকের বাড়িতে ৪ বছর অন্তর আবার কোনও শরিকের বাড়িতে ১৬ বছর অন্তর পুজো অনুষ্ঠিত হয়। শরিকদের ভাগ করা হয়— পুবেরদ্বার, পশ্চিমেরদ্বার, উত্তরেরদ্বার ও দক্ষিণেরদ্বারে। কোন দিকে কোন শরিকের বাড়ি সেই অনুযায়ী পুজোর স্থান পরিবর্তন হয়। ঠিক যেভাবে ওপার বাংলায় হত। এ বছর পুজো অনুষ্ঠিত হচ্ছে শোভাবাজার গোসাইপাড়ায়। পরের বছর হবে রাজারহাটে। জানালেন পরিবারের সদস্য সৌম্য পালচৌধুরি ও স্ট্রাস্টের চেয়ারম্যান বিভূতি পালচৌধুরি।
পুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ খাওয়াদাওয়া। রোজই ভালো–মন্দ খাবারের বন্দোবস্ত থাকলেও এলাহি আয়োজন হয় নবমীর দিন। ওই দিন থাকে জ্ঞাতি ভোজনের বিশাল আয়োজন। আসেন সব আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব। আর ওইদিনের মেনুতে মাস্ট ইলিশ মাছের পদ আর দশমীতে পুঁটি মাছ ভাজা। পরিবারের রীতি মেনে দশমীর পর আর বাড়িতে আসে না ইলিশ মাছ। আবার ইলিশের আগমন হয় পরের বছর ১লা মাঘ। 

আমরা কথা বলেছিলাম গতবছর পালচৌধুরি পরিবারের পুজোয় আসা আইনজীবী শৈবাল দাসের সঙ্গে। তাঁর কাথায়, যদি এই পুজো ঢাকার না হয়ে, কলকাতায় শুরু হত, তাহলে এটি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন পুজোর মধ্যে পড়ত। তিনি আরও বলেন, পুজো মানে তো শুধু পুজোই নয়, সব আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের মিলন উৎসব। পুজো আমাকে কখনও সেভাবে আকর্ষণ করেনি। কিন্তু হঠাৎই ছেলের পেশাগত কাজের জন্য গেছিলাম। যদি ওখানে না যেতাম, তাহলে জীবনে অনেক কিছুই দেখতে পেতাম না। দেখতে পেতাম না একটা একান্নবর্তী পরিবারকে, তাঁরা কীভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পুজো করছে। এটাও এই প্রজন্মের ছেলে–মেয়েদের কাছে পরম প্রাপ্তি।
ভোজেশ্বর পালচৌধুরি পরিবারের পুজোর অন্যতম এক আচার ‘টাকা–যাত্রা’। এ ব্যাপারে অঞ্জনা পালচৌধুরি জানালেন, আগেকার দিনে ব্যবসা করতে যাওয়াকে ‘টাকা–যাত্রা’ বলা হত। তখন মানুষজন ব্যবসার কাজে দু–তিন মাসের জন্য বাইরে যেতেন। তখনকার দিনে বাড়িতে থাকা স্বর্ণমুদ্রা মা দুর্গার পায়ে ছুঁয়ে বাড়িতে রাখা থাকত। সেই মুদ্রায় প্রণাম করে ব্যবসার কাজে যেতেন তাঁরা। পালচৌধুরি পরিবারে এখনও চলে আসছে সেই ‘টাকা–যাত্রা’–র রীতি। মায়ের পায়ে ছোঁয়ানো হয় সোনা, রূপো বা অন্য ধাতুর মুদ্রা। দশমীর দিন দর্পণ বিসর্জনের পর হয় এই ‘টাকা–যাত্রা’।

পুরোহিত তাপসবাবু জানালেন, দশমীর দিন নিয়ম মেনে দর্পন বিসর্জন এবং পঞ্জিকার সময় অনুযায়ী হয় ঠাকুর বিসর্জন। বিসর্জনের পর সিঁদুর খেলা এবং তারপর সন্ধ্যায় শান্তি আশীর্বাদ। নবমীতে হোমের তিলক এই শান্তি আর্শীবাদেই দেওয়া হয়। মূলঘট বিসর্জন দেওয়া হয় না। সেই ঘটেই হয় লক্ষ্মীপুজো। লক্ষ্মীপুজোর সরায় আঁকা থাকে দুর্গার চালচ্চিত্র।
এক কথায় বলতে গেলে ভোজেশ্বর পালচৌধুরি পরিবারের পুজোয় যেমন আছে আড়ম্বর, তেমনই আছে নিষ্ঠা। 

বিশেষ কৃতজ্ঞতা:‌ শৈবাল দাস

ছবি: শৈবাল দাস, সৌরদীপ্ত দাস‌ ও পালচৌধুরি পরিবারে সৌজন্যে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *