এই শহরকে কী নামে ডাকব?‌ কল্প নগরী না বানিজ্য নগরী,‌ নাকি স্বর্ণ নগরী?‌ স্বপ্ন নগরী বললেও কি খুব একটা ভুল হবে?‌ জানা নেই। তবে এ নগরীর গুপ্তধন যে বিশাল মরুরাশির বালি খাঁজে লুকনো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষ চাইলে কী না পারে!‌ নইলে বিভীষিকাময় মরু কখনও স্বর্গোদ্যান হতে পারে কি!‌ ঐশ্বরীয় যাদুবলে নয়, বা আলাউদ্দীনের জিনের কারসাজিও নয়, এ শহর ভোল পাল্টেছে মানুষের ছোঁয়াতেই। যে তপ্ত শহরের বুক চিঁড়লে জল নয়, মেলে তেল;‌ সে শহর কখনও পর্যটনের সেরা আকর্ষণ হয়?‌ হয় বৈকি!‌ তাই তো আরব্য রজনীর পাতায় পাতায় মধ্য–প্রাচ্যের এ বন্দর–শহরে ভাগ্য ফেরাতে নোঙর ফেলত সওদাগরেরা। তারপর স্বপ্ন সত্যি করেও ফিরে যেতে পারত না এ মায়ানগরী ছেড়ে। এমনই অদ্ভুত আকাশছোঁয়া ইমারত, প্রাণ–প্রাচুর্য আর অভিনবত্বের শহর পারস্য উপসাগরের তীরে সংযুক্ত আরব আমিরশাহির ‘‌দুবাই’…



 

দেখার মতো

অবাক করা অট্টালিকা
আপনি হয়তো বলবেন, পয়সা খরচ করে দুবাইয়ের মতো কংক্রিটের জঞ্জালে যাব?‌ আমি কিন্তু জোরের সঙ্গে বলব, হ্যাঁ যাবেন। নইলে আমাদের স্বজাতি মানুষও যে এত সৃষ্টিশীল হতে পারে, তা জানবেন কী করে!‌ একবার বিশ্বের সর্বোচ্চ সাত তারা হোটেল ‘‌দুবাই টাওয়ার’‌ বা ‘‌বুর্জ খলিফা’‌য় এসে তো দেখুন। শুধু কী হোটেল?‌ রয়েছে মসজিদ, সঙ্গে আবার নাইট ক্লাবও। একই স্থানে এমন সহাবস্থান আগে দেখেছেন?‌ অফিসিয়াল কাজকর্মও হয় এখানে। রকেটের মতো দেখতে এই ইমারতে রয়েছে প্রায় ২০০ তলা। উচ্চতা প্রায় ২,৭১৭ ফুট। গোটা শহরের দুর্দান্ত প্যানোরমিক ভিউ মেলে এখান থেকে। এই টাওয়ার এতটাই উঁচু যে একই বিল্ডিংয়ে থাকলেও এক এক তলা থেকে আলাদা আলাদা সময়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। দুবাইয়ের গগনচুম্বী উঁচু উঁচু ইমারতের মাথায় রয়েছে বিশালাকৃতির ফুটবল বা টেনিস গ্রাউন্ড। সব মিলিয়ে অভিনবত্ব এখানের পরতে পরতে। এ ছাড়াও রয়েছে আরবের পুরনো পালতোলা জাহাজের অনুকরণে বানানো ২২ ক্যারেট সোনায় মোড়া বিশ্বের চতুর্থ সুউচ্চ হোটেল ‘‌বুর্জ আল আরব’, যা‌ দুবাইয়ের অতীত ঐতিহ্য বহন করে। দেখতে ভুলবেন না প্রাচীণ দুবাইয়ের স্বাক্ষ্য বহনকারী দুবাই ক্রিক।



 

বিষ্ময় বাগান
এ যেন প্রকৃত অর্থেই মরুর বুকে ফুল ফোটানো। নইলে এমন জায়গায় দিগন্তবিস্তৃত এমন প্রাকৃতিক ফুল বন!‌ দুবাইয়ের দুবাইল্যান্ড জেলায় প্রায় ৭২,০০০ বর্গকিমি জায়গা জুড়ে এই মিরাক্যাল গার্ডেন। কুঁড়েঘর থেকে প্রাসাদ, এ বাগিচায় সবই ফুলের তৈরি। বাঘ, ভাল্লুক, ময়ূরের দেখাও পাবেন;‌ তবে তারা কেউ আপনাকে দেখে ঝাঁপিয়ে পড়বে না। কারণ ওরা সবই লতা, পাতা, ফুলের তৈরি। কৃত্রিম নয়, একবারে টাটকা। যা না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবেন না। তাইতো গিনেজ বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে স্বাক্ষর রয়েছে এই বিষ্ময় বাগানের। প্রিয়জনের জন্মদিন বা বিশেষ কোনও দিনপালনের জন্য এ জায়গা একেবারে আদর্শ।

বালুকা বাহার
চারদিকে বালির ঢেউ। রোমাঞ্চের অমোঘ টানে এই টেউয়ে অনেকে ডেজার্ট সাফারির স্বাদ নিতে আসেন। অনেকটা অনলাইন গেম পাবজির মিরামার ম্যাপের মতো। এখানেও গোল্ডেন মিরাডোর মতো চোখে পড়তেই পারে সোনার গাড়ি। ধু–ধু মরুপ্রান্তরের বুক চিঁড়ে চলে গেছে ঝাঁ চকচকে রাস্তা। আর সেই রাস্তার ওপর দাপিয়ে বেড়ায় রেঞ্জরোভার, রোলস রয়েস, ল্যাম্বরগিনি, ফেরারির মতো সুপারকার। পকেটে রেস্তো থাকলে আপনিও চাপতে পারেন এইসব সুপারকারে। আর উটের পিঠ তো রয়েছেই। দুবাই সফরে এসে নিজেকে আরব বেদুইন ভাবতে দোষ কী?‌



 

দুর্দান্ত দ্বীপ
মরুভূমিতে দ্বীপ, তাও আবার মানুষেরই তৈরি। আকারও অভিনব। দেখতে একেবারে তালপাতার মতো। দুবাইয়ের ‘‌পাম জুমেইরাহ’‌ নামের এই দ্বীপটিকে অনেকেই তাই পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বলে থাকেন। ৫২০ কিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই দ্বীপে রয়েছে প্রায় হাজার পাঁচেক বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট। বিচ, মারিনা, রেস্তোরাঁ ও বাহারি দোকানপাট সারি দিয়ে রয়েছে এই দুর্দান্ত দ্বীপে। এই দ্বীপের শীর্ষে রয়েছে নীল জলরাশির ওপর দাঁড়িয়ে ‘‌আটলান্টিস দ্য পাম’ নামক ‌অ্যাকোয়া থিমড এক দেখার মতো রিসর্ট। বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দু এই রিসর্টে রয়েছে নানা ধরনের ওয়াটার রাইড ও প্রাইভেট বিচ। রয়েছে ছোটদের পছন্দের অ্যাকোয়াভেঞ্চার পার্ক ও ডলফিন বে। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের মিঠে আলোয় করে নিতেই পারেন স্কুবা ডাইভিং, জেট স্কি বা স্নরকেলিং। জুমেইরাহ মসজিদটিও ঘুরে দেখে নিতে ভুলবেন না।

সোনার সম্ভার
দুবাইয়ের সোনার বাজারে এসে আপনার মনে হতেই পারে আপনি সোনার খনিতে ঢুকে পড়েছেন। এখানে এটিএম বুথ থেকেও বেরোয় সোনার বিস্কুট। সোনায় মোড়া গাড়ি, মোবাইল, বাড়ি বা মানুষ তো দেখতে পাবেনই, সঙ্গে নিয়েও যেতে পারেন এই স্বর্ণখনির একটু সোনা। এমনিতেই সস্তায় সোনার জন্য দুবাইয়ের নাম জগৎজোড়া। তা ছাড়া দু’‌নম্বরি ঠেকাতে সোনার গুণগত মানের ওপর সবসময়ই সরকারের কড়া দৃষ্টি থাকে, তাই নিশ্চিন্তে কিনতে পারেন। তবে আপনাকে দর কষাকষিতে কিন্তু পারদর্শী হতে হবে। নইলে কোনও লাভ হবে না।



 

মলের করিশ্মা
দ্যা শপার্স প্যারাডাইস ‘‌দুবাই মল’‌ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ শপিংমল। প্রায় ১২০০ আউটলেট রয়েছে মল অন্দরে। সামগ্রী সম্ভার তো রয়েছেই, সঙ্গে রয়েছে মলের ভিতর সামুদ্রিক প্রাণীর হাতছানি। সেখানে হয়তো আপনার ঠিক পাশ দিয়েই ঘুরে চলে যেতে পারে সামুদ্রিক তিমি, স্যান্ড টাইগার সার্ক বা স্টিংগ্রেস। আজ্ঞে হ্যাঁ। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ দুবাই অ্যাকোরিয়াম এই মলের ভেতরেই। প্রায় ১০ মিলিয়ন জলে আছে এই কৃত্রিম অ্যাকোরিয়ামে। রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম ক্যান্ডিশপ ‘‌ক্যান্ডিলিসিয়াস’‌ও। মল অফ এমিরেটস্ও নজরকাড়া। ৫২ ডিগ্রি গড় তাপমানেও শীতপোশাক পরে স্কিয়িং করা যায় এই মলের ২২,৫৫০ স্কোয়ার মিটারের বরফাবৃত ইনডোর স্কি এরিয়ায়। রয়েছে অ্যাডভেঞ্চারাস সব রাইডের সুবিধাও।

বন্যপশুরাই পোষ্য
দুবাইয়ের মানুষের বোধ হয় ঝুঁকি নেওয়া ভীষণ প্রিয় অভ্যাস। তাই তারা পোষ মানায় একেবারে বন্য জন্তুদের। যাদের পোষ মানানো সাধারণের কম্ম নয়। আমরা পোষ্য বলতে বুঝি গরু, ছাগল, মোষ, ভেড়া, কুকুর বা পাখিদের। কিন্তু দুবাইয়ের অভিজাতরা পোষ্য বানিয়ে ঘরে রাখে বাঘ, নেকড়ে, সিংহ, চিতা বা অজগরের মতো সাঙ্ঘাতিক বন্যপ্রাণকে



 

মহা মিলনমেলা
দুবাই নানা জাতি, নানা সংস্কৃতির মিলন ক্ষেত্র। এখানে প্রায় ২০০–র বেশি জাতীয়তার মানুষ একইসঙ্গে বাস করে। বলা যায়, দুবাইয়ের অধিবাসীদের ৯০% মানুষই দুবাইয়ের বাইরে থেকে আগত। দক্ষিণ এশিয়া, পাকিস্তান এমনকি এ দেশ থেকে প্রচুর মানুষ জীবিকার সন্ধানে গিয়ে দুবাইয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে। তাই দুবাইয়ের বহু সংস্কৃতির মিলনমেলায় গিয়ে স্বজাতি বাঙালির দেখা পাবেনই।

রুটম্যাপ
কলকাতা থেকে সরাসরি মাত্র ৫ ঘণ্টার উড়ানে দুবাই যাওয়া যায় এমিরেটস্ এয়ারলাইন, এয়ার ইন্ডিয়া, জেট এয়ারওয়েজ, স্পাইস জেটের বিমানে। দুবাইয়ে রয়েছে সাধ ও সাধ্যমতো নানান হোটেল। পছন্দসই বেছে নিলেই হল। ‌‌

সব ছবি:‌ জয় দাশগুপ্ত


 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *