সচেতনতা আর বিজ্ঞানমনস্কতায় ভর করেই
আমরা হারাব হেপাটাইটিসকে
ডাঃ কিংশুক দাস
অধ্যাপক ও বিশিষ্ট ক্লিনিক্যাল টিউটর, এএইচআরএফ;
সিনিয়র গ্যাস্ট্রো–এন্টেরোলজিস্ট; হেপাটোলজিস্ট ও ইন্টারভেনশনাল এন্ডোস্কোপিস্ট
অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশালিটি হসপিটাল, কলকাতা
আজ ২৮ জুলাই, ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস ডে। এই দিনই হেপাটাইটিস ‘বি’–এর আবিষ্কর্তা ও নোবেলজয়ী চিকিৎসক–বিজ্ঞানী ডাঃ ব্লুমবার্গ–এর জন্মদিন। ১৯৬৫ সালে তিনি এক অস্ট্রেলীয় উপজাতির মধ্যে হেপাটাইটিস ‘বি’–এর জীবাণুকে খুঁজে পান। তাই এর আরেক নাম ‘অস্ট্রেলিয়া অ্যান্টিজেন’। দিনটি পালনের উদ্দেশ্য এই অসুখ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো এবং নিজেদের বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলে দ্রুত রোগ নির্ণয়, দ্রুত চিকিৎসা এবং রোগটা যাতে একজনের থেকে আরেকজনের মধ্যে না ছড়ায় তার চেষ্টা করা। ২০১৭ সালে থিম ছিল ‘এলিমিনেট হেপাটাইটিস’ (নো হেপ) অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে ভাইরাল হেপাটাইটিস দূর করার শপথ। গত বছরের থিম— ‘হেপাটাইটিস ফ্রি ফিউচার’, আর এবারের থিম— ‘হেপাটাইটিস ক্যান নট ওয়েট’
হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’ কতটা মারণ ব্যাধি?
এগুলো লিভারের দীর্ঘস্থায়ী অসুখ। এর থেকে সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। এগুলো হতে সাধারণত ২০–৩০ বছর সময় লাগে। তবে হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং ‘ই’ ক্ষণস্থায়ী এবং খুব একটা শারীরিক ক্ষতি করে না। সারা বিশ্বে ২ বিলিয়ান মানুষ কোনও না কোনও সময় হেপাটাইটি ‘বি’–র শিকার হয়েছেন। এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে প্রতি বছর ১.১ মিলিয়ান মানুষের মৃত্যুর কারণ হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’। প্রতিবছর ৩ মিলিয়ান মানুষ নতুন করে এই রোগের শিকার হচ্ছেন। প্রতি ৩০ সেকেন্ডে বিশ্বে ১ জন মারা যাচ্ছেন হেপাটাইটিস ‘বি’–তে। ভারতে ১০০ জনের মধ্যে প্রায় ৪ জন হেপাটাইটিস ‘বি’–তে আক্রান্ত। ৪ জনের মধ্যে ৩ জনই এ রোগের বাহক। এঁদের থেকেই ছড়ায় রোগ। এসব পরিসংখ্যান দেখে ভয় পাবেন না। কারণ ১০০ জনের হেপাটাইটিস ‘বি’ সংক্রমণ হলে ৯৫ জনের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একে শরীর থেকে দূর করতে সক্ষম। আর বাকি ৫ জনের এটি ক্রনিক অসুখ হিসেবে থেকে যায়। এঁদের মধ্যে ১ জন সিরোসিসের শিকার হতে পারেন। সেই অর্থে হেপাটাইটিস ‘বি’ মারণব্যাধি না হলেও এইচআইভি–র থেকে মারাত্মক। তাই সঠিক সময় এর ভ্যাকসিন নেওয়া আর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা খুব জরুরি। অপর দিকে, সারা বিশ্বে ৭১ মিলিয়ন মানুষের শরীরে হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসের ইনফেকশন রয়েছে। প্রায় ৫০%–র ক্ষেত্রে এটা ক্রনিক রোগ। ভারতবর্ষে যার সংখ্যা ১%। হেপাটাইটিস ‘সি’–র কোনও ভ্যাকসিন না থাকলেও একে নির্মূল করার ওষুধ এখন ভারতেও সহজলভ্য।
কীভাবে রোগ ছড়ায়?
✦ জল ও দূষিত খাবার থেকে হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং ‘ই’–র ভাইরাস ছড়ায়। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার অভাবে মূলত এতে আক্রান্ত হতে হয়। এই বর্ষায় খাবার জলের পাইপ ও পয়ঃপ্রণালী মিশে গেলে সেখান থেকেও এর জীবাণু ছড়াতে পারে।
✦ হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’ মায়ের থেকে শিশুর শরীরে ছড়াতে পারে। মায়ের শরীরে এই ভাইরাস থাকলে শিশু জন্মের সময় এতে আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া একটি শিশুর শরীর থেকে অন্য শিশুর শরীরেও ছড়াতে পারে। যাকে বলে ইনঅ্যাপারেন্ট পেরেন্টেরাল ট্রান্সমিশন।
✦ হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ আক্রান্ত কোনও ব্যক্তির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক, হাসপাতাল, ডায়ালিসিস ইউনিট, সেলুন, ট্যাটু করানো ইত্যাদি থেকেও ছড়াতে পারে। আক্রান্তের থালা, বাসন, গয়না, জামাকাপড় থেকেও হেপাটাইটিস ‘বি’–র ভাইরাস ছড়ায়।
✦ তবে মনে রাখবেন, আক্রান্তের সঙ্গে করমর্দন, আলিঙ্গন বা প্রণাম ইত্যাদিতে রোগ ছড়ায় না।
উপসর্গ ও রোগ নির্ণয়
হেপাটাইটিস ভাইরাসের অ্যাকিউট সংক্রমণের লক্ষণগুলো হল: বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, খাওয়ায় অরুচি, শরীরে ব্যথা, হালকা জ্বর, গাঢ় হলুদ প্রস্রাব ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে, হেপাটাইটিসের রোগ হলে সবসময়ই তাতে জন্ডিস হয় না। দীর্ঘদিন এ ধরনের উপসর্গ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শে HBsAg এবং অ্যান্টি–এইচসিভি পরীক্ষা করুন। হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং ‘ই’ ভাইরাসের জন্য রক্ত পরীক্ষাও করা হয়। লিভার ফাংশন টেস্ট, আলট্রাসাউন্ড, সিটি স্ক্যান, এন্ডোস্কোপি, রক্ত জমাট বাধার পরীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে বোঝা যায় লিভারে হেপাটাইটিস বাসা বেঁধেছে কিনা।
আক্রান্ত হলে সুস্থ জীবনে ফিরবেন কীভাবে?
✦ জন্ডিস হলেই যে সবসময় শুয়ে থাকতে হবে বা সেদ্ধ খেতে হবে তা নয়। একজন সুস্থ মানুষের চেয়ে সারাদিনে দ্বিগুণ পুষ্টির প্রয়োজন জন্ডিস আক্রান্তের। সুস্থ অবস্থায় প্রতিদিন আমাদের প্রোটিনের প্রয়োজন ১ গ্রাম/কেজি (শরীরের ওজন)।
✦ জন্ডিসের প্রথম দিকে লিভার সেল ভেঙে যাওয়ায় বমি বমি ভাব আসে। এ সময় পরিমাণ মতো ভাত, ডাল, মাছ, তরকারি, ডিমের সাদা অংশ, চিকেন খেতে পারেন।
✦ জন্ডিসের সঙ্গে হলুদ ছাড়া রান্না খাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। শরীরে প্রতিদিন ৬–৮ চামচ তেলের প্রয়োজন। বাড়িতে তৈরি যে কোনও পুষ্টিকর খাবার খেতে পারেন। তবে গ্লুকোজ, আখের রস, বাতাবি লেবু বা বাজার চলতি টনিক জন্ডিস সারাতে পারে এর কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই।
✦ স্ট্রেস মুক্ত থাকুন
✦ বিছানায় শুয়ে থাকার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, তবে শারীরিক পরিশ্রম এড়িয়ে চলুন। সুস্থ হতে সাধারণত ২ সপ্তাহ থেকে ৩ মাস সময় লাগে।
প্রতিরোধ ও চিকিৎসা
✦ বাচ্চা জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই, এমনকি যে কোনও বয়সেই হেপাটাইটিস ‘বি’–এর ভ্যাকসিন নেওয়া যায়। যাঁদের একবার ক্রনিক হেপাটাইটিস ‘বি’ হয়ে গেছে তাঁদের পুরোপুরি এ রোগ নির্মূল হয় না। তবে তখন ওষুধের সাহায্যে সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায়।
✦ সচেতনতা, ভ্যাকসিন ও ওষুধের মাধ্যমে হেপাটাইটিস ‘বি’–কে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ ও কিছু ক্ষেত্রে নির্মূল করাও সম্ভব হয়েছে। এখন কলকাতাতেই হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’–এর চিকিৎসার পূর্ণ ব্যবস্থা রয়েছে। হেপাটাইটিস ‘সি’–কে নির্মূল করার কর্মযঞ্জ অনেকটাই এগিয়েছে।
লিভার ফিট তো শরীর ফিট
✦ কুসংস্কারকে দূরে সরিয়ে সচেতনতা বাড়ান
✦ পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকুন
✦ লিভারে কোনও অসুখ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চলুন
✦ টাটকা ফল, শাক সবজি খান
✦ ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
✦ ধূমপান, মদ্যপান এড়িয়ে চলুন
✦ হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘এ’ প্রতিরোধের ভ্যাকসিন নিন।
মনে রাখুন
এই অতিমারীর সময় আমাদের মাথায় রাখতে হবে যাঁদের হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ আছে, তাঁদের অবশ্যই করোনার ভ্যাকসিন নিতে হবে। কারণ হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ বা ক্রনিক লিভারের অসুখে আক্রান্ত কেউ করোনার শিকার হলে, তাঁদের লিভারে জটিল সমস্যা খুব দ্রুত দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া হেপাটাইটিস ‘বি’–এর ভ্যাকসিন দূর করে ক্যান্সারকেও। একজন হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’–এর রোগী সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করুন। চলুন, আজ থেকেই শপথ নিই— সচেতনতা আর বিজ্ঞানমনস্কতায় ভর করে আমরা হারাব হেপাটাইটিসকে।
সাক্ষাৎকার: প্রীতিময় রায়বর্মন
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments
বুৎপত্তি, উৎপত্তি, লক্ষ্মণ ও প্রতিকার বিষয়ে অসাধারণ পরামর্শ। ডাঃ বাবুকে শ্রদ্ধা জানাই।
- Probokta Shadhu
Wed, Jul 28, 2021 11:28 PM