শিখা যে কোনও কাজের আগেই বারবার হাতটা ধুয়ে নেন। যদিও এই করোনা পরিস্থিতিতে হাত বারবার ধোয়া অন্যায় কিছু নয়। তবে শিখা প্রায় মিনিট দশেক অন্তরই ধুতে থাকেন। তা সে ঘরে হোক বা বাইরে। তারপর ধরুন, মিসেস মুখার্জির কথা। তিনি বাড়ির প্রতিটা জিনিস দিনে প্রায় ২০ বার পরিষ্কার করেন, আর প্রতিবারই এই কাজের পর স্নান করতে যাওয়া মাস্ট।

শৈবাল বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে অন্তত সাত বার তালা ঠিকভাবে বন্ধ হয়েছে কি না দেখে নেন। চ্যাটার্জিবাবু যতবারই রাস্তায় কোনও মন্দির দেখতে পান অন্তত পাঁচ বার প্রণাম না করে সেই জায়গা ছাড়েন না। সুজয় ছাদে উঠতে ভয় পায়, কারণ তার ছাদে উঠলেই ঝাঁপ দেওয়ার চিন্তাটাই বারবার মাথায় আসে। পুজো করতে বসলেই নানান অশালীন চিন্তা মনোতোষের মাথায় আসে। এর জন্য তিনি প্রতিদিনই চরম পাপ বোধে ভুগছেন।


 

ওপরের যে ক’‌টি উদাহরণ দেওয়া হয়েছে তাঁদের মতো অনেককেই আমরা হয়তো চিনি। প্রথম দু’‌জনকে আমরা ‘‌শুচিবাইগ্রস্ত’‌ বলে থাকি, পরের দু’‌জনের ক্ষেত্রে বিষয়টাকে আমরা বলি ‘‌বাতিকগ্রস্ত’‌। শেষের দু’‌জনের ব্যাপারটা একটু আলাদা, এঁদের ব্যাপারে আমরা জানতে পারি না, কারণ এঁরা নিজেদের সমস্যা জনসমক্ষে আনতে ভয় পান। এঁরা কিন্তু প্রত্যেকেই একটি মানসিক রোগে ভুগছেন, চিকিৎসার পরিভাষায় যার নাম হল ‘‌অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসর্ডার’‌ বা ওসিডি।

অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারের মধ্যে দুটি শব্দ রয়েছে— অবসেশন এবং কম্পালশন। অবসেশন মানে হল কোনও অযৌক্তিক, অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবনা, আবেগ বা প্রতিচ্ছবি যা না চাইতেও বারবার মাথায় ঘুরতে থাকে। কম্পালশন হল অবসেশন থেকে সৃষ্টি হওয়া মানসিক অস্থিরতা শান্ত করার জন্য কাঙ্ক্ষিত মাত্রার ঊর্ধ্বে মানুষ যে সব আচরণ বারবার করতে থাকে।


 

অবসেশন–এর ধরন
আমরা নানারূপ অবসেশন দেখতে পাই, তার মধ্যে কয়েকটি এখানে আলোচনা করা হল:‌


১.‌ অবসেশন অফ কন্টামিনেশন: এতে রোগীর সবসময় মনে হয় তাঁর শরীরের কোনও অংশে নোংরা লেগে আছে, তাই তিনি সারাক্ষণ ধোওয়াধুয়ি করতে থাকেন। এঁদের এঁটো, থুতু, মল, মূত্রের প্রতি অতিরিক্ত ঘৃণা ও উদ্বেগ দেখা যায়। এই করোনা পরিস্থিতিতে এইসব মানুষদের উদ্বেগের শেষ নেই।

২.‌ অবসেশন অফ সিমেট্রি: যে কোনও কাজেই সামঞ্জস্য বা ভারসাম্য রাখার অদম্য ইচ্ছা। দেখা যায় এই ধরনের মানুষেরা ঘরের প্রতিটি জিনিস নিপুণভাবে সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। একটু এদিক–ওদিক হলেই এঁরা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন।

৩.‌ সেক্সুয়াল অবসেশন: এ ক্ষেত্রে সবসময় রোগীর মনে যৌনতা সম্পর্কিত চিন্তা ঘোরাফেরা করে। অনেক সময় দেখা যায় পুজো করার সময় বা নমাজ পড়ার সময় এ ধরনের চিন্তা আসায় তাঁরা অত্যন্ত বিব্রতবোধ করেন। তীব্র পাপবোধের শিকার হন।



 

৪.‌ অবসেসিভ রুমিনেশন: ‘‌রুমিনেশন’–এর আক্ষরিক অর্থ জাবর কাটা। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরে মনে একই চিন্তা আসতে থাকে। এই পাক খেতে থাকা চিন্তাকেই জাবর কাটার সঙ্গে তুলনা করা যায়।

৫.‌ অবসেসিভ ইমেজ: এমন অবস্থায় মনের মধ্যে একই প্রতিচ্ছবি অসময়ে এবং অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বারবার ভেসে ওঠে। এই ছবি হতে পারে কোনও ভয়ানক দৃশ্যের বা কোনও সিনেমার চরিত্রের মুখের।

৬.‌ অবসেসিভ ইম্পাল্‌স: হঠাৎ কিছু করে ফেলার ঝোঁক বা অদম্য ইচ্ছা যা বারবার আসতে থাকে এবং কোনও কিছুতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা যায় না। যেমন, হঠাৎ ছাদ থেকে ঝাঁপ দেওয়ার ইচ্ছে, কাউকে কিছু দিয়ে আঘাত করার ইচ্ছে, যৌন ক্রিয়াকলাপ করার ইচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রোগী নিজেকে অপরাধী ভাবেন, মানসিক অবসাদে ভোগেন এবং অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

কম্পালশন–এর ধরন: কম্পালশন সাধার‌ণত দু’‌প্রকারের।
ক) কিছু কাজ বারবার করার কম্পালশন (‌রিপিটেটিভ অ্যাকশন)‌
খ) মানসিক কম্পালশন
রিপিটেটিভ অ্যাকশন বা একই কাজ বারবার করার কম্পালশনের আবার বিভিন্ন প্রকারভেদ আছে। যেমন—
✿ পরিষ্কার এবং ধোওয়াধুয়ি করার কম্পালশন: এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির বেশ কিছু ‌স্বভাব লক্ষ করা যায়। যেমন, অশুদ্ধ, অপরিষ্কার ভেবে বারবার জামাকাপড় থেকে বাড়ির ইলেকট্রনিক জিনিস পরিষ্কার করা এবং ধোওয়া। বাড়িতে লোক এলে তাদের ঘরের বাইরে জুতো–‌‌জামা খুলে স্নান করতে বলা।
✿ স্নান: এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেকে অপরিষ্কার ভাবেন, তাই বারবার স্নান করেন। স্নানঘরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটান। আবার স্নান করে বেরোলে যদি কেউ ছুঁয়ে দেয় বা ছিটেফোঁটা নোংরা লেগেছে বলে সন্দেহ হয় তা হলে আবার স্নান করেন।
✿ পরীক্ষা করা: এমন অবস্থায় ব্যক্তি কোনও একটি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনের চেয়ে মাত্রাধিকবার পরীক্ষা করেন। যেমন, ঘর থেকে বেরোনোর আগে বারবার পরীক্ষা করে নেন তালা দেওয়া হয়েছে কি না, গ্যাস সিলিন্ডার বন্ধ হয়েছে কি না ইত্যাদি।
✿ সিমেট্রি: সমানভাবে সামঞ্জস্য মেনে দীর্ঘ সময় নিয়ে জিনিসপত্র সাজানোর বাতিক থাকে এ ক্ষেত্রে। কোনও কারণে সামঞ্জস্য বিঘ্নিত হলে ব্যক্তি ভীষণই বিব্রত হয়ে পড়েন।
✿‌ রিচুয়াল: কোনও কাজ যুক্তিহীন নিয়মে করে যদি ভুল হয় তবে পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন।
মানসিক কম্পালশনেও বেশ কয়েকটি সাধারণ অভ্যাস লক্ষ করা যায়। যেমন,
অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় ভাবে একই জিনিস বারবার গোনা, কিছু কথা মনে মনে বারবার পুনরাবৃত্তি করা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে প্রার্থনা করা বা বারবার করে ঠাকুর–দেবতাকে প্রণাম করা ইত্যাদি।

মানসিক অবসাদ
যে কোনও বয়সের মানুষই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের এই অসুখের প্রবণতা একটু বেশি দেখা যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে এই রোগ নির্ধারণ করা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেশ কঠিন হয়। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অনেক সময় বুঝতে পারেন না যে, এটাও একটা রোগ এবং এই রোগেরও চিকিৎসার দরকার। তাঁরা ভাবেন তাঁরা যা করছেন ঠিক করছেন। অনেক সময় তাঁদের বাড়ির লোকেরা ভাবেন এঁরা এ সমস্ত কিছুই ইচ্ছে করে করছেন। আবার যাঁরা বুঝতে পারেন তাঁরা ধীরে ধীরে মানসিক অবসাদের শিকার হয়ে পড়েন।

চিকিৎসা
✤ ওষুধ দ্বারা চিকিৎসা: শুধু ওষুধের দ্বারা এই রোগ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব‌। এ ক্ষেত্রে সিলেক্টিভ সেরোটোনিন রিআপটেক ইনহিবিটর বা ট্রাইসাইক্লিক অ্যান্টি–‌‌ডিপ্রেসেন্ট গ্রুপের ওষুধ ব্যবহার করা হয়। দেখা গেছে যে, মস্তিষ্কে সেরোটোনিন নামক এক নিউরোট্রান্সমিটারের ঘাটতি এ রোগের লক্ষণগুলোকে প্রকট করে তোলে। ওষুধ দ্বারা এই সেরোটোনিন বাড়িয়ে লক্ষণ কমিয়ে ফেলা যায়। এই ওষুধে কাজ হতে সময় লাগে প্রায় ১ থেকে ৩ মাস।
✤ বিহেভিয়ারথেরাপি: এক্সপোজার এবং রিঅ্যাকশন প্রিভেনশনথেরাপি ওসিডি নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কার্যকরী। লার্নিং থিওরি অনুযায়ী ওসিডি একটি ম্যালঅ্যাডাপ্টিভ লার্নিং বা বিকৃত শিক্ষা, যা ডি–‌‌লার্নিং এবং অ্যাডাপ্টিভ লার্নিংয়ের মাধ্যমে ঠিক করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে রোগীকে প্রথমে কিছু রিলাক্সেশন টেকনিক শেখানো হয়। তারপর ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে তাঁকে উদ্বেগকারী জিনিসগুলোর সম্মুখীন করা হয় এবং তাঁর কম্পালশন কন্ট্রোল করতে শেখানো হয়।
✤ কগনিটিভথেরাপি: এখানে রোগীকে নিজের চিন্তার ব্যাপারে অবগত করানো হয় এবং নানারকম ডিস্ট্রাকশন টেকনিক শেখানো হয়, যা তার মেন্টাল কম্পালশন কন্ট্রোল করতে সাহায্য করে।
✤ ফ্যামিলিথেরাপি: ওসিডি–র চিকিৎসায় পরিবারের ভূমিকা অনেক। যেহেতু পরিবারের অনেকেই এই রোগ সম্পর্কে অবগত থাকেন না, ফলত তাঁরা ভাবেন রোগী ইচ্ছাকৃতভাবে বা স্বভাবজনিত কারণে এ সব করছে। তাই ওসিডি–তে আক্রান্ত মানুষেরা পরিবারের লোকের কাছে অনেক সময় লাঞ্ছিত, নিপীড়িত হন। ফ্যামিলিথেরাপিতে পরিবারের মানুষের এই ভুল ভাঙানো হয়, রোগ সম্পর্কে অবগত করানো হয় এবং রোগদমনে পরিবারের সাহায্য নেওয়া হয়।

শেষে
অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত মানুষদের ওষুধ ও থেরাপির মাধ্যমে সম্পূর্ণ রূপে সুস্থ করা সম্ভব। তবুও আমাদের সমাজের অনেক মানুষ আজও এর চিকিৎসায় বিমুখ ও সন্দিগ্ধ। ওসিডি সম্পর্কে অবগত হন অন্যদের অবগত করান। প্রয়োজনে সাহায্য নিন মনোরোগ চিকিৎসকের।
(‌মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)‌

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *