রহস্যময়ী প্রকৃতির
এক অপরূপ সৃষ্টি

কমলা আদক   

উত্তর আমেরিকার ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক— বিশ্বের সর্বপ্রথম ন্যাশনাল পার্ক। ১৮৭২ সালে উন্মোচিত হয়।  উত্তর আমেরিকার তিনটি রাজ্য ওয়াইয়োমিং (Wyoming), ইদাহো (Idaho) ও মন্টানা (Montana) (95:2:3) জুড়ে এটি। বিশাল এই ন্যাশনাল পার্কটির রোড ওয়ে ২৮০ মাইল, আছে নানা প্রাকৃতিক বিস্ময়। কী না নেই এখানে— বরফে ঢাকা পাহাড়ের পর পাহাড়, বিস্তীর্ণ পাইন বন, বড় বড় লেক, আপার ও লোয়ার ফলস, কালো ভাল্লুক, বিভিন্ন প্রজাতির বড় বড় হরিণ, হাজার হাজার বাইসনের আনাগোনা, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ইত্যাদি। সবচেয়ে বেশি মন আকর্ষণীয় এখানকার গিজার বেসিনগুলি। এখানেই পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি গিজার (বৃহৎ ও উচ্চ) আছে। গিজার ও অন্য ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য সব মিলিয়ে এই বেসিন। সালফার সমন্বিত মাটিযুক্ত গরম জল, জলীয় বাষ্পের ধোঁয়া, গ্যাসীয় বুদবুদযুক্ত কাদা ও Primitive life (Algae, bacteria, archaea) এই পার্কের ভলকানিক নিদর্শন।

ভূতত্ত্ববিদদের মতে অতীতে ২.১ মিলিয়ন বছর আগে থেকে আজ পর্যন্ত এখানে তিন তিনবার বড় বড় অগ্ন্যুৎপাত হয়েছে। আগ্নেয়গিরি আজও জীবন্ত। গাছপালা, রাস্তা, পাহাড়, বেসিন সব কিছু নিয়েই ইয়েলোস্টোনের ল্যান্ডস্কেপ তথা Yellowstone Caldera। অগ্ন্যুৎপাতের সময় প্রচুর তেজস্ক্রিয় পদার্থ উদ্গীরিত হয়েছিল এবং তার সঙ্গে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ও হয়েছে। মাটির তিন থেকে আট মাইল নিচে রয়েছে পাথর গলা ম্যাগমা স্তর । গিজার বেসিনের হাইড্রোথার্মাল ফিচার তৈরির প্রাথমিক উপাদান হল এই ম্যাগমার তাপ সৃষ্টির ক্ষমতা। উপরিতলে রয়েছে অনেক পাহাড়। শীতের ঠান্ডায় সেখানে জমে বরফ। বৃষ্টি হয় প্রচুর। বরফ গলা জল, বর্ষার বৃষ্টির জল মাটি, বালির স্তর চুঁইেয় মাটির ভিতরে পাথরের স্তরের ওপরে জমা হয়। এই জলই হলো দ্বিতীয় উপাদান। ম্যাগমার উত্তাপে জল গরম হয়। চারশো ডিগ্রি সেন্টগ্রেড বা তার বেশি তাপমাত্রা ছাড়িয়ে যায়। পৃথিবীর অভ্যন্তরের চাপে অতিতপ্ত জল তরল অবস্থায় থাকতে বাধ্য হয়। ওপরে ঠান্ডা জলের নিম্নমুখী চাপ ও অন্যান্য চাপে পাথর স্তরে ফাটল দেখা

যায়। এদের বলা হয় Natural Plumbing system। যখন গরম জল ধীরে ধীরে প্লাম্বিং সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে উপরিতলে আসে তখন হট স্প্রিং এর সৃষ্টি হয়। প্লাম্বিং সিস্টেমের আঁকাবাঁকা সরু পথে (স্ট্রিকচার) বাধা সৃষ্টি হয়। তখন গরম জল সহজে উপরিতলে প্রবাহিত হতে পারে না। উপরিতলের তাপমাত্রা ৯৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। নিচের জলের চাপ ও বেশি। বুদবুদ হয় কিন্তু নিচের জলকে ফুটতে দেয় না। ক্রিটিক্যাল পয়েন্টে জমা বুদবুদ প্রবল–আকার ধারণ করে যা মুহূর্তের মধ্যে প্রচুর জলীয় বাষ্প সৃষ্টি করে এবং একই সময়ে প্রচুর জল নির্গত হতে সাহায্য করে। এটা চলে যতক্ষণ প্লাম্বিং সিস্টেমের জমা সমস্ত বুদবুদ যুক্ত জল শেষ না হয়। তাই ফোয়ারার আকারের গিজার দেখা যায়। শঙ্কু আকৃতি যুক্ত গিজারে জেট আকারের জল নির্গত হয়।

ইয়েলোস্টোন–এর উত্তপ্ত উপরিতলের প্রায় অর্ধেক এলাকা জুড়ে ছোট ছোট ফাঁকা জায়গা যেন আগ্নেয়গিরির মুখ। সে পথ দিয়ে সব সময় ধোঁয়া বেরিয়ে চলেছে। এগুলি আসলে জলীয়বাষ্প। এখানকার ম্যাগমার উপর স্তরে আছে খুব কম জল। তাই এই জল উপরিতলে আসার আগেই বাষ্পীভূত হয়ে ধোঁয়ার আকার নেয়। এ গুলিকে Fumarole  বলে। সালফার অধ্যুষিত এলাকায় হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস নির্গত হয়। থার্মোফাইল (হিট লাভিং) মাইক্রোঅরগানিজম হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাসকে সালফিউরিক এসিডে পরিণত করে যা পাথরকে কাদায় পরিণত করে। বিভিন্ন গ্যাস মিশ্রিত উপরিতলের

মুখগুলিতে কাদার বুদবুদ দেখা যায়। এগুলি হল মাডপট। যখন হট স্প্রিং লাইম স্টোন এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় তখন উপরিতলে টেরাসের সৃষ্টি হয়। এই অবস্থাকে ট্রাভার লাইন বলে। ইয়েলোস্টোনের ভলকানিক জিওলজি সৃষ্টি করেছে নানা রকমের গিজার। প্রত্যেকের সৃষ্টি, চেহারা ও বৈশিষ্ট্যের স্বাতন্ত্র্য আছে। একটি অপরটি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক, প্রতিটি পরিবর্তনশীল। এই স্বাতন্ত্র্য ও পরিবর্তন করে তুলেছে ইয়েলোস্টোনকে আরো বিস্ময়কর।

ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কে পাঁচটি প্রবেশদ্বার আছে। দক্ষিণ দিকের প্রবেশ দ্বার দিয়ে ঢুকে আমরা প্রথমে আপার গিজার বেসিনের দিকে অগ্রসর হলাম। এটি সর্বাপেক্ষা পরিচিত গিজার বেসিন। দেখি মাটির উপর যেন একটি বিশাল আকার উনুন। তার মুখ দিয়ে অনবরত ধোঁয়া নির্গত হয়ে পার্শ্ববর্তী গাছের উপর দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। এটি হচ্ছে পৃথিবী বিখ্যাত ওল্ড ফেইথফুল গিজার  (যদিও সর্বোচ্চ বা অতি নিয়মিত নয়)। এখানে ঘনঘন উদগীরণ হয় প্রায় ৯০ মিনিট অন্তর, ফোয়ারার উচ্চতা হয় ১০৬ থেকে ১৮৪ ফুট, স্থায়িত্ব দেড় থেকে পাঁচ মিনিট, প্রতিবারে ৩,৭০০ থেকে ৮,৪০০ গ্যালন জল ছাড়ে।

১০০ বছর ধরে এই প্রক্ষেপণ অনবরত হয়ে চলেছে। এটি শান্ত ও নিস্তব্ধ। এই গিজার বেসিনে আরও ১৩০টি গিজার ও রংবেরঙের হট স্প্রিং আছে। ওল্ড ফেইথফুল ছাড়া আরও মাত্র পাঁচটি গিজারের  প্রক্ষেপণের সময় আগে নির্ধারণ করা যায়। উল্লেখযোগ্য গিজার গুলি হল— বিহাইভ (অনিয়মিত), লায়ন গ্রুপ (সিংহের মত গর্জন), জায়ান্টেস (বছরে দুই থেকে ছয় বার উদগীরণ, ভূমি কাঁপিয়ে দুশো ফুট ফোয়ারা ওঠে), ক্যাস্টেল (হাজার হাজার বছরের পুরানো, সিলিকা সিন্টার যুক্ত, গ্র‌্যান্ড (বিস্ফোরণসহ ফাউন্টেন হয়), অ্যানেমোনা (কখনও একদম ফাঁকা, কখনও ঘড়ঘড় শব্দে উদগীরণ)‌— প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য আলাদা। পাশেই ব্ল্যাক স্যান্ড বেসিন ও বিস্কুট বেসিন।

বাইসন ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীরা শীতকালে এখানে উত্তাপ নিতে আসে। গিজার বেসিন অনেক সময়ে অ্যালগি, ব্যাকটিরিয়া, আরচিয়া প্রভৃতি থার্মোফাইলের জন্য নানা রঙে সজ্জিত থাকে। ১৯৬৬ সালে Dr Thomas Brock Thermus aquaticus bacterium থেকে এনজাইম নির্যাস বার করেন যা থেকে DNA finger printing (a powerful tool widely used in criminal and medicinal research) করার সুবিধা হয়েছে। অন্যান্য থার্মোফাইল থেকে উৎপন্ন এনজাইমগুলি নানা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কাজে লাগার সম্ভাবনা প্রচুর। ওল্ড ফেইথফুলের উদ্গীরণের প্রক্ষেপণের নির্ধারিত সময় ছিল বিকাল ৭:‌৪১মি। হাতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় তাই হাইকিং ট্রেইল ধরে ঘুরছিলাম।

নির্দিষ্ট সময়ে সামনের দিকে বেঞ্চে বসে অপলক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিলাম প্রকৃতির এই বিস্ময়কর কর্মকাণ্ড। এই প্রক্ষেপণ পাঁচ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। ভিডিও তুলতে ভুলিনি। পরবর্তী উৎক্ষেপণ দেখতে ইচ্ছা ছিল খুবই কিন্তু এখানেই রাত ন’টা বেজে যাবে তাহলে, রাতের আস্তানা লেক লজ (ইয়েলোস্টোন লেকের পাশে), এখান থেকে অনেকটা দূরে। তাই ফিরে আসতে হল লেকের দিকে, এখানে আছে (ওয়েস্ট থাম্ব) West Thumb Caldera, লেকের জলের নিচে আছে হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট। ১,৭৪,০০০ বছর আগে অতি বৃহৎ ইয়েলোস্টোন ক্যালডেরার মাঝে তুলনায় ছোট আর একটি ক্যালডেরা সৃষ্টি হয়।

কালক্রমে এর চতুর্দিক জলে ভরে যাওয়ায় ৮,০০০ ফুট উঁচুতে এই বিশাল ইয়েলোস্টোন লেকের জন্ম। শীতকালে লেকের জল জমে বরফে পরিণত হয়, তখনই দেখা যায় এর মাইলের পর মাইল বিস্তৃতি অর্থাৎ বিরাটত্ব কতখানি। অন্য সময়ে সকালের শান্ত লেকে মাঝে মাঝে জলের উপর বুদবুদ উঠতে দেখা যায়, কারণ জলের তলায় হাইড্রোথার্মাল ভেন্টগুলো থেকে ছোট ছোট উদ্গীরণ হয়। ১৯৯০ সাল নাগাদ আবিষ্কার হয় লেকের একদিকে দুটো বড় ভেন্ট আছে (বসন্ত ও গ্রীষ্মে জলের তলায়), বহুদিন অন্তর এখান থেকে ইরাপশন হয়। এগুলি আজও জীবন্ত। এখানে আবার কোনওদিন অগ্নুৎপাত হতে পারে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় আরও জোরাল হতে পারে— বিজ্ঞানীরা সে কথাই বলছেন। প্রতিদিন গিজারগুলি থেকেই ৩,১০০ গ্যালন গরম জল লেকের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার লেকের জলের গড় তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড (৪৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। জলের মধ্যে নানা ধরনের জলজ উদ্ভিদ ও মাছ থাকে। পেলিকান, ওটার (ভোঁদড়) আর ঈগলরা আসে খাবারের সন্ধানে।

জলের রং বৈচিত্র্যও বিভিন্ন, মাইক্রোঅর্গানিজমের প্রাদুর্ভাবে। রহস্যময়ী প্রকৃতির খাম খেয়ালিপনার কথা বলতে হলে ‘‌ফিশিং কোন’‌–এর উল্লেখ করতেই হয়। এক সময় স্থানীয় আমেরিকাবাসীরা ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে আসত এখানে। মাছ বড়শিতে আটকাবার পর জল থেকে না তুলে ফিশিং কোনের অন্যদিকে নিয়ে চলে আসত, যেখানে জলের তাপমাত্রা ৯৩ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড— মাছ ঐ তাপমাত্রায় সেদ্ধ করে ওখানেই খেয়ে ফেলত ওরা। ১৮৭০ সালে ওয়াস বার্নড এক্সপিডিশনের পর যা খুব জনপ্রিয় ও উপভোগ্য হয়ে ওঠে। একই জলাধারের এই তাপমাত্রার বৈচিত্র প্রকৃতির এক বিস্ময়কর খেলা। এ স্থানে এখন মাছ ধরা নিষিদ্ধ কিন্তু বৈচিত্র এখনও অটুট আছে।

রাতে রাইস কুকারে তৈরি ভাত ও সবজি সেদ্ধ দিয়ে অন্য রুচির ডিনার করা হল। মাঝরাতে লজ থেকে বেরিয়ে জঙ্গল ভরা নিস্তব্ধ পরিবেশ উপলব্ধি করলাম। বন্য জন্তু জানোয়ারেরা সচরাচর আসে না লোকালয়ে। নির্মল আকাশের চাঁদ ও তারা দেখে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে উঠে জ্যাম পাউরুটি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম পরদিনের অভিযানে। এখনও অনেক দেখা বাকি আছে। প্রথমে গেলাম ম্যাড ভ্যালকেনো, সালফার ও লোহা অধ্যুষিত এলাকা, H2‌S গ্যাসের পচা ডিমের গন্ধ, পাথর কাদায় পরিণত, জলীয়বাষ্প, CO2 ও অন্যান্য গ্যাস নির্গত হয়ে এক অভিনব পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

কাদার বুদবুদ যেন সিংহের ন্যায় গর্জন করছে। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলটা পাইন বনে ঢাকা পাহাড় ছিল। কালক্রমে অগ্ন্যুৎপাতের ফলে বন ধ্বংস হয়ে যায়। তৈরি হয় নানা হট স্প্রিং, কোনওটা যেন ড্রাগনের মুখ থেকে উদগিরিত হচ্ছে। পাশে রয়েছে সাওয়ার লেক যেন শান্ত সুইমিংপুল, কিন্তু এর জল ব্যাটারির এসিড–এর মত চামড়া পুড়িয়ে দিতে পারে। হট স্প্রিং (Hot spring)–এর কাদা–জল পঞ্চাশ ফুট উপর পর্যন্ত প্রক্ষিপ্ত হত। মাঝে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৯৯ সালে এক বিস্ফোরণের পর প্রকৃতি আরও জোরালভাবে কর্দমাক্ত জলের বুদবুদ ঘটিয়ে চলেছে— সত্যিই রহস্যজনক।

দ্বিতীয়বার ওল্ড ফেইথফুল–এর ফাউন্টেন দেখতে আবার হাজির হলাম আপার গিজার বেসিনে। তখন বেলা ১২টা, ওল্ড ফেইথফুল–এর প্রক্ষেপণের সময় ১:‌১৯মি। হঠাৎ আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল। লাঞ্চের খাবার সংগ্রহের বিরাট লাইন— ওই লাইনে দাঁড়াতে গিয়ে প্রায় একদম সামনে থেকেও ফাউন্টেন দেখার দ্বিতীয় সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। একটু মন খারাপ হল।
লাঞ্চ সেরে চললাম মিডওয়ে গিজার বেসিনের দিকে। এখানে আছে বিভিন্ন রঙে ভরা গ্র্যান্ড প্রিজমেটিক স্প্রিং (Prismatic spring), এখানকার মধ্যে সর্ববৃহৎ প্রায় ৩৭০ ফুট ব্যাস বিশিষ্ট বৃত্তের ন্যায়। গাঢ় নীল বর্ণের এই জলাধারের চতুর্দিকে হলুদ ও কমলা বর্ণের থারমোফাইলগুলি এক অনবদ্য দৃশ্যের (Prismatic effect) অবতারণা করেছে। হাইকিং ট্রেনে উঠলাম রেইন কোট পরে কারণ বৃষ্টি তখনও থামেনি। তবে প্রায় বৃত্তের আকার আমাদের ক্যামেরায় ধরা দিল না। নিকটবর্তী পাহাড়ে উঠে এর আসল চিত্র পাওয়া যায়। বৃষ্টি থামল এবারের গন্তব্য স্থল নরিস গিজার বেসিন (Norris geyser basin)।

একদিকে আছে Porcelain basin, অপরদিকে ব্ল্যাক বেসিন (Black basin)। হাইকিং ট্রেইল দিয়ে নিচে নেমে দেখতে হল। এটি সর্বাপেক্ষা পুরানো কিন্তু জীবন্ত, ভয়াবহ এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল। বেসিনের সর্বাপেক্ষা তাপমাত্রা ৪৫৯ ডিগ্রি ফারেনাহাইট  (প্রায় ১০০০ ফুট নিচে), এসিডিক চরিত্রের। এটি পৃথিবীর জীবন্ত আগ্নেয়গিরির একটি, অনেক হটস্প্রিং ও Fumarole আছে এখানে। নরিসে প্রতিবছর নতুন নতুন হট স্প্রিং ও গিজারের সৃষ্টি হয় আর পুরানোগুলো লুপ্ত হয়। সামান্য ভূমিকম্পে হাইড্রোথার্মাল বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয়। অনেক হট স্প্রিং ভুমি মধ্যস্থ পাথরকে দ্রবীভূত করে এবং উপরিতলে প্রচুর আকরিক স্তর সৃষ্টি করে যা জলের প্রবাহে বাধা দেয়। উচ্চ চাপযুক্ত গরম জল বের হওয়ার জন্য নূতন রাস্তা খোঁজে যেন দুধের মধ্যে নীল রং ঢালা পরিস্কার বেসিন কখনও কাদায় পূর্ণ হয়ে টগবগ করে ফুটতে শুরু করে। বেসিনের পাশের উপরিতল কঠিন হলেও তা যথেষ্টই ফাঁপা।

এরই ভিতরে আছে বিভিন্ন ধরণের গরম জলের রিজার্ভার। প্রত্যেকটির বৈশিষ্ট আলাদা, জলে মিশ্রিত ক্লোরাইড, সালফেট, আয়রন, আর্সেনিক, সিলিকন প্রভৃতি রাসায়নিক পদার্থ আর জলের পিএইচ–এর উপর নির্ভরশীল। কম তাপমাত্রার সবুজ ও কালো এলজি উপরিতলে যেন কার্পেট বিছিয়ে রাখে— দেখতে খুবই সুন্দর। ব্যাক বেসিনে আছে স্টিম্ বোট গিজার যা পৃথিবীর সর্বোচ্চ ও জীবন্ত, যার ফোয়ারা ৩০০ফুট পর্যন্ত ওপরে ওঠে, তবে কোন নিয়ম মেনে চলে আজও জানা যায়নি। এর শেষ উদগীরণ হয় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে, তার আগে ২০১৩–র জুলাইয়ে। তবে প্রতিনিয়ত গরম জল উদ্গীরণ করে যাচ্ছে যা মাত্র ১০ থেকে ৪০ ফুট ওপরে উঠে। নরিস বেসিনে মাঝে মধ্যে নানা অঘটন ঘটে। গত বছর জুন মাসে ঝড়ো হাওয়ায় এক ব্যক্তি বেসিনে পড়ে যায়। উদ্ধারকারীরা উদ্ধার করতে এসে দেখে তার দেহ এসিড মিশ্রিত জলে দ্রবীভূত হয়ে গেছে।

পরের দিন সকালে আরও একটি দর্শনীয় স্থান ম্যামোথ হট স্প্রিং (Mamoth hot spring)। এটা লাইমস্টোন ও অন্যান্য সেডিমেন্টারী রক সমৃদ্ধ, যা টেরাসের মতো দেখায়। টেরাস গুলো যেন জীবন্ত স্কাল্পচার। মিনার্ভা টেরাস (রোমান দেবী স্মরণে), জুপিটার ও মাউন্ট টেরাস যেন দারুন সুন্দর ভাবে রং করা, লিবার্টি ক্যাপ ওপাল টেরাস ৩৭ ফুট উঁচু, ফরাসী বিপ্লবের স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক। খুব গরম জলে থাকে সাদা আর হলুদ বর্ণের থার্মফাইল আর ঠান্ডা জলে থাকে কমলা, সবুজ ও গাঢ় বাদামী রঙের বর্ণের থারমো ফাইল, যারা টেরাসকে নানা রঙে রাঙিয়ে তুলেছে। কিছু হট স্প্রিং অনবরত বন্ধ হচ্ছে, আবার নতুন নতুন সৃষ্টি হচ্ছে, তাই ম্যামোথ হট স্প্রিং কোন দিন শুকিয়ে যাবে না ধরে নেওয়া যায়।

সবশেষে বলব এই যে জনপদ, যাতায়াতের পথ গাড়ি পার্ক করার জায়গা, থাকার জন্য ঘরবাড়ি, খাওয়া–দাওয়ার রেস্তোরাঁ তৈরি হয়েছে তা কিন্তু প্রকৃতির খামখেয়ালিপনায় কোনও এক দিন ধুলিস্যাৎ হয়ে যেতে পারে, সে ভয় আছে এবং থাকবেই। তা সত্ত্বেও প্রকৃতি প্রেমিক ও প্রাকৃতিক রহস্য সন্ধানীদের কাছে এর আকর্ষণ দুর্দমনীয়।

রুটম্যাপ
কিভাবে যাবেন:‌ ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক উত্তর আমেরিকায় অবস্থিত। বিশাল এর বিস্তৃতি। পার্কের খুঁটিনাটি দেখতে হলে, প্রাকৃতিক দৃশ্য গুলি উপলব্ধি করতে হলে অন্তত পাঁচ সাত দিন সময় লাগে। নিকটবর্তী এয়ারপোর্ট বোজম্যান। এখান থেকে দেড় ঘণ্টার কারড্রাইভ। অপর একটি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ডেনভার থেকে ১০ ঘণ্টার কারড্রাইভিং। তাই সবার আগে ভিসা জোগাড় করতে হবে। কলকাতা থেকে দিল্লি বা মুম্বাই হয়ে উত্তর আমেরিকার যে কোনও ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে আসা যায়, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ, লুফথানসা বা কেএলএম–এর মাধ্যমে। সেখান থেকে বোজম্যান বা ডেনভারে (অথবা সরাসরি এই দুটির কোন একটি এয়ারপোর্টে)। এয়ারপোর্টে সেলফ ড্রাইভ গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়, তবে গাড়ি চালাতে হবে নিজেকেই। আমেরিকায় সর্বত্র বাজেট, এন্টারপ্রাইজ প্রভৃতি কারএজেন্সির মাধ্যমে অনলাইনে বুকিং করা যায়। প্রত্যেকটি এজেন্সির নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে। এই ন্যাশনাল পার্কর্টি অত্যন্ত জনপ্রিয়। প্রতিবছরই ৪০ লক্ষ মানুষ এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে আসে।

কোথায় থাকবেন:‌ ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কের ভিতরে ও বাইরে প্রচুর হোটেল আছে। বাইরের হোটেলের প্রতিদিন টু-বেড রুমের ভাড়া ১০০ থেকে ১৫০ ডলার এবং ফ্রি ব্রেকফাস্ট। ন্যাশনাল পার্কের ভিতরে প্রতিদিনের ভাড়া ৩০০ থেকে ৩৫০ ডলার। এখানে ফ্রি ব্রেকফাস্ট নেই, নিকটবর্তী হোটেলে খাওয়া খরচও বেশি। তবে জঙ্গল ভরা প্রাকৃতিক পরিবেশে রাত কাটানো যায়। ‘‌Stay near Yellowstone National Park’‌ লিখে সার্চ করলেই হোটেলের সন্ধান পাওয়া যাবে। ডেনভার থেকে ১০ ঘণ্টার কারড্রাইভ করে ওই দিন ন্যাশনাল পার্কে বিশেষ কিছু দেখা যাবে না। তাই প্রথম রাত ন্যাশনাল পার্কের বাইরে সস্তার হোটেলে থাকা ভালো। পরদিন সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট খেয়ে ন্যাশনাল পার্কের ভিতরে ঢুকে পাহাড়–জঙ্গল, গিজার বেসিন, বন্যপ্রাণীদের দর্শনলাভ করা যায়। হোটেলগুলো অনলাইনে বুকিং করে যাওয়া উচিত।

সব ছবি:‌ অনির্বাণ আদক‌‌

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *