তরুণ মজুমদারের সঙ্গে
সেই সব সোনালি স্মৃতি
জয়দীপ চক্রবর্তী
তরুণ মজুমদারের সঙ্গে আমার পরিচয় ২০১৭ সালে। ওই বছর সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের ইতিহাস উৎসবে আমি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ড সঙ্গীতের ৮০ বছর উপলক্ষে একটা প্রদর্শনী করেছিলাম, যাতে প্রধান অতিথি ছিলেন তরুণ মজুমদার। সেই প্রথম আলাপের পর থেকেই আমাকে মনে রেখেছিলেন হেমন্তবাবুর রিসার্চার হিসেবে। তারপর বেশ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে দেখা করেছি। কখনও স্টুডিওতে আবার কখনও কোনো লাইব্রেরিতে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে আমার অনন্ত জিজ্ঞাসার উত্তর দিতেন ধৈর্য ধরে।
তনুদার সঙ্গে শেষ ছবি
নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের চতুর্থ অ্যাসিস্ট্যান্ট শুনে সিনেমা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা করতেন। অনেক অভিনেতাকে নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ করতেন, বিশেষ করে উত্তমকুমারকে নিয়ে।
এরপর এল সেই কালান্তক অতিমারি। তনুদার সঙ্গে যোগাযোগ কমে গিয়েছিল।
কয়েকদিন আগে একজন পার্টি কমরেড খবর দিলেন— তরুণবাবু আপনার খোঁজ করছিলেন। আমাকে? ঠিক জানেন তো? বললেন— হ্যাঁ। ওই যে ছেলেটি হেমন্তবাবুকে নিয়ে রিসার্চ করছে। এক্সিবিশন করেছিল বেহালায়।
আমি ফোন করলাম। তরুণবাবু বললেন— একবার অমুক পত্রিকার লাইব্রেরিতে আসতে পারবেন আজ বিকেল ৫টায়?
আসতে পারব না মানে? সাড়ে চারটের মধ্যে পৌঁছে গিয়ে ৫টায় গেলাম তনুদার কাছে। বললেন, একটা ছোটোদের অ্যাডভেঞ্চারের ছবি করব। গল্প জানা আছে?
আমি জানতাম, তনুদা ১৯৭৫ সালে 'চাঁদের পাহাড়' ছবিটা করতে গিয়েছিলেন। প্রোডিউসার ছিলেন ‘সংসার সীমান্তে'র প্রোডিউসারই। সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হেমন্তবাবু গল্প শুনে বলেছিলেন— এতে তো আফ্রিকার স্থানীয় ভাষায় গান লাগবে। চিন্তা নেই। ইস্ট আফ্রিকায় আমার অনেক ভক্ত আছে। তাঁদের কাউকে দিয়ে গাইয়ে নেবো। কিন্তু সেই ছবি হয়নি। প্রোডিউসার মারা গিয়েছিলেন।
সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের প্রদর্শনীতে। আছেন আমার স্টুডেন্ট ‘সা রে গা মা পা’ খ্যাত স্বর্ণালী বসু, গায়ক মনোহর ঘোষাল
সেদিন তনুদাকে বলেছিলাম বিভূতিভূষণের ‘হিরে মানিক জ্বলে’ গল্পটা করতে পারেন। গল্পটা একটু শুনতে চাইলেন। শুনে দারুণ পছন্দ হল। ওখানেই দু-ঘণ্টা বসে আমরা প্রাথমিক আলোচনা করে নিলাম। তনুদা কীভাবে প্রোডিউসারের কাছ থেকে পেমেন্ট নেন সব বলে দিলেন। আমরা আর্টিস্টের ব্যাপারে, লোকেশনের ব্যাপারে অনেক আলোচনা করেছিলাম সে দিন।
বললেন, এই শরীরে অত ধকল! আপনি একটু সঙ্গে থাকবেন। কথা শেষে উঠে আসছি। বললেন, চলুন আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলি। বলে একজনকে ডেকে ছবি তুললেন। তনুদা কাউকে ইন্টারভিউ দিতেন না। সেদিন সেই আড়াই ঘণ্টার আলাপচারিতাকে কী বলব, ইন্টারভিউ? অনেক প্রশ্ন করেছি, উনি উত্তর দিয়েছেন।
আসার আগে বললেন গল্পটা সামারি করে নিয়ে আসবেন। আমি একটু ব্যস্ত আছি। এই কাজগুলো আপনি করে দিন একটু। পরের দিন আবার গেলাম। এবার আসতে আসতে স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসলেন। সামনে বসে দেখলাম কীভাবে বিভিন্ন সিন ফ্রেম করছেন। অনন্য সাধারণ অনুভূতি।
আসার সময় বললেন একটু শুটিংয়ে যাচ্ছি নর্থবেঙ্গল আর ঝাড়গ্রাম। এসে আপনার সঙ্গে আবার বসবো।
সেই আবার বসাটাই আর হল না। তনুদা যেখানেই থাকুন শান্তিতে থাকুন এই প্রার্থনা করি।
জানি না বিভূতিভূষণের ‘হিরে মানিক জ্বলে’ আর ছবি হবে কিনা।
ছবি: লেখকের সৌজন্যে
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments