‘শ্রীহীন’ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
অংশুমান চক্রবর্তী
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন চন্ডীদাস সমস্যার কথা। পদ রচয়িতাদের মধ্যে একাধিক চন্ডীদাসের উপস্থিতি রীতিমতো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিল। একই সমস্যা দেখা দিয়েছিল সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও। তিনি যখন সাহিত্যে কিছুটা খ্যাতি অর্জন করেছেন, সেই সময় প্রকাশিত হয় 'শ্রীময়ী' নামে একটি উপন্যাস। উপন্যাসটি লেখক শ্রীতারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। 'শ্রীময়ী'র রচয়িতা তারাশঙ্কর কিন্তু 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা'র তারাশঙ্কর নন। দুজন সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ। পাঠক ভুল করতে পারেন ভেবে ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’র লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় একটি পত্রিকায় নিজের ছবিসহ বিজ্ঞাপন দেন। লেখেন, ‘শ্রীময়ী’র লেখক শ্রীতারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আমি এক ব্যক্তি নই। আলাদা। উনি থাকবেন ‘শ্রীযুক্ত’, আমি ‘শ্রীহীন’।
তারপর থেকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নাম স্বাক্ষরের সময় সত্যিই শ্রীহীন থাকতেন। অর্থাৎ নামের আগে ‘শ্রী’ লিখতেন না। প্রসঙ্গত জানাই, শ্রীতারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও কিন্তু সুলেখক ছিলেন। যদিও তাঁর কথা খুব বেশি মানুষ জানেন না।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম ছিল কামন্দক এবং হাবু শর্মা। ‘হাসুলী বাঁকের উপকথা’ ছাড়াও ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘সপ্তপদী’, ‘বিপাশা’, ‘গণদেবতা’, ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘রসকলি’ তাঁর অসামান্য সৃষ্টি। ৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি ছোটোগল্প–সংকলন, ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধ–সংকলন, ৪টি স্মৃতিকথা, ২টি ভ্রমণকাহিনি, একটি কাব্যগ্রন্থ এবং একটি প্রহসন রচনা করেছেন।
কবিতা দিয়েই শুরু হয়েছিল তাঁর সাহিত্য জীবন। মাত্র ৭ বছর বয়সে। তাঁর বহু রচনা নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র। তার মধ্যে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘জলসাঘর’ ও ‘অভিযান’, অজয় কর পরিচালিত ‘সপ্তপদী’, তরুণ মজুমদারের ‘গণদেবতা’, তপন সিংহের ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উল্লেখযোগ্য।
দূরে বসে নয়, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে তিনি সাহিত্য চর্চা করছেন। তাই তাঁর লেখা এত প্রাণবন্ত। তিনি লিখেছেন বীরভূম–বর্ধমান অঞ্চলের গ্রাম্য কবিয়াল, সাঁওতাল, বাগদি, বোষ্টম, বাউরি, ডোম সম্প্রদায়ের কথা। সাধারণ মানুষগুলো তাঁর লেখনীর গুণে হয়ে উঠেছেন অসাধারণ।
জীবনে পেয়েছেন অসংখ্য পুরষ্কার। ১৯৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসের জন্য তাঁকে রবীন্দ্র পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৫৬ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার এবং ১৯৬৭ সালে ‘গণদেবতা’ উপন্যাসের জন্য জ্ঞানপীঠ পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া ১৯৬২ সালে তিনি পদ্মশ্রী এবং ১৯৬৮ সালে পদ্মভূষণ সম্মান পান। ১৯৫৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক প্রদান করে।
সু–অভিনেতা ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। জানা যায়, বহু নাটকে তিনি স্ত্রী চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য ‘সীতা’ নাটকে সীতা, ‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকে কল্যাণী ‘গৃহলক্ষ্মী’ নাটকে মেজবৌ, ‘চাঁদবিবি’ নাটকে মরিয়ম, ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ নাটকে বিনোদিনীর চরিত্রে অভিনয়। পাশাপাশি বেশকিছু নাটকে তিনি পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। যেমন ‘কর্ণার্জুন’, ‘চিরকুমার সভা’, ‘বশীকরণ’, ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ ইত্যাদি নাটক।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগদান করে গ্রেফতার হয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে। বছর দুই পর তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের সুযোগ পান। সেই বছরই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চৈতালী ঘূর্ণি’। ১৯৫২ সালে তাঁকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত করা হয়।
তাঁর নামকরণ সম্পর্কে একটি গল্প প্রচলিত আছে। জানা যায় তারাশঙ্কর যখন মাতৃগর্ভে, তার ১০ মাস আগে মারা যান তাঁর বড়দা। সেই ঘটনার পরে তাঁর পরিবার শুরু করেন তারা মায়ের আরাধনা। দশ মাস পরে জন্ম হয় এক শিশুর। নাম রাখা হয় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক। ১৮৯৮-এর ২৩ জুলাই, বীরভূমের লাভপুরে এক জমিদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা ছিলেন হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা প্রভাবতী দেবী। আজ জন্মদিনে কিংবদন্তি সাহিত্যিককে জানাই অন্তরের শ্রদ্ধা ও প্রণাম।
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments