মায়ের আঁচল
ডঃ সঞ্জীব রায়

পশ্চিম গুজরাতের এক অজ পাড়াগ্রামে বাল্যবধূ হয়ে এসেছিল সতীশের মা। বাপের ঘর ছিল তিন ক্রোশ দূরে। দেখতে শুনতে ভালোই ছিল সে। বাপ সোহাগী মেয়ে। বাপের দেওয়া নাম ‘ললিতা’। সতীশ যখন পেটে এল তখন তার বয়স সবে তেরো পেরিয়েছে। সেই থেকে কত কিছু পরিবর্তনের সাক্ষী সে। পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ললিতা হয়ে ওঠে ‘সতীশের মা’। 

এখন গ্রামে কোনো ঘর আর গরিব নেই। খাওয়াদাওয়া, পরিধানের বাস্তবিকই কোনো অভাব নেই। তবে তার পুরো কৃতিত্বই গ্রামের মহিলাদের। কারণ গ্রামের পুরুষরা রাতে বা দিনে কোনো কাজই করে না। এখানকার মহিলারা অদ্ভূত উর্বর, রত্নগর্ভা। তারা অর্থের বিনিময়ে তাদের গর্ভ ভাড়া দেয়। সেই ভাড়া কি আর যে সে ভাড়া!‌ সেই ভাড়ার দৌলতে পাড়াগ্রাম আজ শহর। প্রচুর টাকার আনাগোনা। গ্রামে সাহেব মেমরাও অহরহ আসছে যাচ্ছে। কেতা দুরস্থ হোটেল গড়ে উঠেছে। নচেৎ সাহেব মেমরা থাকবেন কোথায়?

নামীদামী ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। কত নতুন নতুন শব্দ শুনে অভ্যস্ত হচ্ছে গ্রামের ছোট মেয়েরা। কিছুকাল আগে শোনা গেছিল ‘পলিসিস্টিক ওভারি’— তার ভয়ে গ্রামের মেয়েরা খুব অল্প বয়সেই বিয়ে করে মা হয়ে যাচ্ছে। তবে এটাও সত্যি যে কাঁচা বয়সেই মা হওয়া খানিক নিয়মের বেড়াজালের জন্য। এজেন্সি জানিয়ে দিয়েছে সরকারি নিয়ম। তাতে বলা হয়েছে গর্ভ ভাড়া দিতে হলে সেই মহিলাকে অন্তত দুটি বাচ্চার মা হতে হবে। এই নিয়ম না থাকলে বিপুল অর্থের পিপাসায় বোধকরি কুমারীরাও এগিয়ে আসতো। একেকবার গর্ভ ভাড়া দিলে শুধু নগদই ৭ লাখ। তার পরে যদি সন্তান ছেলে হয় তাহলে তো জামাই আদর। কতো ইনাম!‌!‌

গর্ভস্থ বাচ্চা ছেলে না মেয়ে, যমজ কী না? সব কিছুর বিচার দেশে হয় না। উড়োজাহাজ করে নিয়ে যাওয়া হয় সুদূর সিঙ্গাপুরে। তার জন্য পাসপোর্ট আরও কত কিছু, তবে সব কিছুর দায়িত্ব এজেন্সির। সতীশের মা কয়েকবার উড়োজাহাজে চেপেছে। সত্যি কথা বলতে কী, কার ঔরসজাত সন্তান সে বহন করছে!‌ সন্তান ভূমিষ্ট হবার পরে কারা নেয়!‌ কোথায় যাচ্ছে!‌ কিছুই জানা যায় না। নাড়ী ছেঁড়া‌ ধন ভূমিষ্ট হবার পরেই অন্যের হাতে তুলে দিতে ইচ্ছে করে না। তবুও দিতে হয়। 
সতীশের মা–র তিনবার গর্ভ ভাড়া দেওয়া হয়ে গেছে। দু’বার জন্মাল ছেলে। সাহেবের রং নিয়ে, শেষবারে একমাথা কদমছাট চুল নিয়ে নিকষকালো মেয়ে জন্মাল। তবে তারাই লক্ষ্মীর ঝাঁপি ভর্তি করে রাখে। সেই ভরসাতেই সতীশের মা নিজের মেয়েদের ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছে এবং প্রথা অনুযায়ী ভালো টাকা পণও দিতে হয়েছে।

নিয়ম অনুসারে ৪০ বছর হয়ে গেলে আর গর্ভ ভাড়া দেওয়া যায় না। কদাচিৎ সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় বৈকি। সতীশের মা–র সাফল্যের পরিমাণ দেখে, উর্বরতা পরিমাপ করে চল্লিশ অতিক্রম করা সুন্দরী সতীশের মাকে ডাক্তারবাবুরা শেষবারের জন্য সুযোগ দিলেন। কিন্তু বিধির বিধান খন্ডাবে কে? সেটি না হলেই বোধকরি ভালো ছিল।
বাচ্চা জন্ম দেবার মাসখানেক আগে থেকেই যথাযথ যত্নের জন্য ক্লিনিকে রাখা হয়। সেই সময় বাচ্চা জন্ম দেবার জন্য চুক্তি মতো সমস্ত টাকাই সন্তানসম্ভবার বাড়ির লোককে দিয়ে দেওয়া হয়। বলতে দ্বিধা নেই যে ক্লিনিকে কোনো অঘটন ঘটলেও চুক্তির টাকা পেতে অসুবিধা হয় না। সেই মতন সতীশের মা–ও ভর্তি হল ক্লিনিকে। মাত্র ৪০ পার হতে না হতেই, নাতি ও নাতনির মুখ দেখা হয়ে গিয়েছে তার, না বললে তাঁকে দেখে বিশ্বাস করবে না কেউ–ই।

ক্লিনিকে ভালোই ছিল সতীশের মা। হঠাৎ একদিন মাথাটা কেমন নড়ে ওঠে। অজ্ঞান হয়ে যায় সে। বেশ কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরলে ডাক্তারবাবুরা বিধান দেন যে গর্ভস্থ বাচ্চা যুগল, অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান হবার কারণে মায়ের নিশ্বাস ও আনুষঙ্গিক কিছু অসুবিধা দেখা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সিজার করতেই হবে। তথাপি এই কাজ যথেষ্ট ঝঁকিপূর্ণ। মা বা বাচ্চার প্রাণসংশয় হবার যথেষ্ট ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।
ডাক্তারবাবুরা আরও বলেন যে সমস্যা দেখা গেলে নিয়ম অনুসারে আমরা বাচ্চার মাকেই অগ্রাধিকার দিই, তবে তার জন্য মা–র সই দরকার হয়। আশা করি এ ক্ষেত্রে তাই হবে। সতীশের মা আস্তে আস্তে বলতে শুরু করে, ‘আমি মা, হয়তো ভাড়াটে মা, তথাপি গর্ভধারিণী। কোনো মা তার সন্তান হারিয়ে বাকি জীবন সুখে থাকতে পারে না। আপনি আমার বাচ্চাদের বাঁচানোকেই অগ্রাধিকার দেবেন। আমি জানি আমার জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন কোনো সন্তানহীনা নারী। তার কোলে সন্তান দেবার জন্য আমি চুক্তিবদ্ধ। আমি আমার জীবন দিয়েও কর্তব্য করে যাবো। ব্যর্থতা নিয়ে বেঁচে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই।

আশঙ্কাই সত্যি হলো। সতীশের মা পৃথিবীকে শেষ বিদায় জানালেন। ক্লিনিক থেকে শেষ বিদায়ের সময় সমস্ত গ্রাম ভেঙে পড়েছিল। রাজরানীর বেশে বিদায় নিলো সে। সমস্ত গ্রাম মাথা নত করে কুর্নিশ করেছিল ললিতাকে। বাকরুদ্ধ হয়েছিল তারা এক গর্ভধারিণীর নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার প্রচেষ্টা দেখে।
সতীশের মা চলে যাবার মাত্র কয়েকমাসের মধ্যেই তাদের বাড়িটাই এজেন্সির লোকেরা কিনে নেয়। এক চমৎকার মিউজিয়াম প্রস্তুত হয় সেখানে। সতীশের মা–র বিভিন্ন ছবিসহ, কর্মপদ্ধতির বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত মিউজিয়ামের নামকরণ হয়েছে— ‘মায়ের আঁচল’।‌‌

সব ছবি: আন্তর্জাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *