গ্রহণকথা
রাহু, কেতু আর আইনস্টাইন
মৃদুল শ্রীমানী
সেই যে ছিল এক রাহু। সে গিলে খেত চাঁদ আর সূর্যকে। খাবে না কেন? চাঁদ আর সূর্যের জন্যই তো বিষ্ণু চালিয়ে দিল সুদর্শন চক্র! গল্পটা শুনতে এই রকম। এই গল্পের নানা রূপভেদ বিভিন্ন দেশের পুরাণকথায় রয়েছে। ড্রাগনের মুণ্ড ও লেজ দেখেছেন পুরনো মানুষেরা। মুণ্ডকে বলেছেন কাপুট ড্রাকোনিস, লেজটিকে বলেছেন কাউডা ড্রাকোনিস।
হিন্দুদের পুরাণ দারুণ রঙিন। সমুদ্র মন্থন হল। মন্দার পর্বত হল মন্থনদণ্ড আর বাসুকি নাগ হল মন্থনরজ্জু। সমুদ্র মন্থন করতে করতে উঠল উচ্চৈশ্রবা নামে তুরঙ্গম, মানে ঘোড়া। আর ঐরাবত নামে গজেন্দ্র, মানে হাতি। উঠলেন ধন্বন্তরী। উঠলেন লক্ষ্মী। আর উঠল অমৃতকলস।
দেবতা আর অসুরেরা, উভয়পক্ষ মিলে সমুদ্র মন্থন করেছিল। তাই করতে গিয়ে টানাটানির জেরে বাসুকি নাগের অবস্থা খারাপ। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল তীব্র হলাহল। বিষের প্রকোপে সৃষ্টি বিপন্ন হতে যায়। তখন শিব সেই হলাহল ধারণ করলেন কণ্ঠে, নীলকণ্ঠ হলেন, সৃষ্টি রক্ষা পেল। তো এবার দেবাসুরের যৌথ পিকনিকে অমৃত পানের পালা। কিন্তু দেবতারা ঠিক করলে অসুরদের তাদের পাওনা ভাগটুকু দেবে না। ঠিক যেমন করে মালিকেরা মজুরদের ন্যায্য মজুরি ফাঁকি দেবার কৌশল করে আর বিচার ব্যবস্থা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে।
দেবতাদের হয়ে ফাঁকিবাজি কৌশল খাটাতে দায়িত্ব নিলেন একজন প্রধান দেবতা বিষ্ণু। তিনি মোহিনী রূপ ধারণ করলে। মোহিনী মানে অপূর্ব সুন্দর নারীমূর্তি। সুন্দরী নারী দেখলে সেকালে তাঁহা তাঁহা ঋষি মুনির বীর্যস্খলন হয়ে যেত। অসুরদের আর দোষ কি? মোহিনী সেজে বিষ্ণু অসুরদের কী ঠকান ঠকালেন। কিন্তু স্বরভানু নামে এক অসুর টুক করে কীভাবে দু–ফোঁটা অমৃত ম্যানেজ করে ফেলেছিল। তবে চন্দ্র আর সূর্য তা দেখে ফেলেছিল। সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণুকে তারা সেই কথা জানালে, সুদর্শন চক্র ঘুরিয়ে স্বরভানুর গলাটা কচাৎ করে কেটে নিলেন বিষ্ণু।
স্বরভানুর দু–টুকরো দেহের মস্তকটি মরল না। ওই যে জিভে দু–ফোঁটা অমৃত ঠেকেছিল যে! মুণ্ডটার নাম হল রাহু। আর বাকি ধড়টুকু কেতু নাম পেল। এই যে রাহু, অন্যদেশে যাকে ড্রাগন মুণ্ড বলল, সে চাঁদ আর সূর্যের উপরে তার রাগ আর কমল না। সে হাঁ করে গিলতে যায় চাঁদ আর সূর্যকে। গিলেও ফেলে। তবে রাখতে পারে না। কাটা গলার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে চাঁদ আর সূর্য। এই হল গ্রহণের পৌরাণিক গল্প।
হিন্দুদের অপূর্ব কল্পনাসমৃদ্ধ পুরাণ নবগ্রহের কথা বলেছে। রবি, সোম, মঙ্গল বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি— এই সাতটি দিনের দায়িত্বে রয়েছে সাতটি গ্রহ। হিন্দুদের পুরাণ রবি বা সূর্য এবং সোম বা চাঁদকে গ্রহ বলেছে। নবগ্রহের বাকি দুটি হল রাহু ও কেতু, স্বরভানুর কর্তিত মুণ্ড ও ধড়। তবে ওদুটির বাস্তব অস্তিত্ব নেই বলে রাহু ও কেতুকে বলা হল ছায়াগ্রহ।
চাঁদ আর সূর্যকে হিন্দুদের পুরাণ গ্রহণের দুই শিকার হিসেবে দেখাল। জ্যোতির্বিজ্ঞান বলে সূর্য পৃথিবী থেকে গড়ে পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরে রয়েছে। এই দূরত্বে থেকে পৃথিবী তাকে তিনশ পঁয়ষট্টি দিনে একটি উপবৃত্তাকার পথে পরিক্রমা করছে।
চাঁদ পৃথিবীর উপগ্রহ। পৃথিবীর কেন্দ্রকে ঘিরে চাঁদ ঘুরছে এভাবে না বলে বলা ভাল, একটি ব্যারিসেন্টারকে ঘিরে উভয়ে উভয়কে পাক খাচ্ছে। এই ব্যারিসেন্টারটি অবশ্য, পৃথিবীর পেটের মধ্যেই, একেবারে কেন্দ্র তা যদিও নয়। কেন্দ্র থেকে ৪৭৬০ কিলোমিটার বা ২৯০০ মাইল বাইরে। এই দূরত্বটা পৃথিবীর পাথুরে দেহগোলকের ব্যাসার্ধের ৭৩%। ব্যারিসেন্টারের কথা থাক। পৃথিবী থেকে চাঁদের গড় দূরত্ব ৩৮৫০০০ কিলোমিটার বা ২৩৯০০০ মাইল। এই দূরত্বটা ছুটতে আলোর লাগে ১.২৮২ সেকেন্ড। ওইজন্য পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বকে ১.২৮২ আলোক সেকেন্ড বলা হয়। আলোকবর্ষের মতোই আলোক সেকেন্ড একটা দূরত্বের ধারণা।
সূর্যের চারিদিকে পৃথিবী যে উপবৃত্তাকার পথে ঘুরছে সে কথা ইতিপূর্বে বলেছি। চাঁদও পৃথিবীকে উপবৃত্তাকার পথেই ঘুরছে। যখন সবচেয়ে কাছে আসছে, তখন সে ৩৬৩২২৮.৯ কিলোমিটার বা ২২৫৭০০ মাইল দূরে। আর যখন সবচেয়ে দূরে তখন চাঁদ পৃথিবী থেকে ৪০৫৪০০ কিলোমিটার বা ২৫১৯০০ মাইল দূরত্বে থাকে। সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর যে কক্ষপথ, তার তল বা কক্ষতলটিকে বলে ইকলিপটিক। চাঁদের কক্ষপথ এই ইকলিপটিকের সঙ্গে লেপটে নেই। চাঁদের কক্ষতল ইকলিপটিকের সঙ্গে ৫.১৪৫ ডিগ্রি কৌণিক অবস্থানে রয়েছে। চাঁদের কক্ষপথ যে দুটি বিন্দুতে ইকলিপটিককে ছেদ করছে, ওই দুটিকে জ্যোিতর্বিজ্ঞানীরা বলেন লুনার নোড।
ভারতীয় জ্যোতিষ অনুসারে রাহু ও কেতু, সূর্য ও চন্দ্রের পরিক্রমণ পথে ঘুরতে থাকা দুটি বিন্দু, যে দুটি পৃথিবীর সাপেক্ষে একে অপরের ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে অবস্থিত। যেহেতু এই দুটি কোনও মহাজাগতিক বস্তু নয়, সে কারণে এদের ছায়াগ্রহ বলা হয়। পাশ্চাত্য জ্যোুতির্বিজ্ঞানে রাহু ও কেতু, এই দুই বিন্দুকে বলে উত্তর ও দক্ষিণ লুনার নোড।
রাহু ও কেতুকে ছায়াগ্রহ বলেও তাকে ভয় পেয়েছেন ধর্মভীরু লোকেরা। অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও ভয় জড়িয়ে থেকে রাহুকে ভয় পেয়ে ধর্মভীরু লোকজন বলেছেন,
অর্ধকায়ং মহাঘোরং চন্দ্রাদিত্য্বিমর্দ্দকম্
সিংহিকায়া সুতং রৌদ্রং ত্বং রাহুং প্রণম্যা মহম্।
কেতুকে ভয় পেয়ে তাঁরা বলেছেন,
পলালধূমসঙ্কাশং তারাগ্রহবিমর্দ্দকম্
রৌদ্রং রুদ্রাত্মকং ক্রূরং তং কেতুং প্রণম্যালমহম্।
ভীরু মন রাহুকে মহাঘোর রঙের বা গাঢ়নীলবর্ণের বলেছেন। দশমহাবিদ্যাার ছিন্নমস্তাকে তার দেবী স্থির করেছেন। আর ওই দশমহাবিদ্যাবর ধূমাবতীকে কেতুর অধিষ্ঠাত্রী দেবী ভেবেছেন। ছিন্নমস্তার বীজমন্ত্র খাড়া করেছেন ওঁ ছৌং ছাং ছৌং সঃ। এই মন্ত্র আঠারো হাজার বার পড়তে হবে বলেছেন।
কেতুর বীজমন্ত্র ঠিক করেছেন, ওঁ ফৌং ফাং ফৌং সঃ। এটা সতের হাজার বার পড়তে হবে।
রাহু কেতু নিয়ে হাস্যোরদ্রেককারী কুসংস্কারের অন্ত নেই। রাহু নাকি সপ্তমে চড়ে। তাতে নাকি বিয়ের আগেই পাত্রীর সঙ্গে যৌনসংসর্গ হয়ে যেতে পারে। খাদ্যে বিষক্রিয়া, ঔষধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়ে যেতে পারে। প্রতারণার শিকার হতে পারে। বায়ুজনিত রোগে কষ্ট পেতে পারে।
রাহুর মহাদশার কথাও ভেবে রেখেছে ভীতুরা। বলেছে, মহাদশা দেখা গেলে অকারণে প্রচুর মিথ্যা বলার অভ্যাস হয়। সর্বদাই মাথা গরম থাকে। সমস্যা কিছুতেই পিছু ছাড়ে না। কোনও কিছুতেই সুনাম পায় না। মানহানির আশঙ্কা থাকে। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়, এমনকি হাতের নখ নাকি নিজে নিজেই ভেঙে যায়।
রাহুর আবার কালসর্প যোগ হয়। রাহুকে শান্ত করার মন্ত্র আছে। সেটা হল, ওঁ ভ্রাং ভ্রীং ভ্রৌং সং রাহবে নমঃ। এইভাবে রোজ রাতে ১০৮ বার পড়তে হবে।
এর বিকল্প মন্ত্রটি বেশ লম্বা। ওঁ ক্রোং ক্রীং হুং হুং টং মংক ধারিণে রাহবে রং হ্রীং শ্রীং মৈং স্বাহা ।
আরেকটি মিনি সাইজ মন্ত্র আছে,
ওঁ এং হ্রীং রাহবে নমঃ।
এছাড়া বলা হয়েছে গরুকে ও কুকুরকে খাওয়ালে ও শিবলিঙ্গের সামনে শিব চালিশা পড়লেও রেহাই পাওয়া যায়।
কেতুকে নিয়েও জমজমাট সব তত্ত্ব ফেঁদেছেন ধর্মব্যিবসায়ীরা। এই কেতুগ্রহ নাকি তর্ক, বুদ্ধি, জ্ঞান, বৈরাগ্য, অন্তর্দৃষ্টি, সহমর্মিতা, ও অন্যান্য মানবিক গুণের কারক। কেতু নাকি মানবশরীরে অগ্নিতত্ত্বের প্রতিনিধিত্ব করে। বলেছেন, কেতু নাকি রাহুর সঙ্গে মিলিতভাবে জাতকের জন্মকুণ্ডলীতে কালসর্পযোগের প্রাদুর্ভাব ঘটায়।
ধর্মব্যসায়ীরা কেতুর দশা কেমন তাও বলেছেন। জাতকের জাগতিক সব চাওয়া পাওয়ায় অনীহা দেখা দেবে। আর মানসিক সমস্যা দেখা দেবে। কেতুর মহাদশা হলে জাতক হতাশা ও অবসাদে ডুবে যাবে। সর্বত্র বাধার সম্মুখীন হবে।
কেতুকে শান্ত করার মন্ত্রও বাতলানো হয়েছে। ওঁ স্রাং স্রীং স্রৌং সঃ কেতবে নমঃ। বিকল্প মন্ত্রটি কিঞ্চিৎ দীর্ঘ। ওঁ হ্রীং ক্রূং ক্রূর রূপিণে কেতবে এং সৌ স্বাহা।
আরেকটি মিনি সাইজ বিকল্প হল,
ওঁ হ্রীং কেতবে নমঃ।
গ্রহরত্ন ধারণ করেও রাহুকেতুকে বাগ মানানোর মতলব দেওয়া আছে। রাহুকে সামলাতে পরতে হবে গোমেদ বা গারনেট এবং কেতুর জন্যব বৈদুর্যমণি। বা ক্যাাটস আই।
এদিকে গোমেদ হল সিলিকেট নামক যৌগের সঙ্গে ধাতুর খনিজ। সিলিকেটের সঙ্গে দুই রকম ধাতু জুড়ে গোমেদ। এক রকম ধাতুর গ্রুপে থাকতে পারে ক্যানলসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ। অন্য আরেকটি ধাতুর গ্রুপ হল অ্যালুমিনিয়ম, লোহা, ক্রোমিয়াম।
গোমেদ রত্নটি প্রায় সব রকম রঙের হয়। তবে লালচে রঙের গোমেদ বেশি মেলে। নীল রঙের গোমেদ খুব দুর্লভ। গোমেদ রত্ন বেশ হার্ড। মোহ্ স্কেলে তার কাঠিন্যের মান ছয় থেকে সাড়ে সাত।
তবে কেতুকে যে সামলাবে, সেই বৈদুর্যমণি বা ক্যাযটস আই আরো কঠিন। মোহ্ স্কেলে এর কাঠিন্যিমান সাড়ে আট।
বৈদুর্যমণিকে নানাবিধ নামে ডাকা যায়, অসিতোপল, নীলকান্তমণি, ইন্দ্রনীলমণি ইত্যাৎদি। রসায়নবিদ মিনারেলজিস্ট বলবেন ক্রাইসোবেরিল। বেরিলিয়াম, অ্যালুমিনিয়ম আর অকসিজেনের সমবায়ে তৈরি এই ক্রাইসোবেরিল।
রাহুকে নিয়ে ভেবেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। তারুণ্যের দিনে তিনি রাহুর প্রেম নামে কবিতা লিখেছেন এবং প্রবীণ বয়সে সে কবিতা সঞ্চয়িতাতে সংকলিত করেছেন।
গ্রহণ নিয়ে ভাবতে গেলে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯ — ১৯৫৫)–এর কথা আসবেই আসবে। আইনস্টাইন ১৯০৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে স্পেশাল রিলেটিভিটি নিয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন। ১৯১৬–তে প্রকাশ করেন সাধারণ রিলেটিভিটি। ১৯১৭–তে বিশ্বজগতের গঠন কেমন, তা সাধারণ রিলেটিভিটি দিয়ে ব্যাখ্যাও করলেন। স্পেস টাইমের বক্রতা নিয়েও বললেন।
বললেন বিরাট মাপের ভরের অস্তিত্ব আলোর গতিপথকেও বাঁকিয়ে দেবে। কিন্তু সবাই পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়ে যান। আইনস্টাইনকে আর নোবেল কমিটি পুরস্কার দিতে চাননা। এমন সময়, ১৯১৯ সালের ২৯ মে আফ্রিকার পশ্চিমকূল থেকে একটি সূর্যগ্রহণ দেখতে গিয়ে স্যার আর্থার স্ট্যানলি এডিংটন (১৮৮২ — ১৯৪৪) দেখিয়ে দিলেন, আইনস্টাইন যা বলেছেন, তা একেবারেই নির্ভুল। গ্রহণে সৌর আলোকচাকতিটি চাঁদের আড়ালে ঢাকা। অন্ধকারে দেখা গেল সুদূরের তারার থেকে খসা আলো সৌরভের প্রভাবে বেঁকে যাচ্ছে। মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব আলোও কাটাতে পারে না, আইনস্টাইনের এই কথা হাতে কলমে প্রমাণ করে দিলেন আর্থার এডিংটন। ১৯২১ সালে আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন।
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments