বিতর্কিত পণ্ডিত
ডঃ সঞ্জীব রায়

১৮৮৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মাদ্রাজের থিরুট্টনি নামক এক মন্দির শহরে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের। বাবা সর্বপল্লী বীরস্বামী এবং মা সর্বপল্লী সীতা। বাবা ছিলেন স্থানীয় জমিদারের অধীন রেভেনিউ কালেক্টর। নেল্লোর শহরের নিকটবর্তী সর্বপল্লী নামক এক গ্রামে তাঁদের চার পুরুষের বসবাস ছিল। সেই গ্রামের সবাই নিজ নামের আগে গ্রামের নাম ‘‌সর্বপল্লী’‌ ব্যবহার করতেন। 

অত্যন্ত মেধাবী রাধাকৃষ্ণন ছাত্রাবস্থার গোড়া থেকেই বৃত্তি পেয়ে এসেছেন। প্রাইমারি শিক্ষা থিরুট্টনির কেভি স্কুলে, পরবর্তীকালে শিক্ষা তিরুপতি মিশনারি স্কুলে। ১৯০৬ সালে মাদ্রাজ ক্রিশ্চিয়ান কলেজ থেকে স্নাতক হন। স্নাতক হওয়ার আগেই অর্থাৎ ১৯০৪ সালে রাধাকৃষ্ণনের বয়স যখন মাত্র ১৬, তখন সংস্কারাচ্ছন্ন পরিবারের চাপে পরে তিনি বিবাহ করতে বাধ্য হন। পাত্রীর নাম শিবাকামু। স্নাতক হবার আগে থেকেই বাবা চাইতেন ছেলে পৌরোহিত্য করে সংসারের হাল ধরুক। কিন্তু ছেলের প্রচণ্ডভাবেই ইচ্ছা পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। তবে অভাব অনটনের সংসারে রাধাকৃষ্ণন স্নাতকোত্তর পড়ার ইচ্ছা ত্যাগ করেন। হঠাৎ করে এক সুযােগ এসে যায়। রাধাকৃষ্ণনের এক তুতো দাদা দর্শনশাস্ত্র নিয়ে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। রাধাকৃষ্ণন খানিকটা কৌতুহল বশবর্তী হয়ে তাঁর বইগুলো চেয়ে নিয়ে পড়তে থাকেন। সত্যিকথা বলতে রাধাকৃষ্ণনের দর্শনশাস্ত্র সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল ভৌতবিজ্ঞান। কিন্তু দর্শনের বই পড়তে পড়তে তাঁর বিষয়ের প্রতি আগ্রহ ও ভালবাসা জন্মায়। দ্রুত তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে দর্শনশাস্ত্র নিয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভর্তি হবেন। তাতে বই কেনার খরচটাও বাঁচানো যাবে।

তখনকার দিনে এমএ পাশ করতে হলে কোনো একটি বিষয়কে নির্বাচিত করে গবেষণাপত্র জমা দিতে হত। রাধাকৃষ্ণনের গবেষণার বিষয় ছিল— ‘‌দ্য এথিক্স অফ দ্য বেদান্ত অ্যান্ড ইট’‌স মেটাফিজিক্যাল প্রিসুপ্পসিশনস’‌। এক কথায় বলতে গেলে রাধাকৃষ্ণনের গবেষণায় বিষয়বস্তু মূলত অদ্বৈত বেদান্তের ওপর ভিত্তি করে লেখা। দক্ষিণ ভারতীয় সমাজের এক শ্রেণীর ধারণা ছিল বেদান্তের আদপেই কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি নেই। রাধাকৃষ্ণনের গবেষণার বিষয়বস্তু প্রকৃত অর্থেই ছিল সেই ধারণার ওপর এক কুঠারাঘাত। অন্যদিকে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী শিক্ষকরাও গবেষণাপত্রটিকে উপলক্ষ্য করে বেদান্তের সমালোচনা করা শুরু করেন। স্বভাবতই রাধাকৃষ্ণনের আশঙ্কা হয়েছিল যে তাঁর গবেষণা পত্রটি মাস্টারমশাই ডঃ অ্যালফ্রেড জর্জ হগের কাছে উত্তীর্ণ হবে কিনা। কিন্তু সব সন্দেহের নিরসন করে হগ সাহেব গবেষণা পত্রটিকে যথোপযুক্ত স্বীকৃতি দিলেন। এই সময়ে রাধাকৃষ্ণন হিন্দুত্ব, ভারতীয় দর্শন ও ধর্ম নিয়ে আরও পড়াশোনা করতে আগ্রহী হন। এই প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও তাঁর কিছু লেখা তাঁকে হিন্দুত্ব সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান লাভে সাহায্য করেছিল বলে তাঁর নিজের মুখে স্বীকার করা।

শিক্ষক জীবন
১৯০৯ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে দর্শন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে রাধাকৃষ্ণনের শিক্ষক জীবন শুরু। শিক্ষক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ক্রমশ বিস্তার লাভ করতে থাকে। বোধ করি এইটুকু বলা অত্যুক্তি হবে না শিক্ষকতাকে তিনি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যান। তাঁর ক্লাসে নিজের কলেজের ছাত্ররা ছাড়াও অনেক দূর থেকে অন্য কলেজের ছাত্ররাও আসত। প্রায় ৯ বছর কলেজের অধ্যাপনা শেষ করে তিনি মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর আগে ১৯১৫ সালের একেবারে গোড়ার দিকে তাঁর সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষাৎ হয়। দু’‌জনের মধ্যে ভারতীয় দর্শন নিয়ে বহুক্ষণ আলোচনা হয়। দর্শন শাস্ত্রের ওপর কবিগুরুর জ্ঞানের অভিজ্ঞতা দেখে তিনি বাস্তবিকই অভিভূত হয়ে যান। তিনি নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করেন যে কবিগুরুর দর্শনের ভাবধারার মাধ্যমে ভারতীয় দর্শনের প্রকৃত চিত্রটি প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি কবিগুরুকে কথা দিয়েছিলেন যে তিনি যদি কোনোদিন বই লেখেন তবে প্রথম বইটি তিনি তাঁর দর্শনের আধারেই লিখবেন। রাধাকৃষ্ণন কথা রেখেছিলেন। তাঁর লেখা প্রথম বইটি ছিল ‘‌দ্য ফিলোসপি অফ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’‌। ২৯৪ পাতার বইটি ১৯১৬ সালে ম্যাকমিলান (লন্ডন) থেকে প্রকাশিত হয়।

১৯২১ সালে দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষের অনুরোধে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার যে বাংলার বাঘের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব গভীর ছিল। তিনি স্যার আশুতোষকে অত্যন্ত ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন। ১৯২১ সাল থেকে শুরু করে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ওই সময় কিং জর্জ (৫ম)–এর চেয়ার আলোকিত করেছিলেন (কিং জর্জ ফাইভ চেয়ার অফ মেন্টাল অ্যান্ড মরাল সায়েন্স)‌। ওই পদে থাকাকালীন তিনি ১৯২৬ সালের জুন মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি হিসেবে ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ এম্পায়ার–এ প্রতিনিধিত্ব করেন। সেই বছরই সেপ্টেম্বর মাসে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘‌ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ ফিলোসপি’‌–তে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। সত্যি কথা বলতে, তাঁর সময়ে দর্শনশাস্ত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত দুঃখজনক এই যে ওই সময়ের ভেতরে তিনি একটি অবাঞ্ছিত বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন, যা কোনোতেই কাম্য ছিল না। সেই প্রসঙ্গে বিস্তারিত ভাবে পরে আসছি।
১৯২৯ সালে হ্যারিস কলেজের (অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ কলেজ) অধ্যক্ষ কারপেন্টার সাহেব অবসর নেওয়াতে পদখানি শূন্য হয়। রাধাকৃষ্ণনের কাছে পদখানি পূরণের জন্য অনুরোধ গেলে তিনি তা গ্রহণ করেন। দ্রুত অক্সফোর্ডের ছাত্রদের কাছে রাধাকৃষ্ণন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে স্বীকৃতি পান। তারই ফলস্বরূপ ১৯৩১ সালের জুন মাসে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ‘‌নাইট’‌ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৩১–১৯৩৬ সাল পর্যন্ত রাধাকৃষ্ণন অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ উপাচার্যের দায়িত্ব সামলান। ১৯৩৭ সালে সাহিত্যে নােবেল পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম মনোনীত হয়, কিন্তু চূড়ান্ত নির্বাচনে তিনি ব্যর্থ হন। দুর্ভাগ্যবশত, ওই একই ব্যর্থতার ঘটনা তাঁর জীবনে বহুবার ঘটেছে। ১৯৩৯ সালে মদনমোহন মালব্য মহাশয়ের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কার্যকাল শেষ হওয়ায় তিনি রাধাকৃষ্ণনকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হতে অনুরােধ করেন। সেই অনুরোধেই রাধাকৃষ্ণন কার্যভার গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সেই সহ উপাচার্য পদে তিনি বহাল ছিলেন।

রাজনৈতিক জীবন
শিক্ষক হিসেবে চূড়ান্ত সাফল্য রাধাকৃষ্ণন অনেকটা দেরিতেই রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তিনি কোনোদিন স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেননি। জীবনে তিনি মূলত দুটি জিনিসকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন— শিক্ষকতা ও ভারতীয় হিন্দু দর্শনকে পাশ্চাত্য ধ্যান–ধারণার উপরে স্থান দেওয়ার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা করে যাওয়া। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস তাঁকে একজন উচ্চমানের শিক্ষাবিদ হিসেবেই রাজনীতিতে ব্যবহার করে এসেছে। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হবার পর রাধাকৃষ্ণন দেশের হয়ে ইউনেস্কোতে প্রতিনিধিত্ব করার সুযােগ পান (১৯৪৭–৫২)। ১৯৪৯ সালে দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর পূর্বসূরি বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের স্থলাভিষিক্ত হন। রাধাকৃষ্ণন অত্যন্ত দ্রুত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জে ওঠা কাশ্মীর বিতর্কে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভারত সমর্থনের ভিত্তি সুদৃঢ় করেন।

১৯৫২ সালে প্রজাতন্ত্র দিবসে রাধাকৃষ্ণন দেশের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন। ১৯৫৪ সালে তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন প্রদান করা হয়। ১৯৬২ সালের ১২ মে পর্যন্ত উপরাষ্ট্রপতি পদে থাকার পর ১৪ মে তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। সেই বছরই তাঁর কিছু প্রাক্তন ছাত্র তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁর জন্মদিন পালনের অনুমতি চায়। রাধাকৃষ্ণন তাদের বলেন, তিনি অত্যন্ত খুশি এবং গর্বিত হবেন যদি তাঁর জন্মদিনটি ছাত্ররা শিক্ষক হিসেবে পালন করে। মাস্টার মশাইয়ের ইচ্ছাকেই শিরোধার্য করে তাঁর জন্মদিন শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হওয়া শুরু হল। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে।
রাধাকৃষ্ণন তাঁর কার্যকালে রাষ্ট্রপতি (১৯৬২–১৯৮৬৭) হিসেবে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি উক্ত সময়ের মধ্যে ৪ জন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম দু’‌জনের প্রয়াণ ঘটে। তাঁরা হলেন যথাক্রমে জওহরলাল নেহরু এবং লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। দু’‌বার যুদ্ধ হয় ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান ও চীনের।

সমাজবন্ধু
অনাড়ম্বর ভাবেই কেটেছে জীবন। দানধ্যান কম করেননি। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন তিনি মাসিক বেতন ১০ হাজার টাকা পেতেন। তার মধ্যে মাত্র ২,৫০০ টাকা নিজের কাছে রেখে বাকি ৭,৫০০ টাকা প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় তহবিলে দান করতেন। তিনি ভারতের পিছিয়ে থাকা মানুষের জন্যে ‘‌হেল্‌পএজ ইন্ডিয়া’‌ নামক একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। এ ছাড়াও রাধাকৃষ্ণন ঘনশ্যাম দাস বিড়লার সঙ্গে ‘‌কৃষ্ণার্পন চ্যারিটি ট্রাস্ট’‌ গঠন করেন।
১৯৭৫ সালের ১৭ এপ্রিল ৮৬ বছর বয়সে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন মাদ্রাজে মারা যান।

পিছু ছাড়েনি বিতর্ক 
এবার আসি সেই বিতর্কের প্রসঙ্গে। রাধাকৃষ্ণন বিতর্ক যে ব্যক্তিকে ঘিরে, তাঁর নাম যদুনাথ সিংহ। তিনিও একজন স্বনামধন্য দার্শনিক, বয়সে রাধাকৃষ্ণনের চেয়ে বছর চারেকের ছোট। তিনি ১৯১৫–১৬ সালে ক্লিন্ট মেমোরিয়াল ও ফিলিপ স্মিথ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। যদুনাথবাবু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেমচন্দ্র ও রায়চন্দ্র স্কলারশিপের জন্য নিজের গবেষণাপত্রের (ইন্ডিয়ান সাইকোলজি অফ পারসেপশন) দুটি খন্ড যথাক্রমে ১৯২২ ও ১৯২৩ সালে জমা দেন। অভিযোগ ওঠে রাধাকৃষ্ণনের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘‌ইন্ডিয়ান ফিলোসফি’‌–র (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে মুদ্রিত) দ্বিতীয় খন্ডের বেশ কিছু অংশ সরাসরি ভাবে যদুনাথবাবুর গবেষণাপত্র থেকে নেওয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে এ অভিযােগ নতুন নয়, ছাত্রের লেখা নিয়ে মাস্টারমশাই নিজের নাম ছাপাচ্ছেন, এ জিনিস বহুকাল থেকেই চলে আসছে। এটি বোধকরি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করাও মুশকিল। তবে এ ক্ষেত্রে দুটো জিনিস ভাববার আছে। সে দুটো হল, এখানে বাদী বিবাদী কেউই কিন্তু সাধারণ নন। রাধাকৃষ্ণন সম্পর্কে নতুন করে বলার নেই অন্যদিকে যদুনাথবাবুরও মেধা ও পাণ্ডিত্যের বিকল্প পাওয়া বাস্তবিকই মুশকিল। পাণ্ডিত্যের জোরে তিনি ১৯২৩ সালে গ্রিফিথ পুরস্কার ও ১৯২৪ সালে মোয়াট মেডেল পান। আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনায় চালিত মানুষটির অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা দেখে বোঝার উপায় ছিল না প্রকৃত মানুষটাকে।

রাধাকৃষ্ণনের বই প্রকাশের অনেক পরে যদুনাথবাবুর নজর করেন যে তাঁর গবেষণাপত্রের অংশ তাঁর অনুমতি ব্যাতিরেকে রাধাকৃষ্ণনের বইতে ব্যবহার করা হয়েছে। শোনা যায় যদুনাথবাবু রাধাকৃষ্ণনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। যদি তাই হয়ে থাকে তবে আপসে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেওয়া যেত কিন্তু দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ সমাজের জাত্যভিমান একটু বেশি মাত্রায় থাকে। রাধাকৃষ্ণন তাঁর ব্যতিক্রম নন, তবে সেটি উনি বিনয়ের আড়ালে ঢেকে রাখতেন। ১৯২৯ সালের জানুয়ারি মাসে অধ্যাপক যদুনাথ সিংহ ভারতের সারস্বত সমাজকে নাড়িয়ে দিয়ে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের বিরুদ্ধে থিসিস চুরির অভিযোগে কলকাতা উচ্চ আদালতে মামলা করেন। তৎকালীন ‘‌প্রবাসী’‌ ও ‘‌মডার্ন রিভিউ’‌ পত্রিকার সম্পাদক রমানন্দ চট্টোপাধ্যায় যদুনাথবাবুকে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। বেশ কিছুদিন মামলা চলার পর কলকাতা হাইকোর্ট এই মামলাটির রায় বের না করেই স্থগিতাদেশ দেয়, যা নিঃসন্দেহে বহু মানুষকেই অবাক করেছিল। নিন্দুকরা বলেন তদানীন্তন উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় যদুনাথবাবুর উপর নাকি মামলা তুলে নেবার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। তবে মামলার ফলে পরোক্ষভাবে যেটা হল তা নিঃসন্দেহে খুবই দুঃখজনক। এই প্রসঙ্গে একটা তথ্য দেওয়া যেতে পারে— রাধাকৃষ্ণনের নাম ১৫ বার নোবেল পুরস্কারের জন্য এবং ১১ বার নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেও আশ্চৰ্যজনক ভাবে চূড়ান্ত নির্বাচনে তাঁর নাম বাদ যায়, যে দৃষ্টান্ত বাস্তবিকই দুর্লভ।

আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ দেশে পালিত হোক শিক্ষক দিবস
আমরা ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস পালন করি। উপলক্ষ্য একজন মহান শিক্ষককে সম্মান জানানো। উপেক্ষা করা হয় আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবসকে (৫ অক্টোবর)। দীর্ঘদিন ধরেই এই রেওয়াজ চলে আসছে। শিক্ষক হিসেবে অসাধারণ মানুষটি একসময় বলেছিলেন, ‘‌টিচার শুড বি দ্যা বেস্ট মাইন্ডস ইন দ্যা কান্ট্রি’‌। বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, দেশের সমগ্র শিক্ষকদের মানসিকভাবে শ্রেষ্ঠ হওয়া উচিত। ভালোমন্দ মিশিয়েই মানুষ। ১০০ শতাংশ সৎ বা ভালো কেউ হতে পারে না। তবে তাঁর মতন মানুষের বলা কথার সঙ্গে বিতর্কে যুক্ত মানুষটির অনেক তফাৎ!
পরিশেষে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে দুটো প্রস্তাব রাখি। আমার মতন সাধারণ মানুষের এই প্রস্তাব রাখার ঔদ্ধত্য মার্জনা করবেন। ভারতবর্ষে শিক্ষক দিবস আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ৫ অক্টোবর করা হোক। কারণ বিতর্ককে জোর করে চাপা দিয়ে বা গোপন রেখে শিক্ষক দিবস উদ্‌যাপন না করাই ভালো। আর যদি সেপ্টেম্বর মাসেই শিক্ষক দিবস পালন করতেই হয় তবে কয়েকদিন পিছিয়ে সেটি ২৬ তারিখ করা যেতেই পারে। ওইদিন এমনই একজনের জন্ম যাকে বর্ণ পরিচয়ের সময় থেকেই আমরা চিনি। তিনি আবার ‘‌বিধবা বিবাহের’‌ মতন মহান কাজের জনক।

এরূপ ব্যবস্থার সুবিধাও আছে। এই প্রস্তাবে উচ্চবর্ণের জাত্যভিমান থাকার কথা নয়। তাঁরা সোচ্চার হবেন না এই ভেবে যে তাঁদের জাতের লোককেই সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণ ২৬ তারিখ জন্মদিন যাঁর, সেই মহান ব্যক্তি শুধুমাত্র দ্বিজশ্রেষ্ঠ বা বর্ণশ্রেষ্ঠ নন তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতও বটে। ‘‌ঈশ্বরকে’‌ তর্পণ করার বা প্রণাম জানানোর এর থেকে বড় উপলক্ষ্য বোধকরি আর কিছুই হতে পারে না।‌

সব ছবি:আন্তর্জাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *