জয় জয় দেবী...
স্কুলে কলেজে পড়ার সময় কীভাবে কেটেছে সরস্বতী পুজোর দিনগুলো? চারজন বিশিষ্ট মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেনে নিলেন অংশুমান চক্রবর্তী
অলকানন্দা রায়
বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী
আমাদের স্কুলে পুজো হত। তবে আমরা মেতে থাকতাম বাড়ির পুজো নিয়ে। সারাদিন ধরে। সন্ধেবেলায় ঠাকুর দেখতে বেরোতাম বন্ধুদের সঙ্গে। কখনও নিজেরা ছোটখাটো অনুষ্ঠান করতাম। কেউ নাচ করত, কেউ গান। সরস্বতী পুজোয় সবথেকে আনন্দের বিষয়, পড়াশোনা করতে হতো না। বইখাতা থাকত ঠাকুরের কাছে। ঘুঙুর, গীতবিতান সবই ঠাকুরের কাছে দেওয়া হতো। আমাদের সময় সবকিছু ভীষণ সিম্পল ছিল। পাড়ায় পাড়ায় তখন এত বড়ো করে পুজো হত না। বাড়ি এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই মূলত পুজো হত। পাড়ায় হত ছোটো পুজো।
বাচ্চারা আসতো চাঁদা তুলতে। আট আনা, একটাকা। তাতেই সন্তুষ্ট হত ওরা। মন দিয়ে পুজো করত। আমরা ওই ঠাকুরগুলো দেখতে যেতাম। কলেজেও সরস্বতী পুজোর দিনগুলো মোটামুটি এইভাবেই কেটেছে। ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর আমার বিয়ে হয়ে যায়। তখনও বাড়ির পুজো নিয়েই মাতামাতি করতাম। এখনকার পুজোর থেকে তখনকার পুজো ছিল অনেক আলাদা। আর একটা বিষয় বলি, তখন সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেতাম না। এখনও খাই না। এখন বাড়িতে পুজো করি না। আমার নাতনিরা একটু বড়ো হলে আবার করবো। আমি চাই ওরা পুজোটা শিখুক। এখন সংশোধনাগারের পুজোয় যাই। ওখানকার আবাসিকরা পুজোর আয়োজন করে। নিজেরাই ঠাকুর তৈরি করে। ‘বাল্মিকী প্রতিভা’য় আমি মা সরস্বতী সেজেছিলাম। সংশোধনাগারের আবাসিকরা তারপর থেকে আমাকে মা সরস্বতীর চোখে দেখে। একবার ওদের তৈরি প্রতিমার মাথায় আমার মতো চুল দেখা গিয়েছিল। দেখে আমার খুব ভালো লেগেছিল।
রূপা মজুমদার
সম্পাদক, শুকতারা ও নবকল্লোল
আমাদের স্কুলে সরস্বতী পুজো হতো না। বাড়িতে আমি নিজের মতো করে পুজো করতাম। সাধারণ ভাবে। তবে আমাদের ফ্ল্যাটের নীচে সরস্বতী পুজো হতো। সেটা ছিল বেশ আনন্দের ব্যাপার। আগের দিন সবাই মিলে ঠাকুর আনতাম, নিজেরাই ঠাকুর সাজাতাম। পুজোর দিনে ঠাকুরকে খাচুড়ি ভোগ দেওয়া হত। আমরাই সব আয়োজন করতাম। সন্ধেবেলায় মেতে উঠতাম নাচ–গানে। কোনো কোনো বছর বাবা–মায়ের সঙ্গে নাটক বা সিনেমা দেখতে যেতাম। দুর্গাপুজো ও কালীপুজোর সময় পড়াশোনা নিয়ে একটা টেনশন থাকত। স্কুল খুললেই পরীক্ষা।
তবে সরস্বতী পুজোর আগের দিন থেকে পরের দিন পর্যন্ত বইখাতার সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক থাকত না। কারণ বইখাতা থাকত ঠাকুরের কাছে। কলেজে পড়ার সময়েও সরস্বতী পুজোর দিন খুব আনন্দ করতাম। বন্ধুরা মিলে সেজেগুজে শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াতাম এদিক ওদিক। সাধারণত আমি শাড়ি পরতাম কম। তবে সরস্বতী পুজোর দিন শাড়িই বেছে নিতাম। দেখতাম ঠাকুর। যেতাম বন্ধুদের বাড়ি। এককথায় একদিনের জন্য বাঁধনছাড়া। আমার মনে হয় সরস্বতী পুজো কমবয়সীদের খুব প্রিয় পুজো। অনেকের প্রেমের শুরু হয় এই সময়। সরস্বতী পুজো এককথায় বাঙালির ভ্যালেনটাইনস ডে।
সুমন্ত্র সেনগুপ্ত
বিশিষ্ট বাচিকশিল্পী
কলেজ জীবনের সরস্বতী পুজোতে আমার বিশেষ কোনো স্মৃতি নেই। কারণ আমাদের কলেজে সরস্বতী পুজো নিয়ে খুব একটা হইচইতে অংশ নিতে পারিনি। একই সঙ্গে তখন থেকেই আমাকে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য চাকরি করতে হত। রাতে কলেজ করতাম। বেলঘরিয়াতে মধুসূদন ব্যানার্জি রোডে একটা দোতলা বাড়ির নীচের তলায় প্রায় রাস্তা সংলগ্ন একটা বারান্দা ছিল। তখন তাকে রক বলত। বারান্দাটা লাল। বন্ধুরা মিলে ওখানে সরস্বতী পুজো করতাম। নাম দিয়েছিলাম লাল বারান্দা স্পোর্টিং ক্লাব। সব বন্ধুরা খুব হইচই করে আয়োজন করত। আমি অফিস যেতাম বলে সকালগুলো খুব মিস করতাম। কিন্তু রাতে অবশ্যই থাকতাম। আর পুজোর দিন বাড়ির পুজো শেষ হলেই লাল বারান্দায় জড়ো হতাম। সামনেই বিরাট রাস্তা।
একবছর ঠিক করলাম এই লাল বারান্দায় সরস্বতী পুজো করব। একটু গলি দিয়ে ঢুকলেই মেয়েদের স্কুল। যতীনদাস বিদ্যামন্দির। সেজেগুজে সব যেত। আর কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র আমরা ড্যাব ড্যাব চোখে না হলেও অপাঙ্গে তাকাতাম। মনের মধ্যে একটা ধুকপুকানি টের পেতাম। আমাদের বন্ধু মানিক ছিল খুব রসিক। ও আমাদের চোখমুখের পরিবর্তন লক্ষ্য রাখত। আর বলত "তাকাইস না। কুনো লাভ নাই। হেইগুলি দেখবি কুনদিন আমাগো কাকিমা মামিমা হইবো।" প্রথম প্রথম বুঝতে একটু সময় লাগত। পরে বুঝে সবাই হো-হো করে হেসে উঠতাম। জীবনে প্রথম সামনে থেকে মদের বোতল দেখা এই সময়েই। সন্ধেবেলায় নিজেরা মিলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একটু বাঁধনহারা, একটু শাসনের আড়াল একটু বেশি রাত করে বাড়ি ফেরা। সময় চলে যায় রেখে যায় কিছু মুহূর্ত। সেই মানিক কত অপরিণত সময়ে চলে গেল। ওর কথাগুলো এই সরস্বতী পুজোয় ফিরে ফিরে আসে।
শান্তনু রায়চৌধুরী
বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী
আমি বড়ো হয়েছি দমদম ক্যান্টনমেন্টে। আমি খুব ছোট থেকেই সেখানে পাড়ায় সরস্বতী পুজো হতে দেখেছি। পুজোটা হত ছোট একটা মাঠে। একমাস আগে থেকেই আমরা পুজোকে কেন্দ্র করে মেতে উঠতাম। এগারো বারোটা বাড়ি নিয়ে পাড়া। পুজোর দিন পনেরো আগে বাড়ির পাঁচিলগুলোতে আমরা রং করতাম। এটা চলেছে টানা ২০-২৫ বছর। দেওয়ালের রং শুকিয়ে গেলে বিভিন্ন মনীষীদের বাণী লিখে দিতাম। আমরা প্যান্ডেল করতাম নিজেরাই। দুদিন আগে থেকে, প্রায় রাত জেগে। দলবেঁধে ঠাকুর আনতে যেতাম। পুজোর দিন মেতে থাকতাম পাড়ার পুজো নিয়েই। মাইকে বাজত সুন্দর সুন্দর গান। কখনো কখনো নিজেরা রান্না করতাম। হুল্লোড় করতাম খুব।
সরস্বতী পুজোয় পাড়ায় এতটাই মেতে থাকতাম যে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুজোয় আমার খুব বেশি যাওয়া হয়নি। ক্লাস এইট নাইনে পড়ার সময় থেকেই পাড়ার পুজোর দায়িত্ব আমার হাতে চলে আসে। টানা ২০ বছরের মতো সেই দায়িত্ব পালন করেছি। একটা সময়ের পর সেই মাঠে বাড়ি হয়ে যায়। তখন পুজোটা হয় একটা গ্যারেজে। কায়স্থ সন্তান হয়েও আমি পৌরোহিত্য করেছি। তখন ইলেভেনে পড়ি। পুজোর দিন কোনো এক কারণে পুরোহিত মশাই রেগে গেলেন। বলেন, আমি পুজো করব না। আমরা পড়লাম মহা সমস্যায়। বাধ্য হয়ে আমিই পৌরহিত্য করি। এখন পাড়ার সেই পুজোটা বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়িতে মা পুজোর আয়োজন করেন। পুরোহিত মশাই আসেন। আমি পুজোর দিনে এইচএমভি অফিসে যাই। এখন আলাদা করে আর পুষ্পাঞ্জলি দিই না। কারণ দেবী সরস্বতীর চরণে আমি প্রতিদিন আত্মার অঞ্জলি দিই, সুরের অঞ্জলি দিই। হাতজোড় করে দেবীর স্তব উচ্চারণ করি। এইভাবে প্রতিদিন আমি সরস্বতী পুজো করি।
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments