বেচারি ইউক্রেন!‌
ডঃ সঞ্জীব রায়

ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার বিবাদ কিন্তু আজকের নয়। দেখতে দেখতে সেই বিবাদের মেয়াদ সহজেই শতবর্ষ পার করে ফেলেছে। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদী জনগণ স্বাধীনতার স্বাদ পায়। দুর্ভাগ্য তাদের। বছর তিনেক কাটতে না কাটতেই পূর্ব ইউক্রেন সোভিয়েতের দখলে আসে। তারপর থেকেই ক্রমাগত টানাপোড়েন শুরু হয়। সত্যি বলতে কী স্তালিনের সময় থেকেই সোভিয়েতের দমননীতি ইউক্রেনের ক্ষতি করেছে। ইউক্রেনের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে নিষ্ঠুর গণহত্যা, দুর্ভিক্ষ (‌হলোদোমর)‌ নির্বাসন প্রভৃতির। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই শুধুমাত্র পূর্ব ইউক্রেন নয়, সম্পূর্ণ ইউক্রেনের দখল নেয় সাবেকি সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৬০ সাল অবধি ইউক্রেনের মানুষজন সাধ্যমত লড়াই করেছেন। গেরিলা যুদ্ধে অস্ত্র এসেছে পশ্চিমের দেশসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তারপর সেই স্বাধীনতার যুদ্ধ দমননীতির কাছে হারমানে। শয়ে শয়ে রাজনৈতিক বন্দির ঠাঁই হয় সাইবেরিয়ায়। সুযোগ পেয়ে সোভিয়েত দীর্ঘদিন যেমন খুশি তেমনভাবেই ইউক্রেনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে।

এইভাবেই চললো দীর্ঘদিন। ১৯৯১ সাল, নড়বড় করতে করতে কমিউনিজম ভেঙে গেল। সোভিয়েত ভেঙে নয় নয় করে ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্র হল। সেই ১৫টির মধ্যে ইউক্রেন অন্যতম হলে কী হবে, সমস্যা রয়েই গেল। হুবহু সেই চিত্র দেখা গেল, যা দেখা গিয়েছিল জার্মানিতে বার্লিন ভাগ করে পশ্চিম জার্মানি ও পূর্ব জার্মানি সৃষ্টির মাধ্যমে। এক্ষেত্রেও ইউক্রেনের পশ্চিম অংশ নিয়ন্ত্রণ করত আমেরিকাসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো, অন্যদিকে পূর্ব ইউক্রেনকে নিয়ন্ত্রণ করত রাশিয়াসহ তাদের বন্ধু পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো। ২০০৪ সাল অবধি এই গতানুগতিক ভাবেই চললো। ২০০৪ সালে নতুন করে ভোট গ্রহন হয় ইউক্রেনে ক্ষমতায় বসেন ভিক্টর ইউনচেঙ্কো।
আজকের এই দুর্দশার জন্য ইউক্রেনের একটি ভুলের উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন। ১৯৯৪ সালের পরমাণু অস্ত্রের সংখ্যায় পৃথিবীর তৃতীয় শক্তি ছিল ইউক্রেন। রাশিয়া, আমেরিকার পরেই। ভারত বহুবার ব্ল্যাঙ্কচেক দিয়ে তাদের ইউরেনিয়াম চেয়েছে, কিন্তু পায়নি। সত্যি কথা বলতে কী ইউক্রেন ভারতকে কোনোদিনই কোনো ব্যাপারে সাহায্য তো করেইনি, উল্টে বহুবার ভারতকে কোণঠাসা করতে চেয়েছে। ১৯৯৪ সালে খানিক আবেগতাড়িত হয়ে ইউক্রেন রাশিয়া, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আশ্বাসে ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডার স্বেচ্ছায় তাদের হাতে তুলে দেয়। সেই তুলে দেবার সময় ইউক্রেনের সুর ছিল অনুপমের সঙ্গে সুর মিলিয়ে— ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’। তখনকার সেই দাদারা ইউক্রেনকে আশ্বাস দেয় যে ইউক্রেনের স্বাধীনতা রক্ষা করা হবে। কিন্তু কোথায় কী!‌ তারা তাকে তার মতন করে আর থাকতে দিল কই!‌ 

২০১০ সালে ভিক্টর ইউনচেঙ্কোকে ক্ষমতাচ্যুত করে মস্কোপন্থী ইয়ানুকোভিচ প্রেসিডেন্ট পদে বসেন। ২০১৪ সালে প্রবল আন্দোলনে ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতা হারান। আজকের এই গোন্ডগোল মূলত ২০১৪ সাল থেকেই শুরু। সেই বছরের শেষে মিনস্ক চুক্তি নামক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির বলে ঠিক হয় যে ইউক্রেনের অধীনে থেকেও দনেৎস্ক এবং লুহানস্ক এলাকা দুটি স্বায়ত্ত শাসন উপভোগ করবে। এই দুটি অঞ্চলকে একত্রে দনবাস বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে স্বায়ত্ত শাসন ছিল আরেক শিখণ্ডী। এই শিখণ্ডীকে সামনে দাঁড় করিয়ে পিছনে চলে আসে বিচ্ছন্নতাবাদী শক্তি। এই বিচ্ছন্নবাদীদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে রাশিয়াই ক্রমাগত সাহায্য করে এসেছে। এখানে ইউক্রেনের সামরিকবাহিনী মোটেই সুবিধা করতে পারেনি। ইউক্রেনবাহিনীর সঙ্গে তথাকথিত বিচ্ছন্নতাবাদীদের সংঘর্ষে আজ অবধি ১৫ হাজারের মতন মানুষের মৃত্যু হলেও সমাধান আজও অধরা। বহু চেষ্টা করেও ইউক্রেন কিছুতেই দনবাস দখল করতে পারেনি। দনবাস অধরা থাকার মূল কারণ ওই অঞ্চলে রাশিয়ান জনসংখ্যা নিশ্চিতভাবে ইউক্রেনীয় অপেক্ষায় অনেক বেশি। দনবাস শুধু দখল করাই নয়, রাশিয়া ক্রমাগত মিথ্যাচার করে গিয়েছি। তারা কোনোদিনই স্বীকার করেনি যে তারা সেটা দখল করে আছে। সত্যি কথা বলতে কী আমেরিকা বা রাশিয়া কেউই মিনস্ক চুক্তিকে মান্যতা দিতে চায়নি। ফল ভোগ করতে হচ্ছে বেচারি ইউক্রেনকে।

ঠান্ডা গরমে চলছিল, কিন্তু সম্পর্ক আর রোগ তো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। হয় মাখামাখি হবে, নচেৎ মুখ দেখাদেখি বন্ধ হবে। এক্ষেত্রে দ্বিতীয়টাই হলো। অনেকেই জানতে চাইবেন রাশিয়া এত আক্রমণাত্মক হল কেন? যেখানে রাশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ পুতিনের এই আগ্রাসনের বিরোধী। উত্তরটা খুব সহজে পাওয়া যাবে না। একটু ব্যাখ্যার প্রয়োজন। ২০১৯ সাল, ইউক্রেনের ভোটে প্রেসিডেন্ট পদে স্বপ্নের অভিষেক ঘটলো ২০১৫ সালের জনপ্রিয় টিভি শো (‌সারভেন্ট অফ দ্য পিপল)‌ খ্যাত কৌতুকভিনেতা ভালোদিমির জেলেনস্কির। তাঁকে নায়কের মতন দেখতে। ইহুদি পরিবারে জন্ম। আইনে স্নাতক। সব ঠিক ছিল। কিন্তু তাঁর একটি মাত্র ঘোষণা পুনরায় আগুনে ঘি পরে। ক্ষমতা পাবার কিছুদিন পরেই তিনি বলে বসলেন যে ২০২৪–এ ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেবার আবেদন করবে তার দেশ। তিনি কথা বলেই ক্ষ্যান্ত হননি। ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার ব্যাপারে তিনি জোরদার চেষ্টা শুরু করেন। রাশিয়া প্রমাদ গুনতে শুরু করে। সত্যি বলতে কী তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও মোটেই ভালো নয়। ইউক্রেনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলে তাদের ঘুরপথে বাণিজ্য করতে হত না। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের বাণিজ্যে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হত না। যুদ্ধের জন্য ক্রেমলিনকে একঘরে করা হবে এটা যেমন নিশ্চিত, তেমনই রাশিয়ার অর্থনৈতিক কাঠামো নিশ্চিতভাবে ক্রমহ্রাসমান হবে সেটায় সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তা সত্ত্বেও পুতিনের হেলদোল নেই!‌ তিনি লাভ লোকসান হিসেব করে নাকি যুদ্ধেই লাভ দেখেছেন!‌

যুদ্ধে ভারতের ক্ষতি হবে সেটা নিশ্চিত। ক্ষতি বাণিজ্যে, ক্ষতি আমদানিতে, ক্ষতি চীনের উৎপাত বৃদ্ধির আশঙ্কায়, সর্বোপরি ক্ষতি অনেক ছাত্রছাত্রীর। অনেকেই খবর রাখেন না যে প্রতি বছর হাজার বিশেক ছাত্র দেশের বাইরে পড়তে যান। এই সংখ্যার মধ্যে শুধুমাত্র ইউক্রেনেই হাজার তিনেক। যাবার কারণ মূলত দুটি— প্রথমত, খরচা কম; দ্বিতীয়ত, মধ্য মেধার ছেলেমেয়েদের সুযোগ পাওয়ার সুবিধে। ইউক্রেনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কিইড মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির ফি ২৫০০ মার্কিন ডলার আর প্রতি বছর থাকা খাওয়ার খরচ মিলিয়ে ৪৮০০ ডলার (‌মোটামুটি ১ ডলার =‌ ৭৫ টাকা)‌। সেখানে ভারতে মাঝারি মাপের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়ার খরচ সব মিলিয়ে প্রায় কোটি টাকা।
অনেকেই ভেবে থাকেন যে পয়সা করি দিয়ে একবার বিদেশে পাঠালেই হল, ব্যাপারটা কিন্তু ততটা সহজ নয়। বিদেশে থেকে ডাক্তার হয়ে দেশে ফিরে ফরেন মেডিক্যাল গ্র্যা জুয়েট এগ্‌জামে বসতে হয় (‌এফ এম জি)‌। এই পরীক্ষায় পাশের হার কোনোদিনই ৩০%‌-এর বেশি হয়নি। সর্বোপরি এই পরীক্ষাতে উতরাতে হলে দরকার ন্যূনতম ৬ থেকে ১২ মাসের ব্যয়বহুল বিশেষ প্রশিক্ষণ। তবে ইউক্রেন ফেরৎ ছাত্রছাত্রীদের পাশের হার তুলনামূলকভাবে ভালো। ২০১৯ সালে ৩৭৭১ জনের মধ্যে ১১৫৯ (‌৩০.‌৭৩%‌)‌, ২০২০-তে ৪২৫৮ জনের মধ্যে ১৬.‌০২%‌ এবং ২০২১-এ ২৪.‌০৩%‌। প্রশ্ন হল, যুদ্ধ শেষে ডাক্তারি পড়ুয়ারা আদৌ সে দেশে ফিরতে পারবে কিনা। পারলেও পুরনো মাটি এক থাকবে কিনা, কত বছর নষ্ট হবে সেটা বাস্তবিকই বড় প্রশ্ন। সর্বোপরী কর্ণাটকের হাভেরির বাসিন্দা ২১ বছরের নবীন শেখরাপ্পা জ্ঞানদা গৌড়ার মৃত্যু নিশ্চিতভাবে সমস্যাকে অনেক ঘনীভূত করেছে।

পরিশেষে বলি, যুদ্ধ বেশি দিন স্থায়ী হবে এমন ভাবা বোধকরি ঠিক নয়। এইরূপ ধারণার যথেষ্ট কারণ আছে। ২০০৮ সালে রাশিয়ার সঙ্গে জর্জিয়ার সেনা সংঘাত কম হয়নি। সময় সবাইকে সবকিছু ভুলিয়ে দিয়েছে। এটাও তার ব্যতিক্রম হবার নয়। পুতিনের উপর চাপ আছে। তার প্রিয় সখা চীন কখন কী পথ নেবে অনুমান করা মুশকিল, যদিও শীতকালীন অলিম্পিকের পর উভয়ের মাখোমাখো ভাব একটু বেশি হয়েছিল। যদি যুদ্ধ বেশি দিন স্থায়ী হয়, তবে বিশ্বের সব দেশই ক্ষতির মুখে পড়বে কারণ বিশ্ব এখন একটি ‘গ্লোবাল ভিলেজ’, সেই ভিলেজে আগুন লাগলে তার আঁচ সবাই অল্পবিস্তর টের পাবে বইকি। দুঃখের কথা, পরিতাপের বিষয় যে ইউক্রেনের একসময় ন্যূনতম চাহিদা ছিল— ‘আমাকে আমার মতন থাকতে দাও’। তাদের মুখপত্র প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে আজ আক্ষেপ করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখাটাকেই তুলে ধরতে হচ্ছে— ‘কেউ কথা রাখেনি, কেউ কথা রাখে না.‌.‌.‌’

সব ছবি:‌ আন্তর্জাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *