আমেরিকা রাশিয়া দ্বৈরথে
এবারের শিখণ্ডী ইউক্রেন
ডঃ সঞ্জীব রায়
আমেরিকাসহ পশ্চিমী কিছু দেশের সঙ্গে সোভিয়েতের শত্রুতা দীর্ঘদিনের। তাদের লড়াইয়ের সময় প্রত্যেকবারই নতুন নতুন শিখণ্ডী বেছে নেওয়া হয়েছে। যেমন ইরাক/ইরান, পূর্ব জার্মানি/পশ্চিম জার্মানি, উত্তর ভিয়েতনাম/দক্ষিণ ভিয়েতনাম। এবারের পালা ইউক্রেনের। পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে এতে অবশ্য বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা একেবারেই নেই, কারণ বাদী-বিবাদী দুই পক্ষই অপরের শক্তি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তবে যুদ্ধ যুদ্ধ মনোভাব চলতে থাকলে সব দেশকেই অর্থনৈতিকভাবে কিছু খেসারত দিতে হতে পারে।
১৯৯১ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হওয়াতে নিঃসন্দেহে সাবেকি সোভিয়েতের শক্তি অনেকটাই কমে আসে। শক্তি কমে আসা রাশিয়ার ক্ষেত্রবিশেষে অপমান বা বিদ্রুপ হজম করা ছাড়া কোনো গতি ছিল না। কারণ তারা তখন ব্যস্ত ছিল নিজেদেরকে একটু গুছিয়ে নিতে। সমস্যা অন্য জায়গাতেও ছিল। যেমন সোভিয়েত ভেঙে যাবার সময় মিখাইল গর্বাচেভ পদত্যাগ করলে নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে বরিস ইয়েলৎসিনের অভিষেক ঘটে। তাঁর মতন ব্যক্তিত্বহীন রাষ্ট্রপতিকে আমেরিকাসহ পশ্চিমী দুনিয়া বাস্তবিকই হাতের পুতুল করে রেখেছিল। বলা বাহুল্য যে অমন একজন রাষ্ট্রপতির প্রভাবে সঙ্গতে কারণে রাশিয়া ক্রমশই পিছিয়ে পড়েছিল।
সোভিয়েত ভেঙে যে ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ইউক্রেন। এককথায় বলতে গেলে কৃষি, খনিজ ও গ্যাসে টইটুম্বর ইউক্রেন বিশ্বে অগ্রগণ্য দেশ। এই দেশকে বলা হয় ‘পৃথিবীর রুটির ঝুড়ি’। এইরূপ নামকরণ মূলত অস্বাভাবিক গমের ফলনের জন্যই। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভকে ‘মাদার অফ অল রাশিয়ান সিটিজ’ বলা হয়ে থাকে, যেহেতু এটি সবচেয়ে পুরনো রাশিয়ান শহর। ইউক্রেন ঘেঁষা ক্রিমিয়ার পেনিনসুলা বর্তমানে বহুল চর্চিত বিষয় এবং বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুও বটে। এই পেনিনসুলা বা বদ্বীপের একদিকে কৃষ্ণসাগর অন্যদিকে সি অফ আজভ। ক্রিমিয়ার শব্দটি অবশ্য তাতার শব্দ ‘কিরিম’ থেকে এসেছে, যার অর্থ প্রাচীর। সত্যি সত্যি ক্রিমিয়ার রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সম্পর্কের প্রাচীর তুলেছে। ১৯৪১ সালে নাৎসি জার্মানি এটিকে দখল করে নেয়। অনেকদিন রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে সোভিয়েত সেটিকে পুনঃরায় দখল মুক্ত করে। এই ক্রিমিয়ার পেনিনসুলা কাগজে কলমে স্বশাসিত প্রজাতন্ত্র হলেও পশ্চিম দেশগুলির মদতে এখানে ইউক্রেনের আধিপত্য বজায় ছিল। এখানে ইউক্রেনের আধিপত্যের পেছনে অন্য একটি কারণও ছিল সেটি হচ্ছে স্তালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত কমিউনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন ক্রুশ্চেভ। তিনি ছিলেন ইউক্রেনের মানুষ। তিনি তাঁর মেয়াদকালে ক্রিমিয়ার পেনিনসুলাকে ইউক্রেনের অংশ হিসেবে মনে করে তার কর্তৃত্ব ইউক্রেনের হাতেই তুলে দেন। রাশিয়ানরা আজও মনে করেন ক্রুশ্চেভ এই কাজটা একেবারেই ঠিক করেননি। তারা অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পরেও ইউক্রেন থেকে সেনা ফিরিয়ে নেয়নি। যদিও এই সেনার ব্যাপারে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যে চুক্তি হয় সেই চুক্তির বলেই কিন্তু সেনারা সেখানে থেকে গিয়েছিল। এখানে যে গণভোট হয় সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জণগণ রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবার পক্ষেই রায় দেন, সেটাই ছিল স্বাভাবিক কারণ। ২০০১ সালের লোকগণনা অনুযায়ী এখানকার জণগণের মধ্যে ৫৮.৩২ শতাংশ রুশ, ২৪.৩২ শতাংশ ইউক্রেনীয় ছিল। তারপরে কিন্তু লোকগণনার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় নি।
গণভোটের রায় রাশিয়ার পক্ষে যাবার পর থেকেই আমেরিকাসহ পশ্চিম ইউরোপের বেশ কিছু দেশ নড়েচড়ে বসে। তাদের গাত্রদাহের মূল কারণ তারা কিছুতেই রাশিয়াকে কৃষ্ণসাগরের ধারে কাছে ঘেঁষতে দিতে চায় না। এই টালবাহানার মধ্যে ২০১৪ সালের ১৬ মার্চ ক্রিমিয়ার পেনিনসুলাকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হলো বলে রাশিয়া সরকারিভাবে জানায়। সমস্যা এখানেই শেষ নয়। ইউক্রেন ঘেঁষা স্বশাসিত প্রজাতন্ত্র ডনবাস। ২০১৪ সালেই রাশিয়া, ইউক্রেন ও ডনবাসের মধ্যে একটি ত্রিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদিত হয়। যে চুক্তি মিনস্ক চুক্তি নামে খ্যাত। এই চুক্তিতে একটি শর্ত রাখা হয়েছিল যে খুব দ্রুত ডনবাসে একটি গণভোট হবে। পশ্চিম দেশগুলি ন্যাটোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে যেনতেন প্রকারণ সেই গণভোটে ইউক্রেনের নিশ্চিত হার আশঙ্কা করে করতে দেয়নি। তারা নানা অছিলায় ইউক্রেনে সৈন্য পাঠায়। রাশিয়াকে ক্রমাগত উত্তেজিত করতে থাকে যাতে রাশিয়া কোনো ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা কমিউনিস্ট সাম্রাজ্য ভেঙে যাবার সময় আমেরিকাসহ পশ্চিমের বেশ কয়েকটি দেশ দারুণভাবে উৎফুল্ল হয়ছিল। তারা তখন মনে করতে শুরু করে চিরকালের জন্য রাশিয়াকে পদদলিত করার সুযোগ এসে গেছে। তাদের ধ্যানধারণার ইন্ধন দেবার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন বরিস ইয়েলৎসিন। মনে রাখা দরকার বরিসের সময়কার রাশিয়া আর পুতিনের আমলের রাশিয়ার মধ্যে অনেক তফাৎ। নিঃসন্দেহে রাশিয়ার মেরুদণ্ড এখন অনেক শক্ত। পুতিনের আমলের রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও সামরিক উন্নতির ক্রমবর্ধমান গ্রাফ বাস্তবিকই আমেরিকা ও পশ্চিমের কয়েকটি দেশের চিন্তার কারণ। পশ্চিমের দেশ বলতে মূলত ব্রিটেন ও জার্মানি। এদের রাশিয়ার উপর বিরূপ থাকার কারণ আছে। জার্মানি কোনোদিনই ভুলবে না বার্লিনের ভাগাভাগি। নাৎসি বাহিনীর চূড়ান্ত ব্যর্থ মস্কো অভিযান। ক্রিমিয়ার পেনেনসুলায় তাদের পরাজয়। অন্যদিকে গ্রেট ব্রিটেনের ঘা এখনও শুকোয়নি। তারা কী করে ভুলবে চার্চিলের রাশিয়া জয়ের পরিকল্পনা ভেস্তে যাবার ইতিহাস!
এবার আসা যাক রাশিয়ার বক্তব্য প্রসঙ্গে। মনে রাখা দরকার পশ্চিম দেশগুলো এবং আমেরিকার প্রচার মাধ্যমের উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে রাশিয়ার বক্তব্য সঠিকভাবে বিশ্বের দরবারে না পৌঁছয়। তবে এখানে রাশিয়ার দাবিগুলি সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপনের প্রয়োজন আছে। রাশিয়া বলতে চায় যে, যা কিছু সমাধান তা পূর্বের চুক্তি (মিনস্ক) অনুসারে করতে হবে এবং ইউক্রেন থেকে ভাড়াটে সেনাদের অবিলম্বে সরিয়ে ফেলতে হবে। রাশিয়ার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়েও যথেষ্ট অভিযোগ আছে। তারা মনে করে যে ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির নির্বাচন সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে আমেরিকার মদতে হয়েছে। সর্বোপরি রাশিয়া কোনো অবস্থাতেই চাইবে না যে ইউক্রেন ন্যাটোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হোক, তাহলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সীমান্ত গোলমাল চিরস্থায়ী হবে।
এটা ঠিক যে আমেরিকা কারও ভালো চায় কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে, বিশেষ করে রাশিয়ার। তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে রাখা। রাশিয়া যে প্রকৃতির আশীর্বাদ ধন্য। তাদের প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ। এই প্রাকৃতিক সম্পদে বলিয়ান হয়ে তারা পৃথিবীর বহুদেশে তেল গ্যাস সরবরাহ করে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ শক্ত করে। যেমন তাদের পাইপ লাইনের মাধ্যমে সাইবেরিয়া থেকে তেল ও গ্যাস ইউরোপের বহুদেশে রপ্তানি হয়। এখানেও আমেরিকার নজর। তারা কিছুতেই এই তেল বা গ্যাস সরবরাহ সহজভাবে নিতে পারছে না। এই পাইপ লাইন কৃষ্ণসাগরের নীচ দিয়ে তুরস্ক হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পৌঁছয়। আমেরিকা পরিবেশ দূষণের ধুয়ো তুলে তুরস্কের উপর চাপ সৃষ্টি করেও এটি বন্ধ করতে পারেনি।
পরিশেষে বলা প্রয়োজন যে, যদি কোনো কারণে রাশিয়া ইউক্রেনের উপর আক্রমণ করে তার ফল কিন্তু বিশ্বের পক্ষে ভয়াবহ হতে পারে। সেক্ষেত্রে অবধারিতভাবেই তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হবে, ফলে বিশ্বের বাজারে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের তীব্র সঙ্কট দেখা দেবে। মনে রাখা প্রয়োজন যে রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ তেল উৎপাদকারী দেশ। রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ হলে ওপেকের পক্ষে চাহিদা মেটানো অসম্ভব। সেক্ষেত্রে তেলের দর নিশ্চিতভাবে ব্যারেল প্রতি ১২০ ডলার ছাড়িয়ে যাবে, যার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা অমূলক নয়।
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments