রবীন্দ্র কবিতার নিবিড় পাঠ
‘দেবতার গ্রাস’
মৃদুল শ্রীমানী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতাটি বহুপঠিত। কবিতার কাহিনী অংশটি এ রকম: জনৈক বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ মৈত্র মহাশয় সাগরসঙ্গমে পুণ্যস্নান মানসে যাবেন। তাতে গ্রামের লোক তাঁর সঙ্গ নিয়েছে। এমন একজন মানুষ মোক্ষদা। সে বালবিধবা। তার উপর একটি বালকের জননী। এই বালকটির নাম রাখাল। বালবিধবা মোক্ষদা পুত্রসন্তানের প্রসবকালে নানা জটিলতার সম্মুখীন হয়েছিল। এবং প্রসবের পরেও তার রোগভোগ চলেছিল অনেক দিন। রাখাল নামে সদ্যোজাত শিশুটি তখন মায়ের সহোদরা বোন অন্নদার স্তন্যে লালিত হয়ে জীবন ধারণ করে। মাসিই রাখালের কাছে মায়ের চেয়ে আপনার হয়ে ওঠে। এই মোক্ষদা আর তার বোন অন্নদা, গ্রামবাংলার এই দুটি মেয়ের নামের মধ্যে কি কোনো ইশারা দিয়েছেন কবি? গর্ভজাত সন্তানের দায়িত্ব ছেড়ে যে মেয়ে তীর্থ যাত্রার মধ্যে জীবনের সার্থকতা খুঁজে নিতে চাইল, সে মোক্ষদা। আর, সহোদরা বোনের রুগ্ন অপুষ্ট বাচ্চকে যে আপন স্তন দিয়ে বাঁচতে সাহায্য করল, ক্রমে তার প্রতিপালনের দায়িত্ব নিয়ে নিল, সে অন্নদা। দুটি মেয়ে, মোক্ষদা ও অন্নদা দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত পথে জীবন কাটায়। মোক্ষদা জীবনের হাতে সাংঘাতিক মার খেয়ে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে আশ্রয় খুঁজে পেতে চেয়েছে, আর অন্নদা অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তান জ্ঞানে বাঁচাতে চেয়েছে। এক বোন পারলৌকিক ভাবনায় ডুব দিয়েছে, আর অন্যজ বোনটি জীবনের অপার স্পর্ধায় মাতৃস্তন্যাবঞ্চিত পিতৃহারা একটি অপুষ্ট বাচ্চাকে ইহজাগতিক প্রশ্নে দাঁড় করাতে চাইছে। মোক্ষদার জীবনে অন্য কোনো আকর্ষণ না থাকায়, তার সমস্ত আগ্রহ গিয়ে পড়ে দেবদ্বিজে। মৈত্র মহাশয়ের কাছে সে প্রার্থনা করে যেন তাকে সাগর সঙ্গমে পুণ্যস্নানে একই তরণীতে আশ্রিত সহযাত্রিণী হিসেবে নিতে আপত্তি না করেন।
এদিকে রাখাল সম্বন্ধে তার গর্ভধারিণী মা হিসেবে মোক্ষদা নিশ্চিত ছিল যে সে মাসির কাছেই সুখে স্বচ্ছন্দে থাকবে। বালবিধবা সে। নিজের কোনো আর্থিক সংগতি বা সামাজিক প্রতিপত্তি না থাকায়, মৈত্র মহাশয়ের দলবলের সাথে তীর্থস্নানে যাবার সুযোগ পেয়ে সে কৃতার্থ ছিল। কিন্তু যাবার দিনে বাদ সাধল রাখাল। যাবার পূর্ব মুহূর্তে বালক আগেভাগে পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে নৌকায় উপস্থিত। মোক্ষদা তাকে নৌকায় দেখে সাংঘাতিক অপ্রস্তুত এবং ততোধিক বিরক্ত। রাখাল বালক মাত্র। কোনোদিন গ্রামের বাইরে কোথাও যেতে পায় নি। এখন বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ নৌকাযোগে সাগরে পুণ্য অর্জনে যাচ্ছেন এবং তাঁর দলবলের সাথে তার মা মোক্ষদা সামিল হয়েছে জেনে বালক ভেবে থাকতে পারে তার মা যখন একজন যাত্রী, তাহলে নিশ্চয় তারও স্থান সংকুলান সম্ভব। রাখালের মতো বয়সী বালকের মনস্তত্ত্ব বিচারের পরিস্থিতি মোক্ষদার ছিল না। মায়ের সাথে কিছুমাত্র কথাবার্তা না বলেই পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে সে নৌকায় জায়গা দখল করেছে দেখে মোক্ষদা অত্যন্ত বিরক্ত হয়। তার মনে হয়, তার বালক সন্তানটি মাসির সুপ্রচুর আদরে জেদি হয়ে উঠেছে।
সংসার ধর্মে বঞ্চিত, ইহমুখী কাজে কর্মে নিস্পৃহ মোক্ষদা নিজের পেটের ছেলেকে নিজের ধর্মপথে পা বাড়ানোর ক্ষেত্রে যেন পিছুটান বলে গণ্য করে রাখালকে নৌকা থেকে নেমে যেতে আদেশ দেয়। মৈত্র মহাশয় প্রবীণ ব্যক্তি। তিনি বালক রাখালের মায়ের সঙ্গে যাবার আর্তিটুকু স্নেহের চক্ষে ধরতে পারেন। ভদ্রতা করে তিনি রাখালকে তাঁর নৌকাযাত্রীর দলে থাকতে অনুমোদন করেন। মৈত্র মহাশয়ের এই ভদ্রতাসূচক ব্যবহার, শালীন আচরণ এবং ভারসাম্যপূৰ্ণ বাক্যবিন্যাস বিধবা মোক্ষদাকে এক অদ্ভুত সংকটে ফেলে। মোক্ষদা বিধবা এবং অসহায়া। সেকালের নিরিখে তার বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও একেবারেই না থাকার কথা। সুতরাং সমাজের চোখে সে পিছন সারির মানুষ। এমন একটা দুর্বল অবস্থানে থেকে সে পুরুষ মানুষের কণ্ঠে রূঢ় ও কঠিন ব্যবহার পেতেই অভ্যস্ত। মানুষ বলেই যে মানুষের কাছে একজন ভালো ব্যবহার পেতে পারে, এবং সেটাই যে অত্যন্ত স্বাভাবিক, এই মর্যাদাবোধ এবং অধিকার সচেতনতা মোক্ষদার মতো এক বালবিধবার গড়ে না ওঠারই কথা। রাখালের মতো বালককে মায়ের সঙ্গে পুণ্য স্নানে যেতে দেবার প্রশ্নে মৈত্র মহাশয়ের ভদ্র ও মার্জিত ব্যবহারের প্রতিদানে তার ঠিক কি ধরণের আচরণ করা উচিত, তা হিসেব করতে মোক্ষদা নিতান্ত অনভ্যস্ত ছিল। অশিক্ষিত, অমার্জিত মন নিজের আবেগটুকুও সুসংগত ভাবে প্রকাশ করতে পারে না। নিজেকে নিয়ে তার ভারি যন্ত্রণা। ভাষা আবেগের নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট আয়াস সাধ্য। এই আবেগ ও উদ্বেগের অপটু প্রকাশসূত্রে আমরা একটি ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটতে দেখব।
মোক্ষদা নিজের আবেগকে সুসংহত করতে না পেরে নিজের পেটের ছেলের উপর সাংঘাতিক বিরক্ত হয়। এবং যেন নিয়তি নির্দিষ্ট ভাবে বলে ওঠে ‘চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে’। কিন্তু এটা মোক্ষদার সচেতন ও সজাগ চিন্তাপ্রসূত কোনো বাগবিন্যাস নয়। একেবারে অমার্জিত মনের অনভ্যস্ত ভাষা সম্পদের বিকৃত ব্যবহারের ফল মাত্র। ভাষার পিছনে যে মনের কার্যকরী ভূমিকা থাকে, অভ্যাস ও চর্চার অভাবে তাকে স্পষ্ট করে পাওয়া যায় না। তাই মনের দিক থেকে দীন ব্যক্তির ভাষা সর্বদা তার চিন্তার বাহন নয়। অথবা, তার চিন্তা ক্রিয়াটি অপরিসর জীবনের খাতে বইতে গিয়ে অসাড় ও অপটু। কিন্তু উচ্চারিত সেই শব্দগুচ্ছই তার নিজের কানে যায়, আর যায় সকলের সাথে প্রবীণ মৈত্র মহাশয়েরও।
মোক্ষদা যেন অজ্ঞ, অক্ষম, অমার্জিত পল্লীজননী, কিন্তু অজ্ঞ অশিক্ষিত হলেও সে জননী তো বটে। আর রাখাল তো তার নাড়ীছেঁড়া ধন। নিজের অকালবৈধব্য, সন্তান প্রসবের সূত্রে দীর্ঘমেয়াদি রোগযন্ত্রণা, অপুষ্টি ও নিরানন্দ জীবন সত্ত্বেও সে তো একটা মা। মায়ের মনে পড়ে যায় ‘চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে’ কথাটির অর্থ কি! সাথে সাথে মোক্ষদা নিজেকে সংযত করে ও পুত্রকে বুকে চেপে ধরে ইষ্ট স্মরণ করে নিতান্ত দুর্ভাগ্য হতে পরিত্রাণ চায়।
এখানে নিয়তির আর এক চক্রান্ত দেখা দেয়। যে জিনিস তুচ্ছ, যার কোনো আপাতমূল্য নেই, গণস্মৃতিতে তাও কত গুরুত্ব পায়! গণস্মৃতি, গণমন অনেক সময়েই যুক্তিশৃঙ্খলার ধার ধারে না। কার্য কারণ সম্পর্কের ভিত্তিতে তলিয়ে দেখে না। এক আদিম জীবন প্রণালীর অন্ধকারময়তা আঁকড়ে তার পথ চলা। অসাবধানে বলে ফেলা মোক্ষদার মুখের কথাটি পল্লীর অমার্জিত অসংস্কৃত লোকের স্মৃতিতে অস্পষ্ট হয়ে থেকে যায়, কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় না। আমরা দেখব, নিয়তির নিগূঢ় পরিহাসে এই নিশ্চিহ্ন না হয়ে যাওয়া স্মৃতিটুকু কত বড় ও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এবং লোকের মনের ভিতরে থাকা আদিম ভয়কে কেন্দ্র করে কি বিপুল আকার নেবে।
আদিম সমাজের অভ্যাসগুলিতো মানুষের মধ্যে সহজে মরে না। কেননা, দীর্ঘদিনের অভ্যাস সেগুলি। সভ্যতা তো সেই অর্থে অনেক অর্বাচীনকালের বিষয়। চিন্তায় যুক্তিশৃঙ্খলা, কার্যকারণ সম্পর্ক বিচার, ও বিবেচনা বোধের শাসন এসেছে অনেক পরে। গণস্মৃতিতে রয়ে যায় পুরানো অভ্যাস। নেড়ে ঘেঁটে দেখা যাবে তার শিকড় বহু গভীরে। সংকটের সময়ে, জীবন নিয়ে টানাটানির দিনে, সভ্যতার সেই স্বল্পদিনের শিক্ষা হারিয়ে যায়। জেগে ওঠে আদিম অভ্যাস। সে অভ্যাসের চালিকাশক্তি হল ভয়। সভ্যতার চালিকাশক্তি হল জ্ঞান, যুক্তি, পরিমিতি। আদিমতার চালিকা শক্তি ভয় ও হিংসা। সভ্য মানুষের সামনে ঈশ্বর এক সুসমঞ্জস, আলোকময় মূর্তিতে বরাভয় মুদ্রায় অবস্থিত। আদিম মানুষের সামনে ঈশ্বরও আদিম, লোলজিহ্ব ও ভয়ঙ্কর মূর্তিতে দাঁড়িয়ে। সভ্যজগতে ঈশ্বরের সাথে ভক্তের সম্পর্ক পিতা পুত্রের, প্রেমিক প্রেমিকার, তার রস বাৎসল্য ও মধুরে মেশানো, কখনো বা সখ্য, দাস্য বা শান্ত ভাবেরও সম্পর্ক। কিন্তু আদিম মনে সম্পর্কটা ভয় দেখানোর, আক্রমণের ও বিনাশ করার। ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতায় সংকটের কালে এই আদিম চেহারাটা বেরিয়ে এল। পরের কথাটা সবাই জানেন।
মৈত্র মহাশয় এই কাহিনীতে একটি ট্র্যাজিক চরিত্র। তিনি গ্রামের সমাজপতি, তিনি দীন দুঃখীর আশ্রয়স্থল। তিনি ব্রাহ্মণ। হয়তো সেই সূত্রে তিনি খানিকটা শিক্ষিতও বটে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কি আছে না আছে তার চাইতে বড় কথা, সামাজিক প্রতিপত্তি ও আর্থিক নিরাপত্তার কারণে, তাঁর অবসর অনেক বেশি। সেই সুপ্রচুর অবসর এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা তাঁকে ভদ্র হতে প্রাণিত করে। কিন্তু সংকটের দিনে তাঁরও ভিতর থেকে একটা আদিম সত্ত্বা বেরিয়ে আসে, যে এমন কি মায়ের কোল থেকে ছেলেকে চিনিয়ে নিতে চায়। রাখালকে তো ফেলেই দেওয়া হল। মায়ের কোল থেকে বালককে ছিনিয়ে নিতে পেশিবহুল কঠিন চেহারার মাঝি মাল্লাদের তো বেশি সময় লাগার কথা নয়। আর উত্তাল সাগরে বালকের তলিয়ে যেতেও বেশি সময় লাগার কথা নয়। বালক তার শেষ কথাটি বলেছিল ‘মাসি’। ব্রাহ্মণের মনে সেই শব্দটিই মনুষ্যত্বকে ধাক্কা দিয়ে তোলে। নিজের জীবন বিপন্ন করেও তিনি রাখালকে উদ্ধার করতে সমুদ্রে ঝাঁপ দেন।
প্রশ্ন হল, ব্রাহ্মণ মৈত্র মহাশয় তাঁর নৌকার মাঝি মাল্লাদের প্রথমেই নিরস্ত করতে পারেন না কেন, আর কেনই বা তিনি রাখালকে তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সমুদ্রে ফেলে দেবার পরে নিজেকে খুঁজে পান? আমাদের দেশে জাতপাতে বিভক্ত সমাজে ব্রাহ্মণ পরিচয়ে লোকেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিম্নবর্গের মানুষদের হেয় জ্ঞান করেছে। সর্বদা অস্পৃশ্যতা ততো কঠিন আকার না নিলেও, আহার বিহারে যথেষ্ট সাবধানতার সাথে ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলা ছিল এই সেদিনেরও রীতি। এই যে ভেতরকার দূরত্ব, এটাই দু পক্ষকে দুর্বল করেছে। বিজ্ঞ মানুষ হাতে কলমে কাজ করার অভাবে অভিজ্ঞ হতে পারেন নি। তাঁদের বিদ্যা পুঁথিগত হয়ে থেকে অকার্যকর রয়ে গিয়েছে। আর পরিশ্রমী লোকে জ্ঞানচর্চার অভাবে কার্যকারণ শৃঙ্খলা বুঝতে পারে নি। ফলতঃ সমাজে জ্ঞানবিজ্ঞান আলোকমুখীনতার চর্চা মার খেয়ে গিয়েছে। তারই জায়গাটা নিয়েছে কুসংস্কার আর প্রাচীন অভ্যাসের অন্ধ অনুবৃত্তি। উদার মনুষ্যত্বের আহ্বান আসলো অনেক পরে। পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান ও সাহিত্য দর্শনচর্চার সূত্রে তা অল্পে অল্পে বিকশিত হয়ে উঠবে। কিন্তু, তার আগে? তার আগে গ্রামবাংলা জুড়ে অন্ধকারের রাজত্ব। সেখানে কার্যকারণ শৃঙ্খলাবোধ, যুক্তি ও উদারনৈতিক মনুষ্যত্বের আহ্বান বড়ো দুর্বল। ওইখানেই ‘দেবতার গ্রাস’। দেবতা ‘প্রাণসখা’ হয়ে উঠবেন, ‘প্রভু এবং প্রিয়’ হয়ে উঠবেন আরো অনেক পরে। তার জন্য বহুযুগের মনীষী বিনিদ্র রাত কাটিয়ে তপস্যা করেন।
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments