প্রবাসে পুজোর আড্ডা
টিনা চক্রবর্তী
কথায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। কিন্তু তার মধ্যে বাকি সব উৎসবকে ছাড়িয়ে যে বিশেষ দিনগুলোর জন্য বিশ্বের আপামর বাঙালি সারা বছর অপেক্ষা করে বসে থাকে, বলাই বাহুল্য তা আমাদের সবার প্রিয় দুর্গাপুজো। আর দুর্গাপুজো কবেই বা ভৌগোলিক সীমানা আর কালের গণ্ডি মেনেছে! সারা বিশ্বের যে প্রান্তে বাঙালি আছে সেখানে আর কিছু না হোক দুর্গাপুজোর আয়োজন যে হবেই, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাহ্যিক চাকচিক্যে দেশের পুজোর সঙ্গে হয়তো প্রবাসের পুজোর তুলনা করা সমীচীন নয়, কিন্তু আবেগ, একাত্মতা, ভক্তি এবং সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা যদি দেখতে হয়, তাহলে এই কথা বলাটা মোটেই অতিরঞ্জিত হবে না যে, এই সব বিষয়ে প্রবাসের দুর্গাপুজো দেশের থেকে এগিয়ে ব–ই পিছিয়ে নেই। আর সারা বিশ্বে যত দুর্গাপুজোর আয়োজন প্রবাসী বাঙালিরা করেন, কানাডার গ্রেটার টরন্টো এরিয়ার বিভিন্ন দুর্গাপুজোগুলো তাদের মধ্যে এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছে, তা আজ সর্বজনবিদিত। শেষ দুটো বছর কোভিডের জন্য জাঁকজমক একটু স্তিমিত থাকলেও এই বছর আবার ধুমধাম করে স্বমহিমায় আয়োজিত হয়েছে টরন্টোর সব দুর্গাপুজো। তবে কিনা প্রবাসের বাকি সব দুর্গাপুজোর মতোই টরন্টোতেও বেশিরভাগ ভাগ পুজো হয় উইকএন্ড–এ। যেমন ‘আগমনী’, ‘আমার পুজো’, ‘বঙ্গীয় পরিষদ টরন্টো এবং প্রবাসী বেঙ্গলি কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন’, ‘বঙ্গ পরিবার’, ‘ডারহ্যাম দুর্গোৎসব’, ‘সাগরপারে দুর্গাপুজো’, ‘ওয়াটারলু দুর্গোৎসব’, ‘কিংস্টন দুর্গাপুজো’— এরা এবার উইকএন্ড–এ ব্যবস্থা করেছেন মা দুর্গার আবাহনের। আবার কিছু সংস্থা আছেন যারা পুজোর দিনগুলিতেই পুজো করছেন। যেমন ‘বাংলাদেশ কানাডা হিন্দু মন্দির’, ‘ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ’, ‘টরন্টো দুর্গাবাড়ি’, ‘টরন্টো কালীবাড়ি’, ‘বেদান্ত সোসাইটি অফ টরন্টো’, ‘হিন্দু ধর্মাশ্রম’।
এছাড়াও আছে কিছু বাড়ির দুর্গাপুজো যেমন ‘দত্ত বাড়ির দুর্গোৎসব’, ‘চক্রবর্তী পরিবারের দুর্গাপুজো’, ‘ধর বাড়ি দুর্গাপুজো’, ‘আমাদের বাড়ির পুজো’ ইত্যাদি। ভিড় করে আসা আবেগ নিয়ে সব্বাই মিলে একসঙ্গে এই প্রবাসে প্যান্ডেল বানানো থেকে শুরু করে ভোগের আয়োজন, আলপনা দেওয়া থেকে মণ্ডপ সজ্জা, পুজোর কটা দিন হাতে হাত মিলিয়ে একটা পরিবারের মতো সবাই সব কাজটা সম্পন্ন করে। পুজোর কোনও খুঁটিনাটি কিন্তু কোথাও বাদ পড়ে না। কলাবউ স্নান, অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধিপুজো এবং সিঁদুরখেলা সবটাই কিন্তু ধরা পড়ে এখানে। এই যে এতো সুচারু আয়োজন, তার মাঝে সাংস্কৃতিক মনোরঞ্জনেরও কোনও খামতি থাকে না। প্রতি বছর বাংলা থেকে বিভিন্ন স্বনামধন্য শিল্পীরা আসেন নানারকম অনুষ্ঠান উপহার দিতে। এছাড়াও প্রবাসী বাঙালিরাও নিজেরা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন এবং তাতে যোগদান করেন। এত কাজ এবং আনন্দের মাঝে বাঙালির যে বিষয়টা না হলে বাঙালিত্বটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায় সেই রসনা তৃপ্তির ব্যবস্থাও থাকে ভরপুর। বিভিন্ন বাঙালি খাবারের স্টল এইসময় পুজোর আশপাশে থাকে যেখানে পুজোর কটাদিন মনের ও জিভের তৃপ্তি করতে পারা যায়। মানে এক কথায় বলতে গেলে, টরন্টোতে যেন একটুকরো বাংলা বিরাজ করে এই পুজোর কদিন। নিজের দেশ ও পরিবারের বাকি লোকজনের থেকে দূরে থাকার দুঃখ নিমেষে উড়ে যায় অচিনপুরে এই পুজোগুলো হয় বলেই। পরিশেষে, এই সব পুজোর আয়োজক সংস্থাদের পাশাপাশি আরও একটি সংস্থার নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। টরন্টোতে বাংলার আর্ট ও কালচার প্রচারের একটি নন প্রফিট অর্গানাইজেশন হল ‘প্রবাসে বাঙালি আড্ডা’। তারা সারা বছর ধরেই বিভিন্ন কর্মকান্ড সম্পন্ন করে থাকে। যেমন চ্যারিটি শো, সুদূর প্রবাস থেকে বাংলার দুঃস্থ মানুষদের সাহায্য করা ইত্যাদি। টরন্টোর এই বিভিন্ন পুজো সংস্থাগুলোর বহু মানুষ এই ‘প্রবাসে বাঙালি আড্ডা’–র পরিবারের সদস্য। ‘প্রবাসে বাঙালি আড্ডা’ ধন্যবাদ জানায় সমস্ত পুজোর আয়োজকদের। কুর্নিশ জানাই তাদের এই ঐকান্তিক প্রচেষ্টাকে। এই সব আয়োজকদের জন্যই পুজোর কয়েকদিন কিছুটা হলেও ভুলে থাকা যায় দেশ ছেড়ে দূরে থাকার কষ্ট আর সারা বছরের কর্মব্যস্ত প্রবাস জীবনের একঘেয়েমি। প্রতিবছর এইভাবেই সম্পন্ন হোক প্রবাসের পুজোগুলো, ক্রমশ এগিয়ে যাক আরও বৃহৎ স্তরে এবং পরবর্তী প্রজন্মের মনে রোপিত হোক এই নস্টালজিয়ার বীজ। ইউনেসকো দুর্গাপুজোকে কালচারাল হেরিটেজ ঘোষণা করেছে এই বছর। সব বিদেশিরা এই প্রবাসী বাঙালিদের পুজো দেখে বুঝতে পারবে এই হেরিটেজ তকমার যথার্থতা। উমা আসুক প্রতিবার সমাজ ও মনের অসুর বধ করতে।
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments