শ্বেতশুভ্র অসলো
ডঃ সঞ্জীব রায়
স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সব রাজধানীগুলির মধ্যে অসলো হল প্রাচীনতম, ১০৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। একসময় এটি জলদস্যুদের শহর হিসাবে কুখ্যাত ছিল। ১৬২৪ সালে অগ্নিকান্ডে পুরো শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। সেইসময় নরওয়ের রাজা চতুর্থ ক্রিশ্চিয়ানা ডেনমার্কের সহায়তায় শহরটির সংস্কার করেন। তখন থেকে শহরটি ডেনমার্কের অধীন ক্রিশ্চিয়ানা নামে পরিচিত ছিল। এই ক্রিশ্চিয়ানাই ছিল নরওয়ের রাজধানী। ১৯০৫ সালে নরওয়ে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯২৪ সালে ক্রিশ্চিয়ানা শহরের তিনশোতম বার্ষিক উদযাপন অনুষ্ঠানে ঠিক হয় ১৯২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে শহরটি তার পুরানো নাম ‘অসলো’ ফিরে পাবে।
প্রথমবার অসলো আসা মে মাসের শেষের দিকে। সবুজে ভরে যাওয়া শহরের অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য স্বভাবতই মনকে প্রচণ্ডভাবে আকৃষ্ট করেছিল। মেঘমুক্ত রৌদ্রোজ্জ্বল নীল আকাশ আর বরফাবৃত ফিয়রডের (fjord) সৌন্দর্য প্রাণভরে উপভোগ করেছিলাম। ছোটখাটো এই শহরে আট বর্গ কিলোমিটার জুড়ে পার্ক এবং প্রায় সাড়ে তিনশো লেক আছে। অসলোকে ঘিরে যে ফিয়রড তার দৈর্ঘ্য প্রায় একশো কিলোমিটার।
দ্বিতীয়বার অসলো এলাম মার্চ মাসের একেবারে গোড়ায়। সমস্ত শহরে তখন সবুজ উধাও। সে জায়গায় সব কিছু ঢেকে রেখেছে শুধু বরফ আর বরফ। রাস্তাঘাট, বাড়ির ছাদ, গাড়ির ছাদ, লেক, ফিয়রড সব তখন বরফের চাপে বিপন্ন। এই শ্বেতশুভ্র অসলোর সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। এই দুই মরসুমের তফাৎটা একেবারে চমকে দেবার মতন।
অসলোর সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গা হল ভিজিল্যান্ড পার্ক। প্রথমবারে দেখা সবুজ গাছপালা, পুকুর নিয়ে বিস্তীর্ণ এই প্রান্তর বাস্তবিকই ছিল ভালো লাগার জায়গা, যেন পিকনিকের আমেজ। এবারে সব কিছু গ্রাস করেছে বরফ। এও এক অসাধারণ সৌন্দর্য! পার্কের ঠিক মাঝখানে গুস্তব ভিজিল্যান্ডের স্ট্যাচু। বরফে স্ট্যাচুর অর্ধেক ঢেকেছে। গুস্তব ছিলেন বিশ্বখ্যাত শিল্পী।
পাথরের উপর বা ব্রোঞ্জের ওপর তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা মানুষের আবেগ, ক্রোধ, ভালবাসা, যন্ত্রণা প্রভৃতি কিন্তু সমস্ত ঋতুতে অমলিন। এই পার্কে যে শিল্পকর্মটি সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে সেটি একটি স্তম্ভ যেটি বিশ্বের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ একখন্ড গ্রানাইটের উপর ভাস্কর্য। এতে ফুটে উঠেছে মানুষের যন্ত্রণার ছবি, যাকে প্রকৃতিও সমবেদনা জানায়।
এছাড়াও অসলোর দ্রষ্টব্য স্থানগুলি হল সিটি সেন্টার যেখান থেকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়। এইখান থেকেই মাদার টেরিজা, মালালা ইউসুফজাই, কৈলাস সত্যার্থী নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে অসলো আইন বিশ্ববিদ্যালয়, ন্যাশনাল থিয়েটার, পার্লামেন্ট হাউস। এই সব জায়গা ঘিরে শুধুই বরফ।
অতি সন্তর্পণে পা ফেলতে হয়, অন্যমনস্ক হলেই পা পিছলে যাবার সম্ভাবনা। সবশেষে অসলো বন্দর দেখে তো অবাক। জাহাজগুলি অধিকাংশই আটকে রয়েছে। বরফ না গললে জাহাজ নড়তে পারবে না। মনে পড়ে গেল প্রথমবার ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন থেকে জাহাজে অসলো আসার কথা।
সব ছবি: লেখক
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments