প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি
নায়াগ্রা জলপ্রপাত
কমলা আদক

‘যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে সহস্র শৈবাল দাম বাঁধে আসি তারে।’
সেই কদর্য্য রূপ দেখায় অভ্যস্ত আমরা সবাই। কিন্তু যে নদী খাদে পড়ে, তার কী হাল হয়? নদীর কি গরিমা বাড়ে? নাকি অন্য কিছু, তা বুঝতে হলে নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে হবে। নায়াগ্রা নদী খাদে পড়ে স্রোতে এনেছে চমক, অপরূপ মোহময়ী হয়ে বিরাজমান হয়েছে এখানে।
পাহাড়ে মাঝেমধ্যে উঁচু স্থান থেকে নীচে জল পড়তে দেখা যায়। এগুলিকে আমরা সাধারণভাবে ফলস বা জলপ্রপাত (পাহাড়ী ঝর্ণা) নামে জানি এবং সচরাচর তাই দেখতে অভ্যস্ত মানুষ। কিন্তু পাথরের উপর চলমান এক খরস্রোতা নদীর সামনে বিরাট সুগভীর এক খাদ, পাহাড়ের ভয়ঙ্কর এক ফাটলের জন্য। আর এই অবস্থায় নদীর কী পরিণতি হয় তা নায়াগ্রায় এলে বোঝা যাবে।

নায়াগ্রা কথার অর্থ জলরাশির বজ্রধ্বনি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে জলপ্রপাতটি পর্যটকদের কাছে একটি অতীব আকর্ষণীয় স্থান। মূলত পাশাপাশি অবস্থিত তিনটি ভিন্ন জলপ্রপাত (হর্সশু ফলস, আমেরিকান ফলস ও ব্রাইডাল ভিল ফলস) নিয়ে নায়াগ্রা জলপ্রপাত গঠিত। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত। তাই উভয় দেশ থেকে নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখা যায়। একটি ব্রীজ (রেনবো ব্রীজ) দ্বারা দেশ দুটি সংযুক্ত। অবশ্য দুই দেশের পাসপোর্ট না থাকলে এপার থেকে ওপারে যাওয়া যায় না।  এই জলপ্রপাতে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৫ লাখ গ্যালন জল নীচে পতিত হয়, বিশাল এক ফাটলের গহ্বরে যা দিয়ে জল বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আমেরিকার মাটিতে পা দিতেই মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় ভূগোল বইয়ে পড়া নায়াগ্রা জলপ্রপাতের কথা। তার নয়নাভিরাম দৃশ্য চাক্ষুষ করতে মন উদ্বেলিত হয়ে উঠল। মিনিয়াপোলিশ (আমার বড় ছেলের বাসস্থান) থেকে উড়ানে আটলান্টা হয়ে বাফেলো বিমান বন্দরের টিকিট কাটা হল। বাফেলো থেকে মাত্র ২৭ কিলোমিটার দূরে এই নায়াগ্রা।

দু’দিন ধরে বিস্ময় নয়নে অপরূপাকে দেখার অভিপ্রায় ছিল আমাদের। কিন্তু আটলান্টা পৌঁছে ঘটল এক বিপত্তি। বাফেলো যাওয়ার উড়ান বাতিল হয়ে গেল। ২৪ ঘন্টার আগে অন্য কোন প্লেনের টিকিট পাওয়া গেল না। তাই সময় নষ্ট না করে সারাদিন ধরে ঘুরে নিলাম ‘জর্জিয়া অ্যাকুয়ারিয়াম’। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বিখ্যাত অ্যাকুয়ারিয়াম এবং আটলান্টার মধ্যে অবস্থিত। কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা সামুদ্রিক পরিবেশে অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে তিমির উপস্থিতি প্রমাণ করে দেয় অ্যাকুয়ারিয়ামটি কত বিশাল আকারের, কি বিস্তূর্ণ তার পরিসর। পরদিন সঠিক সময়ে বাফেলো এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম। নায়াগ্রা হোটেলে পৌঁছে, মালপত্র রেখে জলপ্রপাত দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। রাতে পথ শুনশান, তবে আকাশ পরিস্কার ও মেঘমুক্ত, তার মধ্যে নির্ভয়ে ছুটে চলেছি ফলসের দিকে। সুযোগ যখন এল তবে আর দেরী কেন? কাছে এসে দেখি কি অপূর্ব তার শোভা! রাতের লাইট শোতে নায়াগ্রা রঙিন আলোয় ঝলমল করছে। তার সঙ্গে কি নিরলস অকৃত্রিম গর্জন, পরিবেশকে মনোহারিনী করে রেখেছে।

দুনিয়াকে জানান দিয়ে যাচ্ছে তার রং আর শব্দসহ বিরাজমান অবস্থান। সকালে ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে গেলাম নানান জায়গা থেকে নায়াগ্রার সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে। দু’দিনের দর্শন একদিনেই সেরে নিতে হবে যে। প্রথমে গেলাম ‘কেভ অবদী উইন্ড’, বিশেষ ধরণের চটি ও রেনকোট পরে। লিফ্টের সাহায্যে অনেকটা নীচে নেমে গেলাম, তারপর লোহার সিড়ি বেয়ে একটু উপরে উঠে নায়াগ্রার মনোরম নৈসর্গিক দৃশ্যাবলী চাক্ষুষ করতে থাকলাম। প্রায় ১০০ ফুট উপর থেকে বিপুল আকারে অবিরাম গতিতে জলধারা পতিত হচ্ছে। আর আমরা পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি। এলোমেলো হাওয়ায় জলকণার মেঘেবৃষ্টির মত ভিজে যাচ্ছি।

শীতে থরথর করে কাঁপছি, তবুও খুব ভালো লাগছে। এই এলাকার বিস্তূতি অনেক, তাই ট্রলি ট্রেনে চেপে তাড়াতাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এরপর ওই ট্রেনে চেপে ‘মেড অফ দি মিষ্ট’ (কুয়াশা কুমারী) এর দিকে রওনা দিলাম। এখানে রেনকোট পরে লঞ্চে উঠতে হয়। লঞ্চ নিয়ে চলল এক ভয়াবহ জায়গায়, কানাডিয়ান ফলস আর আমেরিকান ফলসের মাঝে। এখান থেকেই দু’দেশের মিলনস্থলে বৃহৎ হর্সশু ফলস দেখা যায়। জলপ্রপাতে সৃষ্টি হচ্ছে মিষ্ট বা কুয়াশা, ছড়িয়ে পড়ছে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মত। তাতে সূর্যের আলো পড়ে তৈরি হচ্ছে কত রামধনু। এত মিষ্ট, এত রেনবো (রামধনু), অভূতপূর্ব মনোরম দৃশ্য। দেখে তৃপ্তি মিটছে না, ফলসের নীচে পৌঁছেও। এবার আকাশপথে হেলিকপ্টার চেপে সমস্ত ফলসগুলি আরও সুন্দর ভাবে দেখে নিলাম। বিভিন্ন অবজার্ভেটরি টাওয়ার থেকে নায়াগ্রার এদিক ওদিক বিষ্ময় নয়নে দেখে যাচ্ছি ক্লান্তিহীন ভাবে। অথচ শীতে এ বিশাল জলরাশি নিস্পন্দ, বরফে পরিণত হয়ে যায়।
প্রকৃতি তোমার কি অপরূপ সৃষ্টি যা যুগ যুগ ধরে মানুষের মন আনন্দে ভরিয়ে দিতে পারে। একদিনে দেখা তোমার অপরূপ সৌন্দর্য্য আমারও মনে অমর হয়ে থাকবে, নায়াগ্রা।

সব ছবি:‌ লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *