ভারতবন্ধু নেলসন ম্যান্ডেলা
অংশুমান চক্রবর্তী

নেলসন ম্যান্ডেলা। আজীবন লড়াই করেছেন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে। ২৭ বছর বন্দি ছিলেন কারাগারে। অবশেষে পেয়েছিলেন মুক্তি। মনে করা হয়, দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে তাঁর মুক্তির দিনটি ছিল সবচেয়ে বড় ঘটনা। কারাগার থেকে বেরিয়ে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের পুরোধাপুরুষ জনসাধারণের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি কোনো মহান ব্যক্তি হিসেবে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে নেই। দাঁড়িয়ে আছি আপনাদের একজন সাধারণ সেবক হিসেবে। দিনটি ছিল ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। 

ফিরে যাওয়া যাক অতীতে। কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গদের নির্মম আচরণ সহ্য করতে পারেননি নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনি নিজে ছিলেন কালো চামড়ার মানুষ। একদিন ঝাঁপিয়ে পড়েন আন্দোলনে। ১৯৬২ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে ও অন্তর্ঘাতসহ নানা অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। বেশিরভাগ সময় তিনি ছিলেন রবেন আইল্যান্ড দ্বীপ, পলসমুর কারাগার ও ভিক্টর ভার্স্টার কারাগারে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চপের মুখে এবং বর্ণবাদী গৃহযুদ্ধের আতঙ্কে রাষ্ট্রপতি এফ. ডব্লিউ. ডি ক্লার্ক তাঁকে কারামুক্ত করার নির্দেশ দেন।

কেমন ছিল তাঁর প্রারম্ভিক জীবন?
জন্ম ১৯১৮ সালের ১৮ই জুলাই। দক্ষিণ আফ্রিকার সেই সময়ের কেপ প্রদেশের মভেজো গ্রামে। বাবা গাদলা হেনরি মপাকানইসা ম্যান্ডেলা মভেজো গ্রামের শাসকের উপদেষ্টা ছিলেন। একটা সময় হন শ্বেতাঙ্গ ম্যাজিস্ট্রেটের চক্রান্তের শিকার। চাকরি চলে যায়। তারপর তাঁরা সপরিবারে কুনু গ্রামে বসবাস শুরু করেন। পেয়ে যান নতুন কাজ। প্রসঙ্গত, নেলশন ম্যান্ডেলার বাবার ছিল চার স্ত্রী, চার পুত্র এবং নয় কন্যা। প্রত্যেকেই থাকতেন আলাদা গ্রামে। ম্যান্ডেলার মা নোসেকেনি ফ্যানি ছিলেন গাদলার তৃতীয় স্ত্রী।

ম্যান্ডেলার বাবা-মা দুজনেই ছিলেন অশিক্ষিত। সাত বছর বয়সে ম্যান্ডেলা মেথডিস্ট বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তিনি তাঁর পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। বিদ্যালয়ের এক দিদিমণি তাঁর নাম রাখেন নেলসন।
এরপর হঠাৎ জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। ম্যান্ডেলার বয়স যখন ৯, তখন তাঁর বাবা মারা যান। শুরু হয় সংগ্রাম। পাশাপাশি চলতে থাকে পড়াশোনা। জানতে থাকেন আফ্রিকার ইতিহাস সম্পর্কে। ধীরে ধীরে লাভ করেন উচ্চশিক্ষা। সেইসঙ্গে চালিয়ে নিয়ে যান নৃত্য, অভিনয়ের চর্চা।
এইসময় তাঁর বন্ধুরা জড়িয়ে পড়েন আফ্রিকা ন্যাশনাল কংগ্রেসের সঙ্গে। তখনও রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হননি ম্যান্ডেলা। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বছরের শেষে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে খাবারের মান নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি সংসদের ডাকা আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়েন। এর ফলে ফোর্ট হেয়ার থেকে তাঁকে চলে যেতে বলা হয়। রাখা হয় শর্ত, ছাত্র সংসদে নির্বাচিত সদস্য হতে পারলেই ফিরতে পারবেন। নাহলে নয়। ফিরে আসেননি ম্যান্ডেলা। কিছুদিন পর খনিতে নেন প্রহরীর কাজ। পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা চালু রাখার জন্য ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকার দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের ভর্তি হন। পরে উইটওয়াটার্সরান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শুরু করেন। একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান শিক্ষার্থী হিসেবে। সেখানে তিনি হন বর্ণবাদের শিকার। এই সময় উদারপন্থী ইউরোপীয়, ইহুদি এবং ভারতীয় ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়। এই বন্ধুরা পরে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় কর্মী হিসেবে অংশ নেন। রাজনীতির সঙ্গে কিছুটা জড়িয়ে গিয়ে ম্যান্ডেলা। ১৯৪৩ সালের আগস্ট মাসে বাসের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে ধর্মঘটে যোগ দেন। কিছুদিন পরে নাম লেখান আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে। অংশ নিতে শুরু করেন বিভিন্ন আন্দোলনে। এইসময় তাঁর পরিচয় হয় ইভলিন মেসের সঙ্গে। এই মহিলা ছিলেন প্রশিক্ষণাধীন নার্স ও এএনসি কর্মী। দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে সম্পর্ক। ১৯৪৪ সালের অক্টোবরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরে ম্যান্ডেলা আরও দুটি বিবাহ করেন।

১৯৪৭ সাল। এএনসির ট্রান্সভাল প্রদেশ শাখার নির্বাহী কমিটিতে নির্বাচিত হন ম্যান্ডেলা। দায়িত্ব পালন করেন আঞ্চলিক সভাপতি সি. এস. রামোহানোর অধীনে। 
১৯৪৮ সাল। দক্ষিণ আফ্রিকার সাধারণ নির্বাচনে কেবল শ্বেতাঙ্গদের ভোট দেওয়ার অনুমতি ছিল। নির্বাচনে জয়লাভ করে দানিয়েল ফ্রঁসোয়া মালানের নেতৃত্বে আফ্রিকানদের নিয়ন্ত্রিত হেরেনিজ নাসিওনালে পার্টি। এই দলটি ছিল বর্ণবাদে বিশ্বাসী এবং বিভিন্ন জাতিকে আলাদা করে রাখার পক্ষপাতী। এইসময় ম্যান্ডেলা সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তাঁর প্রভাব। সক্রিয় হয়ে পড়েন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে। কিছুটা হলেও প্রভাব পড়ে তাঁর পড়াশোনায়। অকৃতকার্য হন উইটওয়াটার্সর্যা ন্ডে শেষ বছরে। যদিও এর ফলে তিনি মনমরা হন না।সরে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেওয়ার পরিকল্পনা থেকে।
একটা সময় কমিউনিজমের প্রতি ছিল ম্যান্ডেলার ভুল ধারণা। পরবর্তী সময়ে তিনি মার্ক্স, লেনিনের রচনাবলি পড়তে শুরু করেন। গ্রহণ করেন মার্ক্সবাদী দর্শন।
১৯৫২ সাল। এএনসি ভারতীয় এবং কমিউনিস্টদের নিয়ে তিনি প্রকাশ্যে বিরোধিতার প্রস্তুতি নেন। স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের লক্ষ্যে জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক বোর্ড গঠন করেন। 

২২ জুন, ডারবানে এক মিছিলে ম্যান্ডেলা দশ হাজার লোকের এক সমাবেশ সহযোগে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। সামান্য সময়ের জন্য মার্শাল স্কোয়ার কারাগারে বন্দি রাখা হয়। এই ঘটনায় সারা দেশে ব্যাপক খ্যাতি পেয়ে যান ম্যান্ডেলা। বিক্ষোভ আরও জোরদার হয়। দ্বিগুণ হয়ে যায় বিক্ষোভকারীর সংখ্যা। 
১৯৫৫ সাল। জনগণের সম্মেলনে ম্যান্ডেলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। পরের বছর ৫ ডিসেম্বর, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকার ম্যান্ডেলাসহ ১৫০ জন বর্ণবাদবিরোধী কর্মীকে দেশদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেপ্তার করে। এই মামলাটি চলেছিল ৫ বছর। শেষপর্যন্ত তাঁরা নির্দোষ প্রমাণিত হন। তারপর রাজশক্তির বিরুদ্ধে শুরু হয় লাগাতার আন্দোলন। একটা সময় ম্যান্ডেলা গেরিলা যুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনাও করেন। তারজন্য বিদেশে অর্থ জোগাড় ও সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার কাজ শুরু করেন।

ম্যান্ডেলা মনে করতেন, সশস্ত্র আন্দোলন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে নিতান্তই শেষ চেষ্টা। কারণ দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা নিপীড়ন এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন কোনো ভাবেই সফল হবে না। তাই এই সশস্ত্র আন্দোলন। 
আতঙ্কিত হয়ে পড়ে রাজশক্তি। ১৯৬২ সালের ৫ আগস্ট ম্যান্ডেলাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগের পাশাপাশি আনা হয় দেশদ্রোহিতার অভিযোগ। কারারুদ্ধ করা হলেও কণ্ঠরোধ করা যায়নি ম্যান্ডেলার। তিনি বিভিন্ন সময় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। তাঁকে বদলি করা হয়েছে বিভিন্ন কারাগারে। এইভাবে কেটে যায় দীর্ঘ ২৭ বছর। 
১৯৯০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। দক্ষিণ আফ্রিকার সেইসময়ের রাষ্ট্রপতি এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসেরসহ অন্যান্য বর্ণবাদবিরোধী সংগঠনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। ঘোষণা করেন, ম্যান্ডেলাকে অচিরেই মুক্তি দেওয়া হবে। ১৯৯০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, মুক্তি দেওয়া হয় ম্যান্ডেলাকে।

তিনি ছিলেন ভারতবন্ধু। এই সঙ্গে নেলসন ম্যান্ডেলার সম্পর্ক ছিল গভীর। তাই ভারত সরকার তাঁকে প্রদান করে ভারতরত্ন। পাশাপাশি ম্যান্ডেলা পেয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। তিনি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি এই  দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি তিনি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষাঙ্গ রাষ্ট্রপ্রধান। ২০১৩-র ৫ ডিসেম্বর ৯৫ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ তিনি নেই। তবে তাঁর আন্দোলন আজও পৃথিবীর বহু মানুষকে প্রেরণা যোগায়।

সব ছবি:‌ আন্তর্জাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *