চাঁদে পদার্পণ করা প্রথম মানুষ
ডঃ সঞ্জীব রায়
১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই প্রথম মহাকাশচারী হিসেবে মডিউল থেকে মইয়ের সাহায্যে চাঁদের মাটিতে নেমে এসে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন নীল আর্মস্ট্রং। আজ তাঁর জন্মদিন। এই প্রতিবেদন প্রকৃত অর্থে সেই মহান মানুষটিকে আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন।
১৯৩০ সালের ৫ আগস্ট আর্মস্ট্রং পরিবারে জন্ম নিল তাদের কনিষ্ঠ সদস্য। বাবা স্টিফেন আর্মস্ট্রং একজন সহকারি অডিটর বা হিসাব-পরীক্ষক ছিলেন। মা ভিওলা সাধারণ গৃহবধূ। আর্মস্ট্রং পরিবার নবজাতকের নাম রাখলেন তাঁদের বড় ছেলের নামের সঙ্গে মিল রেখে ‘নীল’। পুরো নাম নীল এলডিন আর্মস্ট্রং। নীলের বড় ভাই ‘ডীন’ আর দিদি ‘জুন’। আর্মস্ট্রং পরিবারটাই ছিল জার্মান ও স্কটিশ বংশোদ্ভূত। নীলের জন্ম হয়েছিল আমেরিকার ওহিও অঙ্গরাজ্যে। কিন্তু তাদের পরিবারের ছিল আক্ষরিক অর্থেই যাযাবরের জীবন। নীলের বয়স পাঁচ বছর পেরতে না পেরতেই দেখা গেল আর্মস্ট্রং পরিবার ২০ বার বাসা বদল করে ফেলেছে।
অবশেষে ওয়াপাকোনেটায় এসে নীলের পরিবার কিছুদিনের জন্য থিতু হয়। সেখানকার ‘ব্লুম হাইস্কুল’-এ নীল পড়াশোনা শুরু করে। নীলের খুবই ছোট্ট বয়স থেকেই মহাকাশ এবং বিমান সম্পর্কে উৎসাহ প্রকাশ পায়। পাঁচ বছর বয়স হতে না হতেই নীল বাবার সঙ্গে বিমান চড়ার সুযোগ পেয়েছিল। স্কুলের সৌজন্যে খুব ছোট বয়সেই সে বিমান উড়ানোরও শিক্ষালাভ করেছিল। বিমান ছাড়া নীলের আরও একটি বিষয় সম্পর্কে খুব উৎসাহ ছিল। সে ছিল একজন সক্রিয় স্কাউট। তার সক্রিয়তা দেখে তাকে গুরুত্বপূর্ণ সম্মান ‘ঈগল স্কাউট’ পদবি দেওয়া হয়।
স্কুল পাঠ শেষ করে তিনি পারভিউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। তারপরেই তার এয়ার নটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শুরু, কিন্তু সেই পড়া বন্ধ রেখে তাকে নৌসেনার ট্রেনিং-এ যেতে হয়। ২৬ জানুয়ারি ১৯৪৯ মার্কিন নৌসেনা থেকে ১৮ মাসের ট্রেনিং পর্ব শেষ হয়। ২০ বছর বয়স হতে না হতেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন পুরোদস্তুর পাইলট।
১৯৫২ সালে ঐতিহাসিক কোরিয়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তিনি একটানা ১২১ ঘণ্টা আকাশে ওড়ার বিরল কীর্তি স্থাপন করেন। যুদ্ধে একসময় শত্রুপক্ষের গুলিতে তাঁর বিমানের ডানা ভেঙে যায়। তিনি প্যারাসুট নিয়ে বিমান থেকে ঝাঁপ দেন। যুদ্ধে তাঁর কৃতিত্বের জন্য প্রথমে সিলভার মেডেল পরে গোল্ড মেডেল এবং কোরিয়ান সেবিস্টার সম্মানে ভূষিত করা হয়। যুদ্ধশেষে নৌসেনা থেকে ফিরে ১৯৫৫ সালে তার এয়ার নটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বি.এইচ উপাধি লাভ। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার যে মার্কিন নৌবাহিনী নীলের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সমস্ত খরচ বহন করেছিল।
তিনি সফলভাবে চাঁদে পা ফেলার আগে অ্যাপোলো ৮-এর চন্দ্র অভিযানে কারিগরী সহায়তা করেছিলেন। সেখানে তাঁর কৃতিত্বতে নাসা বিশেষভাবে খুশি হয় এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে চাঁদে পা দেওয়া প্রথম ব্যক্তি হবেন নীল। সেই মতন অ্যাপোলো ১১-তে তাঁকে কমান্ডার করা হয়। জুলাই ১৬, ১৯৬৯ অ্যাপোলো ১১ মহাকাশের উদ্দেশ্যে পৃথিবী থেকে রওনা দেয়। সেখানে নীল ছাড়াও নভোচরী দলের বাকি দু’জন সদস্য মাইক কলিং এবং বুর্জ অলড্রিন। চারদিন পরে অর্থাৎ ২০ জুলাই সফলভাবে চাঁদে অবতরণ।
মডিউল থেকে মইয়ের সাহায্যে বেরিয়ে এসে নীল চাঁদের মাটিতে বাঁ পা ফেলে বলেন, ‘এই ছোট পায়ের চিহ্নটি মানবজাতির জন্য বড় পদক্ষেপ (That's one small step for a man, one giant leap for mankind)। চাঁদে পা ফেলার মুহূর্তে নীলের কাছে ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ‘ওয়ার্ল্ড স্কাউট ব্যাজটি’।
মহাকাশ থেকে ফিরে নীল ‘নাসা’ ছেড়ে দিয়ে বলেন, তিনি আর মহাকাশে যেতে চান না। ১৯৭১ সালে তিনি নাসা থেকে পদত্যাগ করে চিনচিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং-এ অধ্যাপনা শুরু করেন। নীল আর্মস্ট্রং মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনের কাছ থেকে ‘Presidential Medal of Freedom’ পদক লাভ করেন। পরবর্তীকালে আরেক রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টারের কাছ থেকে ‘Congressional Space Medal of Honor’ পদক পান।
নীল আর্মস্ট্রং ২০১২ সালে তাঁর জন্ম মাসেই অর্থাৎ ২৫ আগস্ট চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগেই সফলভাবে তাঁর বাইপাস সার্জারি করা হয়েছিল। তাঁর মৃত্যুতে সরকারিভাবে আমেরিকার হোয়াইট হাউস থেকে যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়, তাতে রাষ্ট্রপতি ওবামা বলেছিলেন যে, দেশবাসী আজ আমেরিকান নায়কদের মধ্যে সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম একজনকে হারাল।
ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments