মুঘল সম্রাট আকবরের সৌজন্যে বাংলা নববর্ষের সূচনা
তুষার ভট্টাচাৰ্য

বাংলায় নববর্ষ বা বঙ্গাব্দের সূচনা কবে হয়েছিল তা নিয়ে বিভিন্ন রকমের মতামত রয়েছে। ঋকবেদ, মহাভারত এবং মৎস্য পুরাণ গ্রন্থে বঙ্গাব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে— মাতা মমতা ও পিতা উতথ্যর পুত্র দীর্ঘতমার ঔরসে ও সুদেষ্ণার গর্ভের পাঁচ সন্তানের এক সন্তান ‘বঙ্গ’র নাম থেকে বঙ্গাব্দের নামকরণ। ঋকবেদের ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ পর্বেও ‘বঙ্গে’র উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার অনেকে মনে করেন গৌড় অধিপতি রাজা শশাঙ্কের আমলেই সূচনা হয় বঙ্গাব্দের। তাঁর আমলেই ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল সোমবার শুরু হয়েছিল বঙ্গাব্দের প্রথম মাস এবং দিন গণনার হিসেব।
প্রখ্যাত ভাষাবিদ ডঃ সুকুমার সেন বলেছেন যে— ‘বাংলাদেশের (অবিভক্ত) একটি বিশেষ উদ্ভিদ হল কাপাস। বঙ্গ শব্দের প্রাচীন অর্থ হল কাপাস। এই কাপাস থেকেই বঙ্গ নামের উৎপত্তি।’
ভাষা বিশেষজ্ঞদের মতে ‘বঙ্গ’ শব্দের সঙ্গে দিন গণনার ‘অব্দ’ যোগ করে বঙ্গাব্দ সনের সূচনা হয়েছে। 

অন্যদিকে পুরাণে কথিত রয়েছে— নতুন বছরের প্রথম মাস বৈশাখের প্রথমদিনেই কৈলাস পর্বতে নববর্ষ উৎসবের সূচনা হয়। চৈত্র দিনের শেষে শিবের গাজন শেষ হয়ে যায়। তাই পার্বতীর সঙ্গে সাংসারিক কথাবার্তা বলার একটু ফুরসৎ পান দেবাদিদেব মহাদেব।
ছড়াতে বর্ণনা রয়েছে—
‘পুলকিতা পার্বতী পুছেন পঞ্চানন
জগদুৎপত্তি কথা কহ দয়াময়
সংসার সৃজন অগ্রে কার জন্ম হয়
বর্ষে বর্ষে কেন হয় নূতন নূতন
কী নিমিত্ত হয় কহ রাজা পাত্রগণ
নূতন পঞ্জিকা নাম হয় কী কারণ
কী হেতু করিবে নব পঞ্জিকা শ্রবণ
ভব কন ভবানীকে
কহি বিবরণ
বৎসরের ফলাফল করহ শ্রবণ।’
শিব তো মহাকাল। তিনি অনেক আগাম খবর এবং পুরাণের কথা গড়গড় করে পার্বতীকে বলে গিয়েছেন।
প্রাচীনকালে এভাবেই মুখে মুখে দিন, মাস, তিথি, নক্ষত্রের কথা প্রচারিত হয়েছে। পরবর্তীকালে পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করেই নতুন পাঁজি বা পঞ্জিকা ছাপা শুরু হয়। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাংলা ভাষায় মুদ্রিত পঞ্জিকা ছাপা শুরু হয়। ১৮৩৫ খিস্টাব্দে কলকাতার দীনবন্ধু প্রেসের পঞ্জিকা শুভাশুভ দিনক্ষণের তালিকা ভাষায় সংগৃহীত করে প্রকাশ করে।
সেই সময়ে ১ বৈশাখে নতুন পাঁজি কিনে বাড়িতে পাঠ করার জন্য পাঁজিতেই নির্দেশ দেওয়া থাকত এরকমভাবে— শুনিবেক শুদ্ধ চিত্তে শুদ্ধান্বিত মনে/ পূর্ণ পাত্র সম্মুখে বেষ্টিত বন্ধুগণ/ ফলপুষ্প হস্তে করি পঞ্জিকা শ্রবণ/ শ্রবণেতে সবার আয়ু বৃদ্ধি  হয়/নৃপ নাম শ্রবণেতে রাজপীড়া ক্ষয়।
যদিও আম বাঙালির পয়লা বৈশাখকে নববর্ষ হিসেবে সূচনা করার পিছনে মুঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবরের অসামান্য অবদান ছিল একথা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। মুঘল সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে (৯৬৩ হিজরি সন) দিল্লির সিংহাসনে আরোহন করেন। তাঁর শাসনকালে ভারতে বর্ষপঞ্জির হিসেব করা হত চান্দ্র মাস অনুযায়ী, যাকে হিজরি সন বলা হত। ২৭ দিনের হিসেবে এই হিজরি সন গণনা করা হত। এর ফলে প্রতিবছরই হিজরি সন এগিয়ে আসে চান্দ্র মাসের হিসেব অনুযায়ী। এই জন্য সেই সময়ে কৃষিকেন্দ্রীক বঙ্গদেশের ফসল উৎপন্ন হওয়ার পরে কৃষকদের খাজনা প্রদানের সময়সীমার কিছুটা হেরফের হয়ে যেত। বাংলার কৃষকরা আষাঢ়, শ্রাবণ মাসের পরে নতুন ফসল উঠলে রাজা, জমিদারদের খাজনা মিটিয়ে দিতেন। কিন্তু হিজরি সনের হিসেব অনুযায়ী, প্রতিবছর চান্দ্রমাস এগিয়ে আসার ফলে বাংলার কৃষকরা নতুন ফসল না উঠলেও জমির খাজনা দিতে খুব মুশকিলে পড়তেন। কোনও বছর নতুন হিজরি সন শুরু হত ইংরেজি নভেম্বর মাসে আবার কোনও বছরে মার্চ মাসে।
বাংলার কৃষকদের এই অসুবিধার কথা সম্যক উপলন্ধি করে সম্রাট আকবর তাঁর দরবারের স্বনামধন্য পন্ডিত ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতেউল্লাহ সিরাজি’-কে নির্দেশ দেন— চান্দ্রমাস বা হিজরিসন এবং সূর্যকেন্দ্রীক বর্ষপঞ্জির সংমিশ্রণে একটি নতুন বর্ষ তৈরি করার। যাতে করে বঙ্গ দেশের আপামর কৃষকদের খাজনা বা কৃষিকর দিতে সুবিধে হয়।
মুঘল সম্রাট আকবরের নির্দেশ পেয়ে অভিজ্ঞ প্রবীণ জ্যোতির্বিদ আমির ফতেউল্লাহ কয়েকবছর গণনার পর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০  মার্চে একটি কৃষি ভিত্তিক বর্ষপঞ্জি (হিজরি সন ও সৌরবর্ষের সংমিশ্রণে যার নামকরণ হল— ‘ফসলি সন’) তৈরি করে সম্রাটের দরবারে পেশ করেন। যা বর্তমানের বঙ্গাব্দ বর্ষের গণনার সূচনা বা ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।

১৫৮৪ খিস্টাব্দে জ্যোতির্বিদ আমির ফতেউল্লাহ সিরাজি এই নতুন ‘ফসলি সন’ বা বঙ্গাব্দ বর্ষের সূচনা করলেও ঐতিহাসিকরা মনে করেন সম্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকেই অর্থাৎ তাঁর রাজত্বকালের শুরু থেকেই বাংলার সাধারণ কৃষকদের বা প্রজাদের সুবিধার্থে ফসলি সনের হিসেব বা গণনা অনুযায়ী খাজনা আদায় শুরু করেছিলেন।
বাংলা নববর্ষ এখনও দুই বাংলায় নতুন আশা, সুখ সমৃদ্ধি, আশা আকাঙ্খার স্বপ্ন এঁকে দেয় আমবাঙালির মানস পটে। অবিভক্ত বাংলা, আসাম, ত্রিপুরায় বাংলা নববর্ষ পালিত হয় দোকানে দোকানে হালখাতা। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় আয়োজিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তবে বাঙালি প্রধান অঞ্চলগুলিতে বিদেশীয় ইংরেজি নববর্ষ যেভাবে আদিখ্যেতা, জাঁকজমক ও আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হয় তা বাঙালির নিজেদের বাংলা নববর্ষ নিয়ে আদৌ হয় না।
বাংলা নববর্ষ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন— নববৎসর আসিল। নববর্ষের এমন নবীন মূর্তি অনেকদিন দেখি নাই। সত্য যেখানে সুন্দর, শক্তি যেখানে প্রেম, সেইখানে একেবারে সহজ হইয়া বসিবার জন্য আজ নববর্ষের দিনে ডাক আসিল। আজ নববর্ষের পাখি সেই ডাক ডাকিতেছে। বেলফুলের গন্ধ সেই সহজ কথাটিকে বাতাসে অযাচিত ছড়াইয়া দিতেছে। নববর্ষ যে সহজ কথাটি জানাইবার জন্য প্রতিবৎসর দেখা দিয়া যায় সেই কথাটি আজ স্তব্ধ হইয়া শুনিবার সময় পাইলাম। আজ প্রভাতের আলোকের এই নিমন্ত্রণ পত্রটিকে প্রণাম করিয়া মাথায় করিয়া গ্রহণ করি  (১৩১৯ বঙ্গাব্দ)।
রবীন্দ্রনাথ কবিতাতেও বৈশাখের আবাহন করেছেন—
এসো, এসো, হে বৈশাখ
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে
মুমূর্ষেরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে যাওয়া গীতি
অশ্রু বাষ্প সুদূরে মিলাক।
আবহমানকাল ধরে পয়লা বৈশাখকেই নববর্ষ হিসেবে পালন করছে বিশ্বের প্রায় আঠাশ কোটি বাঙালি।‌‌

পয়লা পাঁজি
সৌমী গুপ্ত

রোদ্দুরটা ঠিক বাইশ ক্যারেট গলানো সোনার মত। কড়কড়ে, ঝকঝকে। আকাশ মূলত পরিস্কার। টুকরো টুকরো কাকের ধূসর গ্রীবার মত মেঘ মাঝেমধ্যে আনাগোনা করছে বটে। তবে ধোপে টিকছে না। এলোমেলো দমকা হাওয়ায় বিশেষ পাত্তা না পেয়ে উড়ে যাচ্ছে, উধাও হয়ে যাচ্ছে। ক্যালেন্ডারে বাঙালি মনে মনে টিক দিচ্ছে চোত মাস শেষ হতে আর কটা দিন বাকি! এই তো নীল ষষ্ঠী, তারপর সংক্রান্তি, তারপর হোল গিয়ে বোশেখ মাস। পয়লা তারিখ। পাঁজি আসেনি হাতে এখনও। আসবে ঠিক পয়লা পেরিয়ে। তার আগে অবধি আবহাওয়ার মতই বাজার সরগরম। চৈত্র সেলের ধূমধাম। লটকনের দোকানে ভিড়। থিকথিকে মাছির মত ভিড় জমেছে দশকর্মার দোকানেও। হবে না! একি যে সে দিন। বচ্ছরকার প্রথম দিন। ফর্দ মিলিয়ে দেখে নিচ্ছে ঘরের কর্তা ঘট আছে? সিঁদুর আছে? আর পঞ্চগব্য? পঞ্চশস্য? সব মিলিয়ে নেওয়া চাই। নয়তো পয়লাই কয়লা হয়ে যাবে। গিন্নির যা মেজাজ তাতে গনগনে রোদ্দুরও লজ্জা পায়। আর চাই লটকনের দোকান থেকে সোনা মুগের ডাল, একটু গোবিন্দভোগ চাল, কাজু কিসমিস, ঘি, গরম মসলা। চাই তো! ওম্মা পয়লাতেই যে পোলাও তুলে দিতে হবে সন্তান সন্ততিদের মুখে। এ তো বাঙালির চিরকালীন আর্তি। সেই ঈশ্বরী পাটনী অন্নপূর্ণার নিকট চেয়ে প্রমাণ করেছে সন্তানের দুধেভাতের সংস্থানের চেয়ে মূল্যবান চাহিদা বাঙালি কেন বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডে কারোরই নেই।

হা পিত্যেশ করেও এবারে চাতকের মুখে জল পড়েনি মেঘ থেকে। আকাশ একেবারে খাঁ-খাঁ। কালবৈশাখীর দেখা নেই বছরের শেষে। বৃষ্টি কবে পড়বে জানা নেই। তবু উৎসাহে ভাটা পড়লে চলবে কেমন করে। দাদু ঠাকুমারা বলতেন বছরকার পেত্থম দিন। সাধ মেটানো চাই । সাধ্যমত অথচ সাধমত। তাই ঝুলোঝুলি করে, দরদাম করে কিনে নেওয়া হত চৈত্র সেলে নতুন জামা কাপড়। তারপর সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই স্নান করে একটুকরো উৎসব নিয়ে মেতে ওঠা। পুজো হবে। দোকানে দোকানে হালখাতার অনুষ্ঠান। আমাদের ছোটবেলায় আমরা গুরুজনদের হাত ধরে হালখাতা করতে যেতামই। এ তো অভ্যস্ত জীবনের মধ্যে একটুকরো বাড়তি পাওনা। বিকেলে দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে কপালের দরদরে ঘাম মুছতে মুছতে ভিড় ঠেলে সেই লাইন দেওয়ার মধ্যেও ছিল অনাবিল আনন্দ। লক্ষ্মী–গণেশের ছবি দেওয়া নতুন ক্যালেন্ডার জমা হত গোটা আষ্টেক। মিষ্টির প্যাকেটও ততগুলো। যে দোকানে পেপসি বা কোলা দেওয়া হত তা ছিল জাতে উন্নত। আমাদের চোখে বেশ একটা সম্ভ্রমের জায়গা করে নিত সেই দোকানদার। সারা বছর সেই কোলা আর পেপসির লোভে তাকে চটাতাম না। আসলে কি পেপসি কিনতে পারতাম না? তা নয়! এগুলো ছিল ছেলেবেলার আনন্দ। ওই যে সবকিছুর মধ্যেও ব্যতিক্রম যেখানে সেখানেই বাঙালির চোখ যায় সব্বার আগে। তাই তো আমাদের আছেন রবি ঠাকুর, আছেন বিভূতিভূষণ, আছেন শরৎবাবু। আসলে বাঙালি ব্যতিক্রম বলেই নিজের জায়গায় অক্ষত। পয়লা বৈশাখ তাই বাঙালি শুধু নয় দেশ বিদেশে সকলেই এই উৎসবে সামিল হন।

কথার খেই হারিয়ে ফেলাও বাঙালির অভ্যেস। এই হাওড়া থেকে শুরু করে শিমলাগড় এলেই সিমলা কুলুমানালিতে গিয়ে পড়বেই। জল এদিক ওদিক করতে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। আমারও সেই অবস্থা। মিষ্টির প্যাকেট‌‌‌ থেকে চলে গেলাম সাহিত্যের দরবারে। যা বলছিলাম। ওই যে মিষ্টির প্যাকেট‌‌‌ ওটা ছিল গুপ্তধন। ভাজা মিষ্টি, আর ন্যাতানো নিমকিই ছিল স্বর্গের অমৃত। 
দুপুরে পয়লা বলুন আর পুজো বলুন হতদরিদ্র থেকে উচ্চ অভিজাত সকলের রান্নাঘরে মায়েরাই সেদিন অন্নপূর্ণা। আর অন্নপূর্ণা যে তার লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক গণেশদের অভুক্ত রাখবেন না তাও আবার বছরের প্রথম দিনে তা বলাই বাহুল্য। 

সেই রীতি রেওয়াজ অনেকটাই ক্ষয়ে এসেছে। পাশ্চাত্য সভ্যতার স্পর্শ এসে পড়েছে বাঙালিয়ানায়। তবু নিজের শিকড় উপড়ে যাইনি এখনও। পাড়ার দোকানে হালখাতা হয় এখনও। শপিং মলের ফুড কোর্টের পাশাপাশি মায়ের হেঁশেলে হানা দেয় নিত্য রকমারি পদ। ছেলেপুলেরা, কচিকাঁচাদের একটা ছোট্ট গেট টুগেদার হয়ে যায়। যেটা আমরা ছোটবেলায় বলতাম পাতপেড়ে একসঙ্গে খাওয়া। গোটা দুপুর পুজো হবে। ভিড় জমবে রেস্তোরাঁয়, ভিড় জমবে শহরতলির ট্রাম লাইনের পাশে ফুটপাতে। কৃষ্ণচূড়ার আগুন ঢালা শরীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকবে চেনা রকের ধারে। লাল মেঝের বহু পুরনো বারান্দায় অনেকদিন পর বৈঠকী আড্ডা বসবে প্রাচীনকালের মতো। অচেনা স্টেশনেও শোরগোল উঠবে বেশ। বকুল ফুল ঝরে পড়ে যে উঠোনে সেখানে চড়ুই পাখির সঙ্গে আজ কিছু কচিকাঁচাও কানাকানি করবে বৈকি। 

ওদিকে গেঁয়ো মাঠের পাশ দিয়ে মেঠো রাস্তা পেরিয়ে নদীর পাশে একচিলতে কুঁড়ে গুলো গা মাখামাখি করে জেগে আছে ওদের বাড়ি থেকে রগরগে মাংস কষার সুবাস বাতাসে ভেসে আসবে। ফুটন্ত চাল টগবগ করবে । আবছা আলোয় উঠোনে মাদুর পেতে বসে একসঙ্গে হাসি ঠাট্টায় মশগুল হবে। সারাদিনের খাটনি আর ক্লান্তির পর ওই উঠোনের একপাশে শতরঞ্জি পেতে সার দিয়ে যে কচি মুখগুলো হাপুস হুপুস করে খেতে খেতে হেসে হেসে এর গায়ে ও ঢলে পড়বে ক্লান্ত চোখ জুড়িয়ে আসা মা আর খাটুনিতে জেরবার বাবার কাছে দিনের শেষে এটুকুই প্রাপ্তি। বছরের শেষে তাই শুরুর দিনটা নতুন করে বাঁচতে চায় বাঙালি। তাই তো পাঁজি খুলে দেখা কবে কবে আছে তাদের প্রাণের উৎসব। পয়লা বৈশাখ সেই আশা পূরণ করে। তিথি নক্ষত্র সবটুকু নিয়ে হাজির হয় পয়লা পাঁজি। এই সব দিনগুলোই প্রাণের উৎসব। এইসব দিনগুলোই সব দুঃখ কষ্ট ভুলে নতুন করে বাঁচার রসদ জোগায়। স্বপ্ন দেখায়। আর দিকে দিকে ঈশ্বরী পাটনীরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করে ‘‌আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে!’‌

নূতন উষালোকে বৈশাখ
গোলাম রববানী 

দিন যায় মাস যায় সময় ফেলে সময় আসে
আমাদের মনমাঝে বারেবারে ঘুরেফিরে 
আবারও এসেছে প্রাণের পহেলা বৈশাখ 
এসো এসো এসো এসো এসো হে বৈশাখ

কতো প্রাণ চলে যায় নতুনও প্রাণ আসে
কোটি করুণও সুর ভুলে মধুর সুরের টানে
মায়া মততা শত যাতনা মনমাঝে পিষ্ট করে
রমনার বটমূলে বর্ষবরণে মানব মুক্তির শপথে
এসো এসো এসো এসো এসো হে বৈশাখ

মহামারি মুছে যাক, মানবের গোলযোগ থেমে থাক
বিশ্বভুবনে শান্তি এসে ভরুক,মানুষের চেয়ে কিছু নাই দামী 
মার্জনা করো ধরা আগামী হৃদয়ের অন্তরীক্ষে নৃত্যময়ী 
আলো আলো এসো আলো এসো নববর্ষদিনে
পাপ তাপ ঘৃণা অপবাদ পুড়ে যাক চিতাগ্নিশিখায়
আকাশ বাতাস তরুলতা হোক শান্তি দেখে নিস্তব্ধ নির্বাক
এসো এসো এসো এসো এসো হে বৈশাখ

বৈশাখের উল্লাসে
কাব্য কবির
 

বৈশাখেরই আনন্দেতে গায় যে পাখি গান,
বাতাসেতে হেলেদুলে নাচে ক্ষেতের ধান।
ফুল বাগানে ফুল ফুটেছে, লুটে ভ্রমর মধু,
পায়ে আলতা হাতে চুড়ি, পরে গাঁয়ের বধূ।

মন–মাধুরী দিয়ে নকশা পলিমাটির হাঁড়ি,
পিঠা–পুলির উৎসব জমে কৃষকেরই বাড়ি।
প্রজাপতি মন খুশিতে নাচে ফুলে ফুলে,
গল্প বলি সবার সাথে মনের বাক্স খুলে।

দোকানেতে উঠছে মেতে হালখাতার উৎসব,
খরিদদারে ঋণ পরিশোধ মিষ্টি কলরব।
কদম তলায়,বটের তলায় ঢোল যে বাজায় ঢুলি,
মেলায় গিয়ে বাতাসা খায় গাঁয়ের মেয়ে ফুলি।

আউল–বাউল গান গেয়ে যায় বাহুতে একতারা,
গানের সুরে মুগ্ধ সবাই নাচে মনেরপাড়া।
বৈশাখেরই আনন্দেতে মনটা রঙিন ঘুড়ি, 
নতুন নতুন স্বপ্ন আশা মনেতে সুড়সুড়ি।

আলোর যাত্রা
দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

অন্ধকার আকাশের দিকে তাকালে তারারা মুচকি হাসে। তাদের হাসিতে আমি পথ চলি টলোমলো পায়ে। উঁচু নিচু পথে চলতে লাগে। হোঁচট খাই। পড়ি। আবার উঠে দাঁড়াই তারাদের বাড়ানো হাতে।
মিটিমিটি জ্বলে আলো আমার জীবনে। মালা গাঁথি ওদের। সুখ পিঁড়ি পেতে বসে দেখে সে সব। মুচকি হেসে ওর দিকে তাকালেই দেখি অন্ধকার তাকে গ্রাস করেছে।
কেন এমন হয়? প্রশ্নটা ঘুরপাক খেতে থাকলেই দেখি দূরে এক বৃদ্ধ আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে। সাদায় চারদিক ভরে ওঠে। ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেই দেখি বুকের মধ্যে কত আলো! সারা শরীর আমায় আলোয় মোড়া। তবে কি দুষ্টু অন্ধকার...
আলোমানুষটার দিকে তাকাতেই দেখি আমার সেই দাড়িমুখ ঠাকুর মুচকি হেসে আলোটা আমার হাতে ধরিয়ে এগিয়ে চলেন অন্ধকার ভেদ করে এক আলোর নদী হয়ে।
দুকুল ছাপানো কান্নার নদী বুকের মধ্যে বইতে থাকলে দেখি, এগিয়ে চলার গান ধরেছে তারা এখন। অন্ধকার দুঃখগুলো ভেসে যায়। শুরু হয় শুধু আলোর পথযাত্রা!

সব ছবি: আন্তর্জাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *