আত্মনির্ভর ভারত
ডঃ সঞ্জীব রায়
কিছুদিন আগেই বেলজিয়াম ম্যালিনয় প্রজাতির সারমেয়দের নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম। শক্র বা রোগ নির্ণয়ে ওই প্রজাতির সারমেয়দের দক্ষতা সত্যিই প্রশ্নাতীত। অভূতপূর্ব সাফল্য তাদেরকে সারা বিশ্বে নিজেদের সুনামের সঙ্গে জায়গা করে নিতে শিখিয়েছে। এদের নিয়ে সমস্যাও আছে। এরা ততটা সহজলভ্য নয়, কারণ এদের জোগান কম, কিন্তু চাহিদা বেশি। অন্যদিকে এদের লালন পালনও যথেষ্ট ব্যয়সাধ্য। এইসব কিছু মাথায় রেখে ভারতে বেশ কিছুদিন যাবৎ এদের বিকল্প অনুসন্ধানের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। নিঃসন্দেহে বিকল্প জোগাড় করা সহজসাধ্য নয়।
অন্যদিকে বিগত কয়েকবছর ধরে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও সর্বক্ষেত্রে দেশীয় জিনিসের ব্যবহার বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রেও পরোক্ষভাবে তাঁর বক্তব্য ছিল যে, ভারতবর্ষের কোনও প্রজাতির সারমেয়দের ম্যালিনয় প্রজাতির সমদক্ষ বানানো সম্ভব কিনা? এই ব্যাপারে যেন অন্তত যথাযথ চেষ্টা বা অনুসন্ধান করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সবুজ সঙ্কেত পাবার পর প্রধানমন্ত্রী–সহ দেশের ভিভিআইপি–দের নিরাপত্তা দেওয়ার গুরুদায়িত্ব যাঁদের উপর বর্তায় অর্থাৎ সেই স্পেশাল প্রোটেকশন গ্রুপ বা এসপিজি–র তরফে খুব দ্রুত সারাদেশের সারমেয়দের নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা শুরু করা হয়। বলা বাহুল্য তাদের মধ্যে নানাধরনের পাহাড়ি সারমেয়রাও ছিল। অন্যদিকে সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুকুর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয় যাতে তারা অতি শীঘ্র প্রধানমন্ত্রীর আত্মনির্ভর ভারত প্রকল্পে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে দেশীয় শিকার কুকুরকে উপযুক্ত করে তোলার চেষ্টা করতে বিলম্ব না করে।
এসপিজি এবং কুকুর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলি সারা দেশব্যাপী যৌথভাবে অনুসন্ধান চালায়। এই কাজ করতে গিয়ে তারা কর্ণাটকের ক্যানাইন রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন সেন্টারের কথা জানতে পারে। সেখানে স্থানীয় মুষল বা ক্যারাভান হাউন্ড সারমেয়দের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ছোটোখাটো কাজে লাগানোর জন্য। এই মুষল প্রজাতির সারমেয়দের মূলত দেখা মেলে কর্ণাটকের মুষল তালুকে এবং তেলেঙ্গানা রাজ্যের কয়েকটি জায়গায়। আপাত দৃষ্টিতে অবশ্য এদের চেহারা দেখলে আমাদের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো রাস্তার কুকুর বলেই মনে হবে, তবে ভালো করে লক্ষ্য করলে ধরা পড়বে যে আমাদের দেখা রাস্তার কুকুরদের অপেক্ষায় এদের কানদুটো বড় এবং চোখের দৃষ্টিও প্রখর।
এদের মেজাজে একটু–আধটু সাবেকিআনা আছে। এরা সাহসী ও প্রভুভক্ত। এদের উচ্চতা ছেলেদের মোটামুটি ৬৮–৭২ সেমি এবং মেয়েদের সামান্যই কম, ওজন মোটামুটি ২২–২৮ কেজি। গায়ের রং সাদা, কালো, চকোলেট বা মেশানো হতে পারে। ইতিমধ্যেই দেখা গেছে এদের ঘ্রাণশক্তি অন্যান্য প্রজাতির সারমেয় অপেক্ষা বেশি এবং অবশ্যই ম্যালিনয় প্রজাতির সঙ্গে তুলনীয়।
এই মুষল জাতীয় সারমেয়রা ক্যারাভান হাউন্ড বা মারাঠা হাউন্ড হিসেবেও পরিচিত। এদের নিয়ে অনেক পুরোনো ইতিহাস আছে। ১৯০০ সাল, মাদ্রাজের অন্তর্গত তৎকালিন মুষল স্টেটের মহারাজা ছিলেন পঞ্চম জর্জ। তাঁর শিকার ও সারমেয় প্রেম নিয়ে অনেক কাহিনি প্রচলিত আছে। তিনি ভালোবেসে মুষল জাতীয় সারমেয়দের পুষতেন। এই গৃহপালিত সারমেয়রা রাজার সঙ্গে শিকারে যেত।
সেখানে গিয়ে দেখা যেত এরা কাউকে পরোয়া করে না এবং প্রচন্ড সাহসী। রাজা এমনই একজোড়া সারমেয় ব্রিটেনে তার পরিচিতকে উপহার হিসেবে দেন। বলাবাহুল্য সেখানেও এদের সুনাম ছাড়া দুর্নাম হয়নি। তারপর দীর্ঘদিন বিদেশীদের চাকচিক্য দেশীয় কদর তলানীতে গিয়ে ঠেকে। বর্তমানে এই জাতীয় সারমেয়রা মূলত আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে শিকারী কুকুর হিসেবেই ব্যবহার হয়।
কয়েকমাস আগে সারমেয় প্রশিক্ষকের দল কর্ণাটকে পৌঁছে মুষল জাতীয় সারমেয়দের ওপর বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালায়। পরীক্ষার ফলাফল বিশেষভাবে আশাপ্রদ।
প্রচন্ড ক্ষিপ্ত এই সারমেয়দল উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পেলে অনায়াসে ২৭০ ডিগ্রি ঘাড় ঘুরিয়ে নজর রাখতে সক্ষম। পরীক্ষা–নিরীক্ষার সন্তুষ্ট হয়ে মাত্র কিছুদিন আগে এসপিজি কর্তাব্যক্তিরা কয়েকটি বাচ্চা মুষল জাতীয় সারমেয়দের বিশেষ ট্রেনিং দেবার অভিপ্রায় দিল্লি নিয়ে আসেন। শুধুমাত্র নিরাপত্তার স্বার্থে সেই ট্রেনিংয়ের স্থান, কাল, পাত্র কিছুই জানানো হয়নি। প্রশিক্ষকরা খুবই আশাবাদী যে, দুটো সেশনে যথাযথ ট্রেনিং নিঃসন্দেহে তাদের জঙ্গী দমনে পারদর্শী করে তুলবে। গত জুন মাস থেকে ট্রেনিং শুরু হয়েছে।
আমরা আশাবাদী ট্রেনিং–এ ইতিবাচক কিছু ফলাফল আসবে। আমরা সকলে সমবেতভাবে গর্বের সঙ্গে আনন্দ করার একটি বিষয় পাব।
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments