আর্তের সেবায় মাদার টেরিজা
ডঃ সঞ্জীব রায়

১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট উসমানীয় সাম্রাজ্যের ইউস্কুবে (অধুনা ম্যাসিডোনিয়া প্রজাতন্ত্রের রাজধানী স্কোপিয়ে) জন্ম হয় এক কন্যা সন্তানের। তার নাম রাখা হয় অ্যাগনিস গঞ্জা। পুরো নাম অ্যাগনিস গঞ্জা রোজাঝিউ। আলবেনীয় ভাষায় গঞ্জা শব্দের অর্থ গোলাপের কুঁড়ি। অ্যাগনিস পরিবার আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল ছিল। স্বভাবতই গোলাপের কুঁড়ির আগমনে তারা যারপর নাই খুশি হয়। ছোট্ট অ্যাগনিস (অ্যাগনেস) যখন মাত্র আটবছরের সেই সময়ে অ্যাগনেসের বাবা মারা যান। পিতার মৃত্যুর পর মা তাঁকে রোমান ক্যাথলিক আদর্শে পালন করেন। বিখ্যাত লেখক ক্লুকাস রচিত বই থেকে জানা যায় ছোটবেলা থেকেই এই কন্যাসন্তান ধর্মপ্রচারকদের জীবন ও কাজকর্মের গল্প শুনতে খুবই পছন্দ করত। অ্যাগনেস মাত্র ১২ বছর বয়সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে সে ধর্মীয় সন্যাস জীবনযাপনের মাধ্যমে বাকি জীবন অতিবহিত করবে। 

সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে অ্যাগনিসের যখন ১৮ বছর বয়স অর্থাৎ ১৯২৮ সালে সংসারের সব বন্ধন ছিন্ন করে সে একজন ধর্মপ্রচারক হিসাবে গৃহত্যাগ করে। বিদায়বেলায় তার মা ও দিদিদের সঙ্গে যে দেখা হয়েছিল সেটি ছিল জীবনের শেষ দেখা। বাকি জীবনে তাদের আর দেখা হয়নি। অ্যাগনেস ধর্ম প্রচারক হিসাবে আয়ারল্যান্ডের রথফার্নহ্যামে লোরেটো অ্যাবেতে ইংরেজি ভাষা শিখতে যান কারণ ইংরাজিই ভারতে সিস্টার্স অফ লোরেটোর শিক্ষার মাধ্যম।

১৯২৯ সালে তিনি আয়ারল্যান্ড থেকে ভারতে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার অভিযানে আসেন। ভারতে এসে তিনি সর্বপ্রথম দার্জিলিংয়ে কাজ শুরু করেন। এখানেই তিনি টেরিজা নামটি গ্রহন করেন। তখন তার পুরো নাম হয় মেরি টেরিজা রোজাঝিউ। ১৯৩১ সালের ২৪ মে তিনি সন্ন্যাসিনী হিসাবে প্রথম শপথ গ্রহন করেন। ১৯৩৭ সালের ১৪ মে কলকাতার শিয়ালদা লোরেটো কনভেন্ট স্কুলে পড়ানোর সময় তিনি দ্বিতীয়বার বা চূড়ান্ত শপথ গ্রহন করেন। স্কুলে পড়াতে তার ভালো লাগলেও কলকাতার দারিদ্র দেখে তিনি খুবই ব্যথিত হতেন। ১৯৪৬ সালে হিন্দু–মুসলমান দাঙ্গা তাঁর জীবনে গভীর রেখাপাত করে। 
টেরিজা লরেটো কনভেন্ট ত্যাগ করে দরিদ্রদের মাঝে বসবাস করতে শুরু করেন। এই ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব মতামত ছিল যে হতদরিদ্রদের সহায়তা করাকেই আমি আবশ্যিক বলে মনে করতাম। এই ব্যাপারে আমার অন্তর আমাকে চালিত করত। সেই মোতাবেক ১৯৪৮ সাল থেকে বস্তি এলাকা ঘুরে ঘুরে তাঁর যিশুর মহত্ব প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের একেবারে প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়ানো শুরু। সেই সময়ে তার পরিধানে থাকত নীলপার লাগানো সাদা সুতির বস্ত্র। 

টেরিজা আর দেশে ফিরে যান নি। ১৯৪৭ সালে তাঁকে ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। ১৯৫০ সালে কলকাতায় তিনি দ্য মিশনারিজ অফ চ্যারিটি নামে এক প্রতিষ্ঠান খোলেন। মাত্র ১৩ জন সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর এই সংস্থার কাজ শুরু। ২০১২ সালের পরিসংখ্যান বলছে সেখানে ৪,৫০০ জন সন্ন্যাসিনী যুক্ত আছেন। টেরিজার সৃষ্টি মিশনারিজ অফ চ্যারিটির উন্নতি ও প্রসার বাস্তবিকই চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতন। ১৯৬৯ সালে বিবিসি প্রচার মাধ্যম থেকে একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয় যার নাম ছিল ‘‌সামথিং বিউটিফুল ফর গড’‌ এই অনুষ্ঠানে মূল আকর্ষণ ছিল বিশ্ব বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ম্যালকম ম্যাগারিজের একটি তথ্যচিত্র। এই তথ্যচিত্রতে টেরিজাকে বিভিন্নভাবে উপস্থিত করা হয় যা পশ্চিম দেশগুলি ভীষণভাবে গ্রহণ করে। ১৯৯৭ সালে টেরিজার মৃত্যুকালে বিশ্বের ১২৩ টি দেশে তাঁর সৃষ্টি মিশনারিজ অফ চ্যারিটি বিদ্যমান। তারা মৃত্যুপথ যাত্রীদের সেবা, এইডস, কুষ্ঠ ও যক্ষ্মা রোগীদের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্র, ভোজন শালা, শিশু ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, অনাথ আশ্রম, বিদ্যালয় প্রভৃতির মাধ্যমে মোট ৬১০ টি কেন্দ্র বিদ্যমান ছিল। 

১৯৭৯ সালে তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৮০ সালে তিনি ভারতবর্ষের অসামরিক সর্বোচ্চ সম্মান ভারতরত্ন গ্রহন করেন। পশ্চিমবঙ্গের তাঁর মিশনারিজ অফ চ্যারিটির মাধ্যমে দুটি জনসেবা কেন্দ্র নির্মল হৃদয় ও শান্তিনগর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি সত্যিকারেরই একজন সেবা মনোভাবসম্পন্ন নারী ছিলেন। যদিও তাঁর সম্পর্কে একাধিকবার অভিযোগ উঠেছে যে, তিনি গরিবদের দুর্দশাকে হাতিয়ার করে মৌলবাদী ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ধর্ম বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দিতে যতটা আগ্রহী ছিলেন, ততটা দরিদ্র লাঘবে আগ্রহী ছিলেন না, অন্যদিকে তাঁর গর্ভপাত এবং বিবাহ বিচ্ছেদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান সমালোচিত হয়েছে। 

টেরিজা অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারতেন। ডাক্তারদের বারণকেও গায়ে মাখতেন না। ১৯৮৩ সালে প্রথমবার হৃদ্‌রোগের সমস্যা দেখা দেয়। ১৯৮৯ সালে দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাকের পরে তাঁর শরীরে পেসমেকার বসানো হয়। ১৯৯৬ সালে এপ্রিলে পড়ে গিয়ে তার কলার বোন ভেঙে যায়। ১৯৯৭ সালের ১৩ মার্চ মিশনারিজ অফ চ্যারিটির প্রধানের পদ (মাদার) থেকে সরে দাঁড়ান। সিস্টার নির্মলা দায়িত্বভার নেন। ভগ্ন শরীর নিয়ে আর পারলেন না, ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর চিরবিদায় নিলেন। মৃত্যুর অনেক পরে ২০১৬ সালে পোপ ফ্রান্সিস তাঁকে ‘‌সন্ত’‌ হিসাবে স্বীকার করে নেন। 
পরিশেষে বলা যায় যে, মানুষটির এদেশে আসা মূলত একজন ধর্ম প্রচারক হিসাবে হলেও সেবার মাধ্যমে ও মিষ্টি ব্যবহারে মানুষকে ভালোবাসা প্রদান করে তিনি তাঁর ছবি আপামর মানুষের অন্তরে প্রতিষ্ঠা করে গেলেন তা নিঃসন্দেহে চির অম্লান হয়ে যুগ যুগ ধরে বিরাজ করবে। 

সব ছবি: আন্তর্জাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *