আজকের দিনে ১৫১৯ সালে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি প্রয়াত হন। তাঁর সৃষ্ট মোনা লিসা বার বার চুরি হওয়ার পর বর্তমানে কেমন সুরক্ষিত আছে সেই নিয়ে মৃদুল শ্রীমানী-র নিবন্ধ মোনা লিসার চুরিবৃত্তান্ত
মোনা লিসার চুরিবৃত্তান্ত
মৃদুল শ্রীমানী
দেশপ্রেম ভাল জিনিস। কাজে দেয়। তবে মাত্রাছাড়া আকার নিলে তা কী জঘন্য আর উৎকট রূপ নেয়, তার সাক্ষী মোনা লিসা। হ্যাঁা, মহান চিন্তানায়ক লিওনার্দো দা ভিঞ্চির সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মটি। আজকের মতো এই রকমই এক একুশে আগস্ট তারিখে, ১৯১১ সালে, আজ থেকে একশো দশ বৎসর আগে মোনা লিসা চুরি হন। ফ্রান্সের লুভর মিউজিয়ামের কর্মী ভিনসেনজো পেরুজ্জিয়া মোনা লিসাকে কোটের নিচে লুকিয়ে পালান। ভিনসেনজো পেরুজ্জিয়া ছিলেন উগ্র দেশপ্রেমিক। ইতালি তাঁর পিতৃভূমি। ইতালির এই পেরুজ্জিয়া কাজ করতেন লুভর মিউজিয়ামে। সবাই জানে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি (১৫ এপ্রিল, ১৪৫২-২ মে, ১৫১৯) ছিলেন ইতালির ফ্লোরেনটাইন রিপাবলিকের টাসকানির অন্তর্ভুক্ত ভিঞ্চি এলাকার মানুষ। দেশপ্রেমিক পেরুজ্জিয়া ভাবলেন, ইতালির মানুষ লিওনার্দোর আঁকা ইতালিতেই থাকা উচিত। উগ্রতা চিন্তাভাবনাকে অন্ধ করে। বিচারবোধকে পঙ্গু করে। মোনা লিসা ইতালির মানুষ এঁকে থাকলেও ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরার মধ্য দিয়ে তা লুভর মিউজিয়ামে এসে পৌঁছেছিল, তার চাকা উল্টোদিকে ঘোরানোর চিন্তাটাই ছিল অবাস্তব। ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতার সঙ্গে উগ্রবাদ মিশলে পাঁচশ বছর আগের মসজিদ ভাঙতে মানুষ খেপে ওঠে। তেমনি করেই দেশপ্রেমের উগ্র নেশার খপ্পরে পড়ে পেরুজ্জিয়া ভাবলেন ইতালির জিনিস তিনি ইতালিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। তার জন্য দরকার হলে মোনা লিসাকে চুরি পর্যন্ত করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। সারাদিন ঝাঁটা আর ঝুল ঝাড়া বুরুশের ঘরে লুকিয়ে থেকে শেষ বিকেলে মিউজিয়াম থেকে দর্শকরা সকলে বেরিয়ে গেলে চুপিসাড়ে পেরুজ্জিয়া মোনা লিসাকে কোটের আড়ালে লুকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। মোনা লিসা অপূর্ব জগৎবিখ্যাত ছবি হলেও সাইজে তা এমন কিছু বড় নয়। ত্রিশ ইঞ্চি বাই একুশ ইঞ্চির ছবিখানাকে কোটের ভিতর লুকিয়ে চালান করা সম্ভব ছিল। পেরুজ্জিয়া কোটের ভিতর মোনা লিসাকে নিয়ে কেটে পড়ার পরদিন লুভর মিউজিয়ামে হুলুস্থুল পড়ে গেল। ওই মোনা লিসাকে দেখবে বলেই কিন্তু এখন শতকরা আশিভাগ দর্শক লুভর এ আসেন। তখনও অতটা না হলেও চিত্রকরদের কাছে মোনা লিসার আবেদন ছিল অসীম। তাই মোনা লিসা ছিল লুভর কর্তৃপক্ষের নয়নের মণি। মোনা লিসা যে তার নির্দিষ্ট জায়গাটিতে নেই এটা প্রথম চোখে পড়ে লুই বেরুদ এর। তিনি একজন চিত্রকর। বেরুদ মোনা লিসার জায়গামতো না থাকার কথা কর্তৃপক্ষের নজরে আনা মাত্র কর্তৃপক্ষের লোকজন খোঁজ খবর নিতে লাগলেন ফোটোগ্রাফ তোলার জন্য মোনা লিসাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে কি না।
অফিসিয়াল লগবুকে তেমন কোনো হদিস না পাওয়ায় জোরদার খোঁজাখুঁজি করার জন্য লুভর কর্তৃপক্ষ সাতদিনের জন্য মিউজিয়াম বন্ধ করে দিলেন। তারপর কর্তৃপক্ষ ডেকে পাঠালেন ফরাসি কবি নাট্যককার ঔপন্যাসিক গিলোম অ্যাপোলিনারকে। তিনি তখন ফ্রান্সের নামকরা তরুণ কবি। ১৮৮০ সালে জন্ম। বয়স তাঁর সদ্য ত্রিশের কোঠায়। কবিতা লেখা ছাড়াও চিত্রসমালোচক বা আর্ট ক্রিটিক হিসেবে ভাল নাম কিনে ফেলেছেন। বড় বড় নামকরা সাময়িকী ও সংবাদপত্রের পাতায় তাঁর চিত্রসমালোচনা লোকে পড়ত। চিত্রাঙ্কন জগতে অসাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ ‘কিউবিজম’ তাঁর অবদান। সুররিয়ালিজম শব্দটা সৃজনেও তিনি স্মরণীয়। এহেন কবি চিত্রসমালোচক গিলোমকে মোনা লিসা চুরির ঘটনায় সন্দেহ করে লুভর কর্তৃপক্ষ ডেকে পাঠালেন। এবং শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করা নয়, কর্তৃপক্ষের চাপে পুলিশ গিলোম অ্যাপোলিনারকে অ্যারেস্ট করে সন্দেহভাজন হিসাবে জেল হেফাজতে রাখল। জেলে আটকা পড়ে তো গিলোম বেচারি খুব অসম্মানিত বোধ করলেন। তারপর ভাবলেন, আমি একাই বা বিনা দোষে সাজা ভোগ করি কেন, আরো কেউ এ নিয়ে ভুগুক। পাবলো পিকাসো ছিলেন বিখ্যাত শিল্পী। তিনি গিলোমের থেকে মাত্রই কয়েকটি মাসের ছোট। সমবয়সীই বলা চলে। নিজেকে নির্দোষ দেখাতে চেয়ে গিলোম কর্তৃপক্ষের কাছে আভাস দিলেন, মোনা লিসা চুরি কাণ্ডে পাবলো পিকাসোর হাত থাকতে পারে।
তখন সদ্য সদ্য কিউবিজম কথাটা চালু হয়েছে। চালু করেছেন গিলোম স্বয়ং। কিউবিজম নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছেন পাবলো পিকাসো। আর কিউবিস্ট রীতির কোনো আদি ছায়া মোনা লিসাতে আছে কি না, সেই নিয়ে বিতর্কে মেতেছিলেন চিত্রসমালোচক মহল। তাইতে কিউবিস্টদের পাণ্ডাদেরকেই সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেন লুভর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু রীতিমতো অনুসন্ধানে দেখা গেল, গিলোম এবং পিকাসো, দুজনেই সম্পূর্ণ নির্দোষ। চুরির ঘটনার সঙ্গে তাঁরা কোনোভাবেই জড়িত নন। তখন তাঁরা ছাড়া পেলেন।
কিন্তু সেই যে দেশপ্রেমিক পেরুজ্জিয়া, তিনি করেছিলেন কি, দু দুটি বছর ধরে নিজের বাসায় মোনা লিসাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তারপর ফ্লোরেন্সের নামকরা ছবি সংগ্রহশালা উফিজি গ্যালারির নির্দেশক জিওভান্নি পোজ্জিকে মোনা লিসা বেচতে গিয়ে তাঁর কপাল পুড়ল। হাতবদলের পর দুই সপ্তাহ ধরে তা উফিজি গ্যালারির কাছে ছিল এবং তা জনগণের কাছে প্রদর্শিত হচ্ছিল। তাতেই সব জানাজানি হয়ে যায়। পরে লুভর কর্তৃপক্ষের অনুরোধে ও ফরাসি প্রশাসনের চাপে ১৯১৪ সালের চার জানুয়ারি তারিখে উফিজি কর্তৃপক্ষ লুভরকে মোনা লিসা ফিরিয়ে দেন। পেরুজ্জিয়া এই অপরাধটি ঘটানোর জন্য ছয়মাসের কারাদণ্ড ভোগ করলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আবহাওয়ায় ইতালিতে তিনি দেশনায়কের সম্মান পেয়েছিলেন।
চিত্র গবেষক ও উচ্চমার্গের চিত্রশিল্পীদের কাছে মোনা লিসা অত্যতন্ত আদরণীয় হলেও অতি সাধারণ মানুষ তখনও অবধি মোনা লিসাকে সেভাবে জানত না। এই চুরির ঘটনাটাই মোনা লিসাকে আম আদমির কাছে তুমুল পরিচিতি দিল। ‘মোনা লিসা হারিয়েছে’, ‘মোনা লিসার খোঁজ পাওয়া গেছে’, ‘মোনা লিসা ফিরে এসেছে’; ইত্যাোদি হেডলাইনে ভরে উঠত সংবাদপত্রগুলি। আর সংবাদপত্র পড়ে মানুষ জানল মোনা লিসার কথা। এরপরেও মোনা লিসা ছবির উপর বারে বারেই হামলা হয়েছে।
মোনা লিসার জন্য অভূতপূর্ব সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। যাতে আর কেউ হামলা না করার সুযোগ পায়, তাই মোনা লিসাকে বুলেটপ্রুফ কাচের বাক্সে রাখা হয়েছে। দর্শককে খুব সামান্য সময়ের জন্য মোনা লিসাকে দেখতে দেওয়া হয়, আর সেটা ত্রিশ সেকেন্ডের বেশি নয়।
আজ বিশ্বের সবসেরা চিত্রকর্মগুলির বিষয়ে বলতে গেলে মোনা লিসার নাম মনে পড়বেই। একটা দেশপ্রেমিক চোর মোনা লিসাকে এমন সাংঘাতিক রকম বিখ্যাত করে ছাড়ল। পাঁচশ বছর ধরে অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে মানুষের দিকে চেয়ে আছেন মোনা লিসা।
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments