কিশোর ছিলেন কিশোর আছেন
অংশুমান চক্রবর্তী
দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গায়ক কিশোর কুমার। বেশ কয়েকটি হিন্দি এবং বাংলা ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। জন্ম মধ্যপ্রদেশের খান্ডোবাতে, ৪ অগাস্ট, ১৯২৯-এ। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় আভাসকুমার গঙ্গোপাধ্যায়। হুমম, বাঙালি। তবে তাঁরা ছিলেন প্রবাসী বাঙালি। বাবা কুঞ্জলাল ছিলেন উকিল। মায়ের নাম গৌরী দেবী।
চার ভাই-বোনের মধ্যে কিশোর ছিলেন সবার ছোট। বড় ছিলেন অশোক কুমার। তারপর দিদি সীতা দেবী। তারপর অনুপ কুমার। কিশোর কুমার ছিলেন সবার আদরের ভাই।
ছেলেবেলায় কিশোর কুমার ছিলেন কুন্দললাল সায়গলের অন্ধ ভক্ত। দাদা অশোক কুমার বোম্বের চলচ্চিত্র জগতে সাফল্য পেয়েছিলেন। দাদাকে দেখে সিনেমার প্রতি আকৃষ্ট হন ছোট্ট কিশোর। যদিও অভিনয় নয়, তাঁর ঝোক ছিল গানের প্রতি। বিশেষত কে এল সায়গলের গান তিনি নকল করে গাইতেন। উৎসাহ দিতেন বাড়ির বড়রা। অবশ্য কিশোরের গানের প্রথাগত তালিম ছিল না। অশোক কুমারের পর আর এক দাদা অনুপ কুমারও অভিনয় জগতে পা রাখেন।
একটা সময় কিশোর বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যান। মূলত অশোক কুমারের সৌজন্যে। তবে শুরুর দিকে তেমন সাফল্য পাননি। অভিনেতা হিসেবে কিশোর কুমার সাফল্যের কাপে চুমুক দিয়েছিলেন অনেক পরে। পর্দায় তাঁকে বেশি দেখা গেছে কমেডি চরিত্রে। নায়ক হয়েও চুটিয়ে কমেডি করেছেন। পাশাপাশি চালিয়ে যেতে থাকেন গান। কে এল সায়গলের অনুকরণে।
একদিন শচীন দেব বর্মন তাঁকে পরামর্শ দেন অনুকরণ বাদ দিয়ে নিজস্বতা আনতে। সেই পরামর্শ মেনে কিশোর কুমার নিজের গায়কীর পরিবর্তন আনেন। তারপরেই গায়ক হিসেবে পেয়ে যান কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। অর্জন করেন বিপুল জনপ্রিয়তা। তারপর ধীরে ধীরে কমিয়ে ফেলেন অভিনয়।
সেই সময় তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী গায়ক ছিলেন মহম্মদ রফি, মুকেশ, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
অভিনেতা, গায়কের পাশাপাশি কিশোরকুমার সুরকার, গীতিকার এবং প্রযোজকের ভূমিকাও পালন করেছিলেন।
জীবনে বহু সুরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শচীনদেব বর্মন, খেমচাঁদ প্রকাশ, শঙ্কর-জয়কিশন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কল্যাণজি-আনন্দজি, রবি, লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল, রাহুল দেব বর্মন, রাজেশ রোশন, বাপি লাহিড়ী, নাদিম-শ্রাবণ, অনু মালিক প্রমুখ। এঁদের মধ্যে রাহুল দেব বর্মনের সঙ্গে জুটি বেঁধে কিশোর কুমার সবচেয়ে বেশি হিট গান শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন।
রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন, শশী কাপুর, ধর্মেন্দ্র, সুনীল দত্ত, রণধীর কাপুর, সঞ্জীব কুমার, দেব আনন্দ, ঋষি কাপুর, মিঠুন চক্রবর্তীর লিপে বহু গান গেয়েছেন কিশোর কুমার। অনুষ্ঠানের জন্য গেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।
হিন্দির পাশাপাশি গেয়েছেন অসংখ্য বাংলা গান। সত্যজিৎ রায়ের ‘চারুলতা’ এবং ‘ঘরে বাইরে’ ছবিতে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছিলেন কিশোর। সত্যজিৎ রায় ছিলেন কিশোর কুমারের আত্মীয়। জানা যায়, একটা সময় সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’র কাজ টাকার জন্য আটকে গিয়েছিল। সেইসময় ছবির জন্য কিছু টাকা দিয়েছিলেন কিশোর কুমার।
বিয়ে করেছিলেন রুমা গুহ ঠাকুরতাকে। সুখেই কাটছিল সংসার। জন্ম হয় পুত্র অমিতের। সেইসময় কিশোর কুমার চেয়েছিলেন, সংসারেই আবদ্ধ থাকুক রুমা। কিন্তু তখন রুমা অভিনয়, গান এবং সামাজিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই মানতে পারেননি কিশোর কুমারের অনুরোধ। শুরু হয় বিবাদ। শেষমেষ বিচ্ছেদ।
পরবর্তী সময়ে কিশোরকুমার বিয়ে করেন মধুবালা, যোগিতাবালি, লীনা চন্দভরকরকে। তবে জীবনে শান্তি পাননি।
১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবর ৫৮ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত কিশোর কুমারের মৃত্যু হয়। আজ তিনি নেই। তবে থেকে গেছে তাঁর অসংখ্য গান। তাঁকে অনুসরণ করে উঠে এসেছেন কুমার শানু, অভিজিৎ ভট্টাচার্য, বিনোদ রাঠোড়, কেকে, গৌতম ঘোষ প্রমুখ বহু গায়ক। এইভাবেই তাঁর গান বেঁচে থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
আজ কিশোর কুমারের জন্মদিন। অমর শিল্পীকে জানাই প্রণাম।
সব ছবি: আন্তর্জাল
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Comments